দেশ তখন যত অনগ্রসর আর দরিদ্র হোক না কেন আমরা নিশ্চিত ছিলাম আমাদের নেতাই পারবেন সবকিছু সামাল দিতে। এতো বড় একজন মানুষ বাংলাদেশের রাজনীতিতে আর কখনো আসেননি, আসবেনও না। অনেকে বলেন বিশেষত অপপ্রচারকারীরা বলে বেড়ায় শেষদিকে নাকি তাঁর জনপ্রিয়তা হ্রাস পেয়েছিল। আমি বলছি, পঁচাত্তরের এপ্রিল মাসের কথা। এদের কথা যে কতটা মিথ্যা আমি তা চোখে দেখেছি।
তিনি যাবেন বেতবুনিয়া উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্র উদ্বোধনে। রাস্তাজুড়ে মানুষের উল্লাস আর কি অধীর চাওয়া। এখনকার মতো ছিল না বাংলাদেশ তখন। সাধ আর সাধ্যের মধ্যে বিরাট তফাৎ। তারপরও মানুষ নিয়ে এসেছিল তাদের প্রাণের উপঢৌকন। যার যা ছিল তাই নিয়ে এসেছিল তারা। সবজি দিয়ে বানানো মালা, ফুলের মালা নিজের বাগানের সদ্যজাত কোনও ফসল কিছু বাদ ছিল না। নেতা আসবেন। মানুষের নেতা। সকাল থেকে দাঁড়িয়ে ছিলাম এনায়েত বাজার বরফকল এলাকায়। তিনি আসবেন আগ্রাবাদ হয়ে কদমতলী পেরিয়ে। সময় যায় কিন্তু তাঁর দেখা মেলে না। এপ্রিলের কড়া রোদে মাথা ঘুরে পড়ার মতো অবস্থা। একপর্যায়ে ফিরে গিয়েছিলাম ব্যর্থ মনোরথ হয়ে। কিন্তু বাসায় কি মন টেকে? আবার এসে দাঁড়িয়েছিলাম তীর্থের কাকের মতো- নেতা আসবেন বলে, আমাদের প্রাণের নেতা।
মনে আছে দুপুর গড়ানোর আগেই তিনি এসেছিলেন। কিন্তু যে গাড়িটিতে তিনি থাকার কথা সে গাড়ির মাথা ফুঁড়ে বের হলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী মনসুর আলী। তিনি মাথা বের করে দেখলেন জনস্রোত। আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই গনগনে সূর্যের মতো পরের গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলেন তিনি। কথা বলতে পারছিলেন না নেতা। কিছুদিন আগেই বিদেশ থেকে চিকিৎসা করিয়ে এসেছেন। গলার স্বর ভেঙে গেছে, কথা বলা বারণ। তবু কি মানুষ তা মানে? আজ এতো বছর পর পেছন ফিরে তাকালে মনে হয় একজন মানুষ একজন রাজনৈতিক নেতার জন্য বাঙালির এমন আকুলতা ছিল স্বপ্নের মতো। এমনটি আর হয়নি হবেও না। তাঁকে ছুটে গিয়ে গলায় মালা পরিয়ে দিল আমাদের বন্ধু বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী মেজবাহ। সেই চিরচেনা গোঁফের ফাঁকে মৃদু হাসি।
মানুষটি গড়পরতা যেকোনও বাঙালির চাইতে দীর্ঘকায়। তিনি না ঝুঁকলে তাঁর গলায় মালা পরানোর সাধ্যকার? মাথা নিচু করেই মালা পরলেন একটি দুটি করে শখানেক। তারপর গাড়িতে ঢুকে গেলেন তিনি।
কিন্তু মানুষ কি তা মানে? তারাও ছুটলো পেছন পেছন। সে ভিড় স্রোতের মতো, ঢেউয়ের মতো, ছুটে এসে থামলো চটৃগ্রাম কলেজের সামনে। সেখানে হাজার ছাত্র-জনতা ঘিরে ধরেছে নেতাকে। তারা তাঁর কথা শুনবেই । হোক তা কেবলই একটি বাক্য। নেতা আমাদের তেমনই যিনি জানেন কখন কোথায় কী বলতে হবে। আমাদের সেই বজ্রকণ্ঠ প্রাণভোমরা নেতা আবারও তাঁর পাইপ হাতে নিয়ে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে চারপাশে তাকিয়ে আউড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ- চারিদিকে নাগিনীরা ফেলিতেছে বিষাক্ত নি:শ্বাস / শান্তির ললিত বাণী শুনাইবে ব্যর্থ ইতিহাস... তারপর?
নেতা তো ছুটলেন, গাড়ির বহর তাঁকে নিয়ে চললো বেতবুনিয়ার দিকে। আর আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে ভাসতে লাগলো- জয় বাংলা ... জয় বাংলা...।
সে ঘটনার পর খুব বেশিদিন বাচঁতে দেওয়া হয়নি তাঁকে। খুব স্বল্প আয়ুর একটি জীবন। অথচ কি বিশাল! আর কি ব্যাপক! আপনি তাঁর ছবিগুলো দেখুন। তাঁর কথা শুনুন। বুঝতে কষ্ট হবে না এই মানুষের ভয় বলতে কিছু ছিল না। আপস, দুর্নীতি বা সমঝোতা- এখন যেসব শব্দ মানুষ ঘৃণা করে, যেগুলো রাজনীতিকে কলুষিত করে সেগুলোর জন্ম হয়েছে তিনি চলে যাবার পর।
আপনাকে কোনদিন ভুলবো না আমরা বঙ্গবন্ধু। আপনি যে আমাদের পিতা।