তারবার্তায় মুজিব: মার্কিন নজরদারি ৫৫ সাল থেকেই

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রসঙ্গে একসময় প্রচুর তারবার্তা চালাচালি হয়েছে ঢাকাস্থ মার্কিন কনসাল, রাওয়ালপিন্ডির মার্কিন দূতাবাস এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র অধিদপ্তরের মধ্যে। স্বাধীনতার আগে ও পরে শুধু মার্কিন তরফেই নয়, তারবার্তা গেছে ব্রিটিশ হাইকমিশন থেকেও। মুজিববর্ষকে সামনে রেখে আমরা তার মধ্য থেকেই বাছাই করা কিছু তারবার্তা প্রকাশ করতে যাচ্ছি।

অমি রহমান পিয়ালবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 March 2020, 05:00 PM
Updated : 16 March 2020, 05:39 PM

বেশ কিছু বার্তায় বঙ্গবন্ধুর নাম এসেছে ঘটনাচক্রে, তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কারণে নয়। কোথাও মাত্র এক লাইনে উচ্চারিত হয়েছে তার নাম। আবার কিছু ছিল পুরোপুরি তাকে নিয়ে, তার সরকার নিয়ে। তারবার্তা বাছাই এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

তবে এক লাইনের উল্লেখও সময়ের বিচারে বিশাল হয়ে দেখা দেয় তার প্রমাণও মিলেছে। যেমন ১৯৫৫ সালের ২৮ এপ্রিল হেনরি ডাব্লু স্পিয়েলম্যান ৯ পাতার একটি তারবার্তা পাঠান ঢাকা থেকে। তিনি ছিলেন মার্কিন কনসুলেটের প্রিন্সিপাল অফিসার। ‘Politcal attitudes and opinions, East Pakistan’ শিরোনামের বার্তাটিতে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন মহলে আলোচনার সার হিসেবে একটা পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছিলেন স্পিয়েলম্যান। তারই ৮ম পাতায় ছিল ‘Attitude toward West Pakistan and Central Government’ নামে একটি অনুচ্ছেদ।

পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত ও সুশীল সমাজের সঙ্গে আলাপচারিতায় পশ্চিম পাকিস্তান এবং কেন্দ্রিয় সরকারের প্রতি তীব্র ক্ষোভের আভাস পেয়েছেন স্পিয়েলম্যান। বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তান সরকারের বিদ্বেষ, উদাসীনতা এবং বঞ্চনা জন্ম দিয়েছিল এই চাপা ক্ষোভের যা টগবগ করে ফুটছিলো সেই মাঝপঞ্চাশেই! চাকরিক্ষেত্রে, প্রশাসনে এমনকি সেনাবাহিনীতেও বৈষম্য প্রকট হয়ে উঠেছিল যা উঠে এসেছিল দু পক্ষের আলাপচারিতায়।

স্পিয়েলম্যান এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন, “There is certain amount of separationist feelings in the Province. A demi-god such as Huq, Bhashani or a persuasive speaker like Sheikh Mujibur Rahman could fan this feeling into a real revolt.”

ভাবানুবাদ করলে এর অর্থ দাঁড়ায়, “প্রদেশে বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাবের আভাস প্রকট। দেবতার মতো পূজনীয় হক (শেরে বাংলা ফজলুল হক), ভাসানী (মওলানা আবদুল হামিদ খান) কিংবা শেখ মুজিবুর রহমানের মতো একজন উজ্জীবনী বক্তা এই অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে সত্যিকারের বিদ্রোহ ঘটাতে পারেন।”

১৬ বছর পর বঙ্গবন্ধু ঠিকই স্বাধীন বাংলাদেশ উপহার দিয়েছিলেন!

***

আমাদের আলোচ্য তারবার্তাটি পাঠানো হয়েছিল ১৯৭০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। পাঠিয়েছেন অ্যান্ড্রু কিলগোর, যিনি ছিলেন ঢাকার মার্কিন কনস্যুলেটের কনসাল ইন চার্জ। গোপনীয় এই তারবার্তার শিরোনাম ছিল- “পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আহসান পূর্ব বাংলায় মার্কিন হস্তক্ষেপের অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন”।

