‘বড় বোন’ সুফিয়া কামালের স্মৃতিতে বঙ্গবন্ধু

কবি সুফিয়া কামাল শেখ মুজিবুর রহমানকে তার তরুণ বয়স থেকেই জানতেন। হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দীর সাথে প্রথম দেখেছিলেন কলকাতায়। তখন মুজিব ছিলেন ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র।

মমতাজুল ফেরদৌস জোয়ার্দারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 March 2020, 04:59 PM
Updated : 16 March 2020, 04:59 PM

রাজনীতিতে সোহ্‌রাওয়ার্দী সাহেবের খ্যাতি যখন তুঙ্গে, তখন থেকেই বঙ্গবন্ধুকে একজন ছাত্রনেতা হিসেবে কবি সুফিয়া কামাল চিনতেন। পরে বঙ্গবন্ধু নেতা হিসেবে সারা বিশ্বের মানুষের কাছে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু কবি তাকে নিজের ছোট ভাইয়ের মতোই দেখতেন। আর বঙ্গবন্ধুও তাকে ‘আপা' বলে সম্বোধন করতেন এবং সম্মান করতেন।

তিনি জীবনে অনেকবারই বঙ্গবন্ধুর কাছাকাছি গেছেন এবং তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছেন। এছাড়াও তারা একই পাড়াতে থাকতেন বলে মুজিবের সাথে সম্পর্কটা ছিল পারিবারিক।

সাপ্তাহিক বিচিত্রা পত্রিকার ১৬ অগাস্ট ১৯৯৬ সালের ইসুতে বেগম সুফিয়া কামাল তার ‘ছোটভাই’ মুজিবের স্মৃতিচারণ করেছেন।  

একুশে ফেব্রুয়ারির সকালে শেখ মুজিবের সাথে পায়ে হেঁটে শহীদ মিনারে গিয়েছেন ফুল দিতে। মুজিব তাকে দেখে বলেছেন, “আহা! আমার বোনটা- আমার আপাটা এরকম করে হেঁটে যাবে!”

বঙ্গবন্ধু তখন সুফিয়া কামালকে বলতেন, “আপা, আপনি হেঁটে যাবেন না । আপনি রিকশায় যান। আমরা হেঁটে যাই।“

কবি তখন উত্তরে বলেছেন, “না ভাই, আমি হেঁটেই যেতে পারবো।“

এভাবেই তিনি মুজিবের সঙ্গে হেঁটে মিটিংয়ে যোগ দিয়েছেন, আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন।

বঙ্গবন্ধু সব সময়ই তাকে বড় বোনের মতো দেখাশোনা করতেন। কখনো রাস্তায় দেখা হলে তিনি গাড়ি থামিয়ে বলেছেন, “আপা শিগগির গাড়িতে আসেন।“

কবি হয়তো বলেছেন, “না ভাই এটুকু রাস্তা আমি হেঁটে যতে পারবো।“

কিন্তু মুজিব তা শোনেননি। বলেছেন, “না, আমি পৌঁছে দিয়ে আসি।“

কখনো ড্রাইভারকে বলেছেন, “আমার বোনকে তার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসো।

কবি যখন বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গিয়েছেন শত মিটিং-মিছিলের ব্যস্ততার মধ্যে থাকলেও মুজিব এসে প্রশ্ন করতেন- “আপনি এসে আমাকে খবর দেননি কেন?”

মুজিব বলতেন, “আপনি সরাসরি আমার কাছে চলে আসবেন। আপনি এসে কেন নিচে বসে থাকেন? আমার বাড়ি আপনার বাড়ি। আমি আপনাকে আমার বড় বোন বলে মনে করি।“

ওই একই লেখায় বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পরের স্মৃতিচারণ করেছেন কবি সুফিয়া কামাল।

স্বাধীনতার আগে কবি সুফিয়া কামালের জামাতা প্রয়াত আবদুল কাহহার চৌধুরী চট্টগ্রাম বেতারের কর্মকর্তা ছিলেন। একাত্তর সালে তিনি পাকবাহিনীর হাতে নিহত হন। বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পর এ ঘটনা শুনে বঙ্গবন্ধুকে কবি ও তার কন্যাকে ডাকলেন। বঙ্গবন্ধু কবিকে বললেন, “আমার মেয়ে বিধবা হলে যে রকম কষ্ট পেতাম আমি সেরকম কষ্ট পাচ্ছি। আপনার মেয়ে যা চায় আমি তাকে সব দেব।”

তিনি সুফিয়া কামাল বলেছিলেন- “মুজিব, এরকম হাজারো মানুষ মারা গেছে, হাজারো নারী বিধবা হয়েছে। আমার জামাইও মারা গেছে। তুমি শুধু তার জন্য একটু দোয়া করো।”

বঙ্গবন্ধু আবারও বলেছিলেন, “আপা, আমি আপনার কাছে হাত জোড় করে বলছি, আপনি বলেন আমি কী সাহায্য করতে পারি?

