বঙ্গবন্ধুর স্নেহের পরশ পাওয়া রংপুরের সেই মেয়েটি

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে রংপুর সার্কিট হাউজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটি ছোট্ট মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে আদর করেছিলেন। জাতির জনকের অনেক ছবির মত সেই ছবিটিও আজও অম্লান।

আফতাবুজ্জামান হিরু রংপুর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 March 2020, 04:53 PM
Updated : 16 March 2020, 04:53 PM

জেনিফার এলী নামের সেই মেয়েটি বর্তমানে দুই মেয়ের মা। মেয়েদের বিয়ে হয়েছে। এলীর স্বামী রংপুর প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আলী আশরাফ।

এলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে শোনালেন তিনি ও তার কয়েকজন বান্ধবী কিভাবে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে, সার্কিট হাউজের দেয়াল টপকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেছিলেন।

এলী বলেন, “বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের মে মাসে বঙ্গবন্ধু রংপুর আসেন। সম্ভবত ১০ মে। আমি তখন সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্য আমরা স্কুলের কিছু ছাত্রী সার্কিট হাউজে যাই। কিন্তু পুলিশ ব্যারিকেড দেয়। আমাদের ঢুকতে দিচ্ছিল না। আমরা আমাদের পরিচয় দিই। তবু পুলিশ রাজি হয়নি। পরে আমরা কয়েকজন ছাত্রী সার্কিট হাউজের দেয়াল টপকে যাই। সাথে সাথে পুলিশ বাধা দিতে আসে। কিন্তু আমরা আর পিছন ফিরে না তাকিয়ে দৌড়ে সার্কিট হাউজে ঢুকে পড়ি।”

এ সময় সাজেদা চৌধুরী সার্কিট হাউজের বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন।

এলী বলেন, সাজেদার সঙ্গে আরও দুই-তিনজন ছিলেন। সাজেদা আমাদের পরিচয় জানতে চান। আমরা আমাদের পরিচয় দিয়ে তাকে বলি, আমরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাব। সাজেদা বলেন, ‘তিনি তো খুব ব্যস্ত আছেন। লোকজনের ভিড়। সামনের রুমে উনি আছেন। ঢুকে পড়ো।’

চার-পাঁচজন স্কুল ড্রেস পরা ছাত্রী বঙ্গবন্ধুর রুমে ঢুকে পড়ে।

এলী বলেন, “ঢুকতেই দেখলাম, বিছানায় কোলবালিশে হেলান দিয়ে পাইপ হাতে সবার সঙ্গে কথা বলছেন বঙ্গবন্ধু। আমরা ঢুকেই এক পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।  হঠাৎ বঙ্গবন্ধু আমাদের দিকে তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা কাকে চাও?’ উনি হেসে হেসে বললেন।

“বঙ্গবন্ধু আবার রসিকতা করে বললেন, ‘দেখ তো তোফায়েল, বঙ্গবন্ধু কোথায়?’ তখন আমি বললাম, ‘আপনিই তো বঙ্গবন্ধু।’ তখন তিনি আমাদের তার কাছে ডেকে নিলেন। আমরা তার কাছে গেলাম। তিনি বললেন, ‘বঙ্গবন্ধু মানে কী বল তো?’ বলে উনি আমাকে কাছে টেনে আদর করলেন। কী যে আনন্দ লাগছিল তখন তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। একে একে আমাদের নাম জিজ্ঞেস করলেন। তারপর আমি বললাম, ‘আমরা আপনার অটোগ্রাফ নেব।’ তিনি খুব মজা করে বললেন, ‘অটোগ্রাফ! অটোগ্রাফ কী?’ আমি বললাম, ‘আপনার সিগনেচার।’ অথচ আমার কাছে তখন কোনো খাতা বা কাগজ ছিল না। আমি এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি। তিনি তখন আমার ডান হাত টেনে হাতে লিখে দিলেন, ‘শেখ মুজিব।’ আমি সে লেখা ধরে রাখতে পারিনি। এত কাছে পেয়েও তার লিখিত স্মৃতি ধরে রাখতে পারিনি। তখন আবার পার্টির লোকজন তার সাথে দেখা করবে। ওখান থেকে কে যেন বললেন, ‘তোমরা বাইরে যাও।’ আমরা তখন বাইরে চলে আসলাম।’

এলী বলেন, তারা বাইরে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকার সময় সাজেদা চৌধুরীর সঙ্গে আবার তাদের দেখা হয়।

“তিনি (সাজেদা) আমাদের বললেন, ‘তোমরা গান জানো না? ওই যে, ওই গানটি- শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবুরের কণ্ঠ।’ আমরা বললাম. ‘হ্যাঁ, পারি।’ সাজেদা চৌধুরী আমাদের নিয়ে হাততালির সঙ্গে সঙ্গে তাল রেখে কিছু লাইন গাইলেন। আমরা তার সঙ্গে সঙ্গে গাইলাম। তারপর তিনি শিখিয়ে দিলেন, বঙ্গবন্ধু বাইরে এলে আমরা যেন গানটা গাই।”

বারান্দায় তারা আধা ঘণ্টার বেশি দাঁড়িয়ে থাকার পর আবার বঙ্গবন্ধুর দেখা পান।

এলী বলেন, “বারান্দায় আমরা দাঁড়িয়ে আছি আধ ঘণ্টারও বেশি হবে। বঙ্গবন্ধু পায়জামা-পাঞ্জাবির সঙ্গে মুজিব কোট, চশমা পরা। রুম থেকে বেরিয়ে জোরে জোরে হেঁটে আসছেন। তখন কে যেন বললেন, তোমরা শ্লোগান দাও, শ্লোগান দাও। আমি তখন হাত নেড়ে বঙ্গবন্ধুকে দেখা মাত্রই শ্লোগান দিলাম, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। আমার নেতা তোমার নেতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব,’ ইত্যাদি। শ্লোগানের লিড দিচ্ছিলাম আমি। বঙ্গবন্ধুর হাতে ফুলের তোড়া ছিল। তিনি একটি লাল গোলাপ ফুল আমাকে ছুঁড়ে দিলেন। আমরা দৌড় দিয়ে বাইরে চলে আসি। তার দেওয়া ফুল হাতে পেয়ে আমি খুশিতে আত্মহারা হয়ে যাই।

“বাইরে তখন জিলা স্কুলের ছাত্ররা ভিড় করেছে। আমি সার্কিট হাউজের দেয়ালের খাপ বেয়ে উপরে উঠি। অন্য সব ছাত্র-ছাত্রীও ওঠার চেষ্টা করছিল। আমি তখন প্রাণপণে শ্লোগান দিয়ে যাচ্ছিলাম, ‘আমার নেতা তোমার নেতা, শেখ মুজিব।’ আরও বিভিন্ন শ্লোগান। উনি তখন হাসছিলেন। আর ছাত্রদের বলছিলেন, ‘না, তোরা পারলি না। এর সাথে তোরা পারলি না।’ তিনি আমার মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে আদর করে বলছিলেন, ‘ঘেমে গেছিস তো। এবার থাম। আমাকে একটু বলতে দে।’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তোমরা পড়াশুনা করো। তোমরা সবাই মানুষ হও। এবার তোমরা বাড়ি যাও। জয় বাংলা’।”

এলীর কারণে কয়েকজন নেতা সেদিন রংপুরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলতে পারেননি বলে জানান এলী।

তিনি বলেন, “রংপুরের কিছু নেতা পরে আমাকে দেখে বলেছিলেন, ‘এই পিচ্চির জন্য আমরা কিছু বলতে পারলাম না।’ প্রায় আধা ঘণ্টা আমরা বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে ছিলাম। পরে তিনি কালেক্টরেট মাঠে গেলেন। হেলিকপ্টার ওখানে থেমেছিল। আমরাও তখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কালেক্টরেট মাঠে গিয়েছিলাম। আমাদের স্কুলের অপজিটে। সেদিনের সেই অনুভূতি আমার মনে হলে আমি আজও সেই দিনটাতে চলে যাই। সেই মুহূর্তে আমি কতখানি আনন্দে কাটিয়েছিলাম! পরদিন সব পত্রিকার প্রথম পাতায় সার্কিট হাউজে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তোলা আমার ছবি ছাপা হয়েছিল। পত্রিকা দেখার পর খুবই ভাল লাগছিল।

“জাতির জনকের সংস্পর্শে আসার সেই দিনটির কথা, সেই দৃশ্য আজও চোখের সামনে ভেসে আছে। সে তো ভুলবার  নয়।”

এলী সাজেদা চৌধুরীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, “তার সাহায্যেই আমরা সেদিন ভিতরে ঢুকতে সাহস পেয়েছিলাম।”

তখন রংপুর শহরে বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকতেন এলী। এখন রংপুর শহরেরই কামাল কাছনা মহল্লায় নিজেদের বাড়িতে স্বামীকে নিয়ে থাকেন।

তার স্বামী আশরাফ এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ব্রেন স্ট্রোক করার পর থেকে শয্যাশায়ী। তার স্মৃতিশক্তি লোপ পেয়েছে। বাড়িতে এলী একাই স্বামীসেবা করে সময় কাটান।

এলী বলেন, “সঞ্চিত যে অর্থ ছিল তা শেষ হয়ে গেছে স্বামীর চিকিৎসা করাতে গিয়ে। আমার আর কোনো উপায় নেই। অসুস্থ স্বামীর খরচ যোগাতে পারছি না।”

তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন।

এলী বলেন, “আমি আপনাদের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে একবার একটু সালাম করতে চাই। প্রধানমন্ত্রীকে বলব যে, ‘আমি সেই শিশুমেয়েটি, যাকে আপনার বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে স্নেহের পরশ দিয়েছিলেন।”