অ্যাডমিরাল সৈয়দ মোহাম্মদ আহসান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ছিলেন ১৯৬৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ পর্যন্ত। সে বছর জানুয়ারি মাসে শুরু হয়েছিল গোটা পাকিস্তানে জাতীয় নির্বাচনের প্রচারণা। সে সময় মাওলানা ভাসানী তার রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) তরফে অভিযোগ করেন যে, মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ এস ফারল্যান্ডের তত্ত্বাবধানে সিআইএ পূর্ব পাকিস্তানে উস্কানিমূলক তৎপরতা চালাচ্ছে। কিন্তু আমরা তারবার্তাটি বেছে নিয়েছি কারণ এখানে নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগের বিজয়ের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে প্রায় ১০ মাস আগেই। আহসানের সঙ্গে কনস্যুলেট কর্মকর্তাদের আলোচনার খুঁটিনাটি ছিল ওই বার্তায় যার ভাবানুবাদ নিচে তুলে ধরা হলো:

এক

১৩ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আহসানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত হয়েছিল একজন ডেপুটি চিফ অব মিশন সোবার, পলিটিকাল কাউন্সিলর পামার এবং কনসাল ইন চার্জের (কিলগোর)। আহসান বলেছেন:

ক. রাজনৈতিক মহলের কিছু অংশে পূর্ব পাকিস্তানে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ হস্তক্ষেপ করছে বলে যে রটনা রটেছে তা পাকিস্তানের প্রশাসনের কোনও কর্মকর্তাই বিশ্বাস করেন না।

খ. তিনি আত্মবিশ্বাসী যে নির্বাচনী প্রচারাভিযানের সময় আইন শৃংখলার প্রতি যে কোনও রাজনৈতিক হুমকি মোকাবেলার সক্ষমতা সামরিক আইন প্রশাসনের (এমএলএ) রয়েছে।

গ. শেখ মুজিবুর রহমান নিশ্চিতভাবেই পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচনে বিজয়ী হতে যাচ্ছেন।

ঘ. সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসমূলক ঘটনাবলীতে মুজিব খানিকটা দায়ী, তার অনুগতরাই গত কয়েকটা রাজনৈতিক সভায় এসব ঘটনা ঘটিয়েছে। এবং:

পশ্চিম বঙ্গ থেকে আসা অনুপ্রবেশকারীরা খুলনা-যশোর অঞ্চলে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে।

দুই

সিআইএ পূর্ব পাকিস্তানকে সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার অপতৎপরতা চালাচ্ছে বলে যে অভিযোগটা বারবার তোলা হচ্ছে, যেমন ধরুন ন্যাপ নেতা ভাসানীর মুখে যা শোনা গেছে, আহসান তা নাকচ করে দিয়ে বলেছেন- প্রশাসনে কর্মরত কোনও পাকিস্তানি তা বিশ্বাস করেন না। আহসান জানিয়েছেন, এমন অভিযোগ নিয়ে তৈরি একটি প্রামাণ্য দলিল সম্প্রতি তিনি দেখেছেন এবং দেখামাত্রই তার কাছে তা ভুয়া মনে হয়েছে এর বাক্যগঠনের রীতির কারণে (সম্ভবত ভাসানী তার কাছে যে তথ্যপ্রমাণের যে দলিলটি রয়েছে বলে দাবি করছেন)। গভর্নর বলেছেন, পাকিস্তানে এই মুহূর্তে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড যেরকম উত্তুঙ্গ অবস্থায় রয়েছে তাতে এ ধরনের অভিযোগ ওঠাটা চাইলেও ঠেকানো যাবে না। তিনি বিশ্বাস করেন না যে যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টা নিয়ে অহেতুক উদ্বিগ্ন, তার সুপারিশ আমাদের উচিত এই ফাঁদে পা না দেওয়া এবং আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবাদ জানানো। তিনি আগ বাড়িয়ে মন্তব্য করেছেন যে, কিছু মার্কিন এইড কর্মকর্তা যারা নিয়মিত পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে যোগাযোগ করেন, তার এসব প্রক্রিয়ার ধীর গতিতে মাঝে মাঝে হতাশ হয়ে পড়েন। তাদের পাকিস্তানি অংশীদাররা পূর্ব পাকিস্তানের জন্য কেন্দ্রিয় সরকার কিছুই করছে না বলে যখন সমালোচনা করে তখন এই মার্কিন কর্মকর্তাদের দেখা যায় তাতে সম্মতি দিতে। তাই এই প্রেক্ষিতে মার্কিন কর্মকর্তাদের নির্দোষ বক্তব্য হয়তো একটু বাড়িয়ে পাকিস্তান সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কানে তোলা হয়, যা এরকম ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করে। তবে আহসানের ধারণা, যুক্তরাষ্ট্র যদি সত্যিই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ঝামেলা করতে চাইতো তাহলে সবচেয়ে ভালো উপায় ছিল ত্রাণ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে আসা কয়েক মিলিয়ন গম পাঠাতে অস্বীকার করা।

তিন

রাজনৈতিক সমাবেশে সাম্প্রতিক দাঙ্গা হাঙ্গামার ঘটনা প্রসঙ্গে গভর্নর আহসান বলেন, আইন-শৃংখলা বজায় রাখতে সামরিক আইন প্রশাসন (এমএলএ) বদ্ধপরিকর, সে হুমকি ডান কিংবা বাম যে তরফেই আসুক না কেন। তিনি শুকনো স্বরে বলেন, সবাই এই ঘটনায় ব্যবস্থা না নেয়ায় এমএলএর সমালোচনা করছে, আবার সরকার কঠোর ব্যবস্থা নিলে সবাই বলতো যে শক্তিপ্রয়োগ করা হচ্ছে।

(টিকা: জানুয়ারির শেষে এবং ফেব্রুয়ারির শুরুতে আওয়ামী লীগ এবং জামায়াতে ইসলামীর সমর্থকদের মধ্যে কয়েকটি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে পল্টন ময়দানে বেদম পিটুনিতে বেশ কয়েকজন জামায়াত কর্মী আহত হয়।)

চার

আহসান আন্দাজ করছেন, আগামী ৫ অক্টোবরের (আসলে ডিসেম্বরে) নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান শতকরা ৬০ থেকে ৭০ ভাগ ভোট পেয়ে জয়ী হবেন। গত কয়েক সপ্তাহে ঢাকার পল্টন ময়দানে মুজিব সমর্থকদের ‘তাণ্ডবে’ তিনি হতাশা জানান। তিনি এসব হাঙ্গামায় উস্কানি দেয়ার জন্য সরাসরি মুজিবকে দায়ী না করলেও ধারণা করছেন সমর্থকদের ওপর সম্ভবত মুজিবের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নেই। এসব হাঙ্গামার অন্যতম কারণ হচ্ছে নির্বাচনে মুজিবের একচেটিয়া জয়ী হওয়ার বাসনা এবং প্রতিপক্ষের প্রতি তার অসহিষ্ণুতা। তিনি মনে করেন এমনকি ‘কাফের’ বলে সম্বোধন করলেও প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর সমালোচনা সহ্য করার মতো বিশাল মন থাকা উচিত মুজিবের।

আহসান বলেছেন, পূর্ব পাকিস্তানে সন্ত্রাস খুব কুৎসিত রূপ নিয়েছে যার কারণে প্রচুর অবাঙালি আতঙ্কিত হয়ে পরেছে বাঙালিদের উগ্র জাতীয়তাবাদী আচরণে। তিনি উদাহরণ দিয়ে বললেন, কিছুদিন আগে চট্টগ্রামে হক্সট (Hoechst) ফার্মের জার্মান ম্যানেজারকে হুমকি দিয়েছে বাঙালি কর্মচারিরা। বেচারা জার্মান স্রেফ প্লেনের টিকেট কেটে পাকিস্তান ছেড়ে চলে গেছেন। আরেকটা দুঃখজনক ঘটনায় ঢাকায় বাটা কোম্পানির একজন ইংরেজ কর্মকর্তা বাঙালি শ্রমিকদের ছোঁড়া ইটে হাতে আঘাত পেয়েছেন। এমন মানুষদের হারানো পূর্ব পাকিস্তানের জন্য দূর্ভাগ্যের।

পাঁচ

অ্যাডমিরাল আহসান বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা নিয়ে পাকিস্তান সরকার খুব একটা উদ্বিগ্ন নয়। নির্বাচন শেষ হওয়ার পর প্রদেশগুলোর ক্ষমতার বণ্টন ও পারস্পরিক সম্পর্ক ঠিক করতে রাজনৈতিক সমঝোতামূলক তৎপরতা চালাতে হবে। মুজিব যদি প্রধানমন্ত্রী হন, যেটা হওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি, তাহলে নিশ্চয়ই তিনি গোটা দেশের নিয়ন্ত্রণে কোনো দুর্বল কেন্দ্র চাইবেন না।

ছয়

গভর্নর আহসান উল্লেখ করেছেন পশ্চিম বঙ্গ থেকে অনুপ্রবেশকারীদের, যারা খুলনা/যশোর অঞ্চলে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ ছড়াচ্ছে। অনুপ্রবেশকারিরা সম্ভবত ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টির হিন্দু সদস্য। তারা আক্রান্ত অঞ্চলের হিন্দুদের মধ্যে সহজেই আশ্রয় পেতে পারে।