কবি জানিয়েছিলেন, “ভাই, রক্তের। বিনিময়ে আমার মেয়েকে কিছু দিতে হবে না। দেশের হাজারও মেয়ের মতো আমার মেয়েও বিধবা হয়েছে। অনেক বিধবাতো আমার আশ্রয়েই রয়েছে। ওদের জন্য শুধু দোয়া করো।“

তারপর যখন মুজিব রাষ্ট্রপ্রধান হলেন তখন তিনি সুফিয়া কামালকে বলেছিলেন, “শুধু একবার এসে আপনি আমাকে দোয়া করে যান।“

বঙ্গবন্ধু গাড়ি পাঠিয়েছিলেন তার কাছে। কবি বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন। সেখানে, সেটাই ছিল তার প্রথম এবং শেষ যাওয়া। তখন বাকশাল গঠিত হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু তাকে বলেছিলেন, "একজন মানুষ পাচ্ছি না যার উপর আমি বাকশালের ভার দেব। আপা আপনি যদি রাজি হন তাহলে আপনিই বাকশালের সভানেত্রী হয়ে থাকুন। আপনি যে রকম বলবেন সেরকমই হবে।"

বেগম সুফিয়া কামাল জানিয়েছিলেন, "ভাই, আমি রাজনীতি বুঝি না, আমাকে মাফ করো।"

কবি বাকশালে যোগ দেননি। “কিন্তু যখনই কোন মিটিং হয়েছে আমি মুজিবের সাথে গিয়েছি”, লিখেছেন সুফিয়া কামাল।

বঙ্গবন্ধু প্রাত:ভ্রমণে বের হয়ে তার ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে কবি সুফিয়া কামালের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে চক্কর দিতেন। একদিন সকালে কবিকে দেখে হাসতে হাসতে বললেন- “গতকাল আমাদের বাড়িতে পিঠা বানানো হলো। একবার আমার মনে হলো যে আপাকে ডাক দেব নাকি? কিন্তু অনেক ভোর ছিল বলে আপনাকে আর ডাক দিলাম না।”

কবির প্রতি বঙ্গবন্ধুর আন্তরিকতা ছিল এরকম।

বছরের বেশির ভাগ সময়ই মুজিব থাকতেন জেলে। যখনই কবি শুনেছেন যে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে গেছে তখনই তিনি তার বাড়িতে ছুটে গেছেন। বাড়িতে গিয়ে দেখেছেন, বেগম মুজিব স্বামীর কাপড়চোপড় বিছানা বালিশ গুছিয়ে জেলখানায় পাঠানোর ব্যবস্থা করছেন। তখন কবিকে দেখে বেগম মুজিব বলেছেন, “আপনার ভাই তো জেলে গেছে।“

সুফিয়া কামাল বেগম মুজিব সম্বন্ধে লিখেছেন, "এতো ধৈর্যশীলা, এতো শান্ত, এতো নিষ্ঠাবতী মানুষ- খুব কমই দেখা যায়।"

ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধুর আগে আসেন সুফিয়া কামাল। কবি বলেন, "বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের সময় তার ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভর্তি করানো নিয়ে সমস্যা হয়েছে। বেগম ফজিলাতুন্নেছা- একটা বাড়ি খুঁজে পাচ্ছে না কোথাও। এই দুর্দশার ভেতর দিয়েই মুজিব বাংলার নেতা হয়েছে। মুজিবের ত্যাগের কোন সীমা নেই। তার নিষ্ঠার কোন পরিসীমা নেই। দেশকে সে যে কতোখানি ভালোবাসতো তা পরিমাপ করা যাবে না। মানুষের জন্য তার মমত্ববোধ তীব্র ছিল, একটা আত্মার টান ছিল তার। আজকের দিনে তার মতো একজন মানুষ আমি সারা বিশ্বের কোথাও দেখতে পাই না।“

“তার পলায়নী মনোবৃত্তি ছিল না কখনো। যেখানে সংকট, যেখানে সংগ্রাম যেখানে 'সংঘাত দেখেছে মুজিব এসে আগে দাঁড়িয়েছে। মরণকে সে কখনো ভয় করেনি। তার পেছনে জনগণ ‘মুজিব ভাই' বলে লাফিয়ে পড়ে দেশ স্বাধীন করেছে। মুজিব বিশ্বাস করতো যে বাঙ্গালীরা কখনো তাকে মারতে পারে না। সেই বাঙালীর হাতেই মুজিব নিহত হয়েছে। বাঙ্গালী জাতির সেই গুনাহের, সেই পাপের কবে প্রায়শ্চিত্ত হবে আমি জানি না। মুজিবকে আমি সারা অন্তর দিয়ে এখনো উপলব্ধি করি।"


[লেখক: তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, অল ইউরোপিয়ান বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন এবং জার্মান বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন।]