পিরিয়ড জটিলতা: সমাধান কি যোগাসনে?

মাসিকের সময় কারও গা ম্যাজম্যাজ করে, কারও তলপেট-ঊরুতে চিনচিনে ব্যাথা হয়। এসব অস্বস্তি নিয়ে অনেকে মনের চাঙ্গা ভাব হারিয়ে অবসাদে ভোগেন; আবার কারও পিরিয়ডই হয় অনিয়মিত।

তৃপ্তি গমেজবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 May 2021, 07:11 PM
Updated : 27 May 2021, 07:11 PM

এসব লক্ষণ বড় কোনো স্বাস্থ্য জটিলতার কারণ না হয়ে থাকলে নিয়মিত যোগাসন (ইয়োগা) বদলে দিতে পারে নারীর পিরিয়ডের দিনে শরীর ও মনের পরিস্থিতি।

যোগাসন গুরুরা বলছেন, নিয়মিত চর্চা রাখলে পিরিয়ডজনিত জটিল অসুখ শরীরে বাসা জেঁকে বসার সুযোগ পাবে কম।

২০১৬ সালে মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে কিশোরী-তরুণী থেকে মধ্যবয়সী নারীর পিরিয়ডকালের শারীরিক-মানসিক অস্বস্তি নিয়ে জরিপ করে শারমিন কবীরের প্রতিষ্ঠান ‘ঋতু’।

সেই অভিজ্ঞতা থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, দেশের প্রায় ৭১ শতাংশ নারীই অনিয়মিত পিরিয়ডের সমস্যায় ভোগেন।

এ বছর ১ সেপ্টেম্বরে ‘ঋতু’র ফেইসবুক পাতায় মেয়েদের মাসিক সমস্যার ধরণ জানতে চেয়ে একটি জরিপ পোস্ট করা হয়। দেখা গেছে, অনলাইন ওই জরিপে অংশ নেওয়া ৪০ দশমিক ৭ শতাংশ নারীর পেট ফাঁপা, পিঠে ব্যাথা, হতাশা, ব্রণ, উদ্বেগ ও বিরক্তি দেখা দেয় পিরিয়ডের দিনে। মাসিকের দিনে মাইগ্রেন বা মাথা ব্যাথা হয় ১৪ দশমিক ৮ শতাংশের; আর তলপেট ও কোমরে অসহ্য ব্যাথায় ভোগেন ২২ দশমিক ২ শতাংশ। 

এসব থেকে মুক্তি পেতে মেয়েদের যোগাসন বেছে নিতে পরামর্শ দেন শারমিন কবীর।

“পিরিয়ডের ব্যথা কমিয়ে মনকে শিথিল করতে ইয়োগার কোনো বিকল্প নেই। ইয়োগা করলে শরীরের পেশি স্বচ্ছন্দ্যে কাজ করে। ইয়োগা হরমোনের মাত্রা এবং রক্ত প্রবাহ ঠিক রাখে।”

স্বাস্থ্যগত অস্বাভাবিকতায় চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি হলেও অনেকের ক্ষেত্রেই ওষুধ খাওয়ার কিছুদিন পর মাসিকের সমস্যাগুলো ফিরে ফিরে আসে বলে মন্তব্য করেন শারমিন। পুরোপুরি ওষুধ নির্ভর না থেকে বরং নিয়মিত যোগাসন থেকে ভালো ফল মেলে বলে জানান তিনি।

উষ্ট্রাসন, শশাঙ্গাসন ছাড়াও সাইকেল চালানো, সাঁতার পিরিয়ড দিনের সমস্যা কমাতে ও পিরিয়ড নিয়মিত করতে কাজে দেয় বলে জানান মিরপুরের কনফিডেন্ট উইমেন ইয়োগা সেন্টারের প্রশিক্ষক রেবু চৌধুরী।

তিনি বলেন, “কোনো যন্ত্র ছাড়াই সাইক্লিং ও সাঁতারের  অঙ্গভঙ্গিতে ইয়োগা করা যায়।  উষ্ট্রাসন ও শশাঙ্গাসন তো নারীর জন্য আশীর্বাদ। মেয়েদের শরীরে যে ডিম্বাণু তৈরি হয় তা মাসিকের সময় ঠিকমত বেরিয়ে না গেলে ভবিষ্যতে সিস্ট ও টিউমারের মতো সমস্যা হতে পারে। ইয়োগা মাসিক সম্পূর্ণভাবে হতে সহায়তা করে।

“সবার পিরিয়ড এক রকম হয় না। কারও কম, কারও বেশি, কারও অনিয়মিত; এসব ভিন্নতা হরমোনের কারণে হয়। ৩৫ থেকে ৪০ বছরের নারীদের মুড সুইংয়ের সমস্যা বেশি দেখা যায়; ইয়োগা করে নারীরা সুফল পাবেন।”

নয় বছর ধরে ইয়োগা করছেন গৃহিনী মাকসুদা মলি। বোনের বান্ধবীর কাছ থেকে ইয়োগা করা শিখেছিলেন।  ঘরেই নিয়মিত অনুশীলন করেন তিনি।

মানসিক প্রশান্তির জন্যই যোগাসনে ঝুঁকে পড়েন জানিয়ে বাসাবোর বাসিন্দা মাকসুদা বলেন, “সংসারে নানা রকম জটিলতা থাকে যা সবাইকে বলা যায় না, হালকাও হওয়া যায় না। এমন মানসিক অশান্তি কমাতেই পরিচিত একজনের পরামর্শে ইয়োগা করা শুরু করি। আগে অনেকেই আমার ইয়োগা করা নিয়ে হাসতো; কারণ তখন তো এর অত প্রচলন ছিল না। আর অত সেন্টারও ছিল না। কিন্তু এখন বিষয়টা বেশ স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আর আমি নিজে এর ইতিবাচক ফলাফল পেয়েছি তাই এখনও বাসায় যতটা সম্ভব চালিয়ে যাচ্ছি।”

মেয়েদের বয়ঃসন্ধি বেলায়  প্রতি মাসে পিরিয়ডের রক্তের সাথে ডিম্বাণু নিঃসৃত হয়। বয়স ৫০ পার হলে এই ডিম্বাণু শেষ হয়ে যায় বলে মাসিক বন্ধ হয়ে যায়; অর্থ্যাৎ মেনোপজ ঘটে। শারীরিক ও মানসিক জটিলতায় ভুগে অনেকের ৪০ পেরোবার আগেই মাসিক বন্ধ হতে পারে; যাকে বলে প্রিম্যাচিওর মেনোপজ। ৫০ বছর বয়সের পর মাসিকের এই প্রক্রিয়া বন্ধ হলে তা নরমাল মেনোপজ।

দুই সন্তানের মা মাকসুদা মলি বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই এই নারীর পিরিয়ড এখনও নিয়মিত। নিয়মিত যোগাসন করার কারণেই এটা হচ্ছে বলেই মনে করেন তিনি।

যোগ প্রশিক্ষক রেবু চৌধুরীও জানালেন, ইয়োগা ধরে রাখলে প্রিম্যাচিওর মেনোপজ হওয়ার সম্ভাবনা কমে আসতে পারে।  

“নারীর মেনোপজের সময়টা অনেকক্ষেত্রেই বংশগত হলেও অনেকক্ষেত্রেই ইয়োগা দিয়েও মেনোপজ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।”

তবে বাড়িতে যোগাসন চর্চা করার আগে নারীকে নিজের স্বাস্থ্য জটিলতা নিয়ে ভালোমত জেনে নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

রেবু বলেন, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, রক্তচাপ, আরথ্রাইটিস আছে কিনা তা জানা জরুরি। তা না হলে ভুল আসন করে শরীরের ক্ষতি হতে পারে।

আর তাই আগে কোনো যোগাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গিয়ে বা অভিজ্ঞ প্রশিক্ষকের কাছে জেনে ও শিখে নিতে হবে নিজ নিজ স্বাস্থ্য উপযোগী আসনগুলো।

সেক্ষেত্রে খরচ কি খুব বেশি হতে পারে?

রেবু চৌধুরী বলেন, “অনেক জায়গায়ই অল্প টাকায় এক সঙ্গে অনেক ধরনের ইয়োগা, অ্যারোবিক্স বা জুম্বা করানো হয়। কিন্তু এগুলো খুব বেশি কার্যকর নয়। এতে ওজন কমলেও ত্বক ঝুলে যাওয়া বা অন্যান্য নানা রকমের সমস্যা দেখা দিতে পারে।”

যোগাসন শেখার যেসব বই পাওয়া যায় তাতে অনেক ভুল উপস্থাপনা থাকে জানিয়ে এসব বই সংগ্রহ না করারই পরামর্শ দিলেন তিনি।

দেশে ইয়োগা নিয়ে এখনও ভালোমানের বই নেই বলেই জানান ধানমণ্ডির জয়সন ইয়োগা অ্যান্ড ওয়েলনেস সেন্টারের প্রশিক্ষক শর্মিষ্ঠা সরকার। আগ্রহীরা  ভারতীয় লেখকদের কিছু বই সংগ্রহ করতে পারেন। তবে এরপরও একজন প্রশিক্ষকের নির্দেশনা মেনে যোগাসন শেখা শুরু করা উচিৎ বলে মনে করেন তিনি।

পিরিয়ডের জটিলতা দূর করতে যোগাসনের সুফল সম্পর্কে শর্মিষ্ঠা বলেন, “নারীর জীবনযাপনে খাদ্যাভাস, পরিবেশ, মানসিক অবস্থা সবকিছুই হরমোনে প্রভাব ফেলে। আর এসব পিরিয়ডেও প্রভাব রাখে।

“অনেকের মাসিক অনিয়মিত হয়, এই সময়ে অনেকের পেট ও কোমর ব্যাথা হয়ে থাকে। কেউ কেউ এসব নিয়ে মন খুলে বলতেও পারেন না। …পিরিয়ডের সময় হরমোনের ওঠা-নামার কারণে মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকে। নানা বয়সের নারী এমনকি কিশোরীদের মধ্যেও এই প্রবণতা দেখা দেয়। ইয়োগার মাধ্যমে হরমোনের ভারসাম্য ধরে রাখা সম্ভব। মানসিক স্বাস্থ্য ও শারীরিক সুস্থতার জন্য কিছু প্রাণায়াম আছে, সেসব করা যেতে পারে।”

অনেকেই পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে ইয়োগা করবেন কি করবেন না এ নিয়ে দ্বিধায় থাকেন। পিরিয়ডের দিনেও কি ইয়োগা করা যাবে?

শর্মিষ্ঠা সরকার বলেন, “পিরিয়ড শুরুর প্রথম দুই দিন ইয়োগা না করাই ভালো। এরপর পেটে চাপ পড়ে না এমন আসনগুলো করা যেতে পারে।”

তার মতে, যোগাসন অনুশীলন করার নির্দিষ্ট কোনো সময় না থাকলেও ভোর ৫টা থেকে সকাল ৮টা হলে ভালো। কারণ সারারাত ঘুমের পরে সকালে মন ও মস্তিষ্ক শান্ত থাকে।

তবে যোগগুরুরা বলছেন, ভালো খাদ্যাভ্যাস, আট ঘণ্টার নিরবিচ্ছিন্ন ঘুম এবং পর্যাপ্ত পানি পান করা না হলে  যোগাসনে সুফল মিলবে না।

সকালে একটু খালি পেটে ইয়োগা করলে শরীর ও মনের জন্য তা বেশি উপকারী। এর সঙ্গে এটাও খেয়াল রাখতে হবে যে পেট ভরে পানি পান করে যোগাসন করলে অস্বস্তি লাগতে পারে যে কারো। যদি গলা শুকিয়ে আসে তবে দুয়েক চুমুক পানিতে গলা ভিজিয়ে নেওয়া যেতে পারে, বললেন শেখ সুহানা।

সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় বই দেখে ইয়োগা শুরু করেছিলেন; এরপর একে পেশা হিসেবে বেছে নিতে নেপাল, ভারত ও থাইল্যান্ডের তিনজন গুরুর কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নেন সুহানা। পাঁচ বছর ধরে চালাচ্ছেন সুহানা’স ইয়োগা স্টুডিও। 

যোগাসন করে পিরিয়ড সমস্যায় ভোগা নারীরা ভালো ফল পাচ্ছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “আমার সেন্টারে ইয়োগা শিখতে এসেছিলেন একজন অবিবাহিত নারী, যার সাত বছর ধরে পিরিয়ড হত না। ইয়োগা শুরু করার এক মাসের মাথার তার পিরিয়ড শুরু হয়েছে। শুনতে আশ্চর্য লাগলেও এমনটাই ঘটেছে।”

পিরিয়ড চক্রে গড়বড় ছিল ২৬ বছর বয়সী রাহাতারা ফেরদৌসিরও। তিন-চার মাস আগে যোগাসন অনুশীলন শুরু করেন কানাডার অটোয়াতে এমসিআর ল্যাবের এই গবেষণা সহায়ক; সপ্তাহে অন্তত তিন-চার দিন যোগ করছেন।

যোগাসনে উপকারিতা পাওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “ইয়োগা শুরু করার পর থেকে এই সাইকেল একদম ঠিক হয়ে গেছে। পিরিয়ড চলার সময় খুব বেশি ব্যাথা হলে বাটারফ্লাই ও অন্য হালকা আসনগুলো করি।”

ইয়োগা তাহলে কি মাসিক সমস্যায় জাদুকরি নিরাময়?

যোগ প্রশিক্ষক শেখ সুহানা বলেন, “পিরিয়ডের জন্য যে বিশেষ আসন করা হয় তা মূলত মেয়েদের পেলভিস সেকশনে চাপ ফেলে; ফলে পিরিয়ড নিয়মিত ও স্বাভাবিক হয়।”

অনিয়মিত পিরিয়ডে ধনুর আসন কাজে দেয় জানিয়ে তিনি বলেন, “কেউ নিয়মিত ইয়োগা করলে এক মাসের মাথাতেই নিজের উন্নতি বুঝতে পারেন। আর তার এক মাসের উন্নতি বুঝে আমরা পরবর্তিতে তার জন্য নতুন আসনের পরিকল্পনা করে থাকি।”

যোগাসন করার সময় আঁটোসাঁটো পোশাক এড়িয়ে ঢিলেঢালা ও আরামদায়ক পোশাক পরা ভালো। ঘাস বিছানো বাগান, খোলামেলা বারান্দা অথবা ছাদ বেছে নেওয়া যেতে পারে অনুশীলনের জন্য। সেই সুযোগ না থাকলে আলো-বাতাসের চলাচল করে এমন ঘরেই যোগাসন করা যাবে। অনুশীলনের সময় চলতে পারে পছন্দের কোনো মিউজিক।