ইতিমধ্যে যেখানে প্রতিবাদী সমাবেশ, শোকসভা এমনকি দোয়া মাহফিলে পর্যন্ত সরকারের পুলিশ কিংবা অনুগত সুবিধাভোগী লোকজন হামলা চালