‘আবুল হাশেমের চোখের সামনেই মারা যান বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান’

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Dec 2016, 09:25 PM
Updated : 24 Dec 2016, 09:26 PM

বীর বিক্রম ক্যাপ্টেন আবুল হাশেম জেড ফোর্সের অধীনে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।

আবুল হাশেমের চোখের সামনে যশোরের গ্রাম খেতিবদিয়াতে পাক হানাদারবাহিনী তান্ডব চালাতে শুরু করে। এই তান্ডব দেখে তার মনে প্রশ্ন জাগে, ‘যদি দেশ না থাকে, মা বোনের সম্মানই না থাকে, তবে আমাদের বেঁচে থেকে লাভ কি?’ দেশকে বাঁচাতে যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন আবুল হাশেম। সংকল্প ছিল যদি বাঁচতে হয়, তবে স্বাধীন দেশেই বাঁচব।

মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়ে মাসলিয়া বিপি নামক স্থানে ইচ্ছুক যোদ্ধারা একত্রিত হন। এরপর ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের সাথে যোগাযোগ শুরু করেন। ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রথমেই আবুল হাশেমদের কাছে রক্ষিত অস্ত্র পরীক্ষা করেছিলেন এবং এক সপ্তাহের মধ্যে অস্ত্রের প্রয়োজনীয় বুলেট সরবারহ নিশ্চিত করেন। ময়মনসিংহয়ের কামালপুর নামে একটা জায়গায় পাকিস্তানি বাহিনীর বড় ঘাঁটি ছিল। তখন তেলদালা নামক স্থানে পাহাড়ের উপরে জেড ফোর্সের একটা ক্যাম্প ছিল। ইতিমধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা কামালপুরে পাকিস্তানি ক্যাম্পে বেশ কয়েকবার ছোট খাট হামলা করেছিল। কিন্তু তাতে পাকিস্তানি বাহিনীর তেমন কোন ক্ষতিসাধন হয় নি।  

আবুল হাশেমদের কাছে নির্দেশ এসেছিল, পরিকল্পিতভাবে কামালপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর উপর হামলা চালাতে হবে। সেই লক্ষ্যে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান দেখতে মুক্তিযোদ্ধারা রেকি করতেন, পাকিস্তানি বাহিনীর দিকে নজর রাখতেন। একদিন কমান্ডার ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ অন্য দুজন মুক্তিযোদ্ধা লেঃ মান্নান এবং সুবেদার ইব্রাহিমকে পাকিস্তানি ক্যাম্প থেকে একটু দূরে অবস্থান করতে বললেন এবং ক্যাপ্টেন হাশেম, ক্যাপ্টেন আব্দুল হাইকে নিয়ে তিনি ভিতরের দিকে রওয়ানা দিলেন। তারা হাঁটতে হাঁটতে পাক বাহিনীর বাংকারের কাছে পৌছে গেলেন। সুযোগ বুঝে কৌশলে দুজন পাকিস্তানি সৈন্যকে মেরেও ফেললেন এবং তাদের অস্ত্র নিয়ে পালিয়ে গেলেন। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন কিছুটা আহত হওয়ায় ক্যাপ্টেন হাশেম তাকে কাঁধে নিয়ে দৌড়াতে লাগলেন। নিরাপদেই ফিরে এসেছিলেন তারা।

এই ঘটনার তিনদিন পর কামালপুরে বড় আক্রমনের পরিকল্পনা করা হলো। তখনকার কমান্ডার ছিলেন মইনুল হাসান। ক্যাপ্টেন আবুল হাশেমের মূল দায়িত্ব ছিল কমান্ডিং অফিসারকে রক্ষা করা। এই যুদ্ধে কিছু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। ভারতীয় বাহিনী ভুল করে মুক্তিযোদ্ধাদের উপরও গুলি বর্ষণ করেছিল। এদিকে পাকিস্তানি বাহিনীর হামলা তো ছিলই। তুমুল যুদ্ধ হয়েছিল সেখানে। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিনসহ পঞ্চাশজন মুক্তিযোদ্ধা এই যুদ্ধে শহীদ হন। এই যুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ সফলতা আসে নি। তবু মুক্তিযোদ্ধারা হাল ছেড়ে দেন নি। ১৫/২০ দিন পরে লেঃ কর্নেল জিয়াউদ্দিন নতুন কমান্ডিং অফিসার হিসাবে যোগ দিলেন। উনি এসেই নির্দেশ দিলেন কামালপুরে পাকিস্তানি ক্যাম্পে আবার আক্রমণ চালানো হবে। সেই অনুযায়ী আবার হামলা চালানো হলো। পাকিস্তানি বাহিনীর বহু সৈন্য এই যুদ্ধে মারা গিয়েছিল। ২০/৩০ জন মুক্তিযোদ্ধাও এই যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। বহু আত্নত্যাগের বিনিময়ে শেষ পর্যন্ত কামালপুর হানাদার মুক্ত হয়েছিল।

সিলেট জেলার শ্রীমঙ্গল থানার ধলই চা বাগানের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত ধলই বর্ডার আউটপোস্ট। সেখানে পাকবাহিনীর উপর হামলা চালানোর পরিকল্পনা করল মুক্তিযোদ্ধারা। এই যুদ্ধে ক্যাপ্টেন আবুল হাশেমের সহযোদ্ধা ছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান। এই যুদ্ধে সমস্যা ছিল পাকিস্তানি বাহিনী ছিল উপরের দিকে, আর মুক্তিযোদ্ধারা ছিল নিচু ভূমিতে। তাই মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল পাকিস্তানি বাহিনী। পাকিস্তানিদের ওই ক্যাম্পে কয়েকবার বিচ্ছিন্নভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন দল হামলা করেছিল। কিন্তু খুব একটা সফলতা আসে নি।

আবুল হাশেমের দল ধলই বর্ডার আউটপোস্টে আক্রমণ শুরু করতে উদ্যত হলো। আক্রমণের দিন মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন নালায় অবস্থান নিয়েছিল। পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান বুঝে তাদের উপর গুলিবর্ষণ শুরু করল। মুক্তিযোদ্ধারা নিচের দিকে থাকায় তারা ঠিকমত গুলি করতে পারছিল না। কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধারা উপরের দিকে উঠার চেষ্টা করছিলেন। অন্যদিকে হামিদুর রহমান এবং ক্যাপ্টেন আবুল হাশেম নালার ডানদিকে অগ্রসর হতে চেষ্টা করছিলেন। তখন পাকিস্তানি বাহিনী মেশিনগান দিয়ে গুলি শুরু করল। ক্যাপ্টেন আবুল হাশেম প্রাণে বেঁচে গেলেও, শহীদ হন বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান। রমজান মাস ছিল তখন। বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান সেদিন রোজাও ছিলেন। প্রায় ৩৩ কিমি দূরে গিয়ে তাকে সমাহিত করা হয়েছিল। ওই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী শেষ পর্যন্ত ধলই বর্ডার আউটপোস্টটি দখল করতে সক্ষম হয়েছিল।

নতুন প্রজন্মের উদ্দেশ্যে ক্যাপ্টেন আবুল হাশেম বলেন, ‘আমরা রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে, সর্বস্ব দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। নতুন প্রজন্মের মূল কাজ হবে এই স্বাধীনতাকে রক্ষা করা এবং দেশের প্রয়োজনে নিজের জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়া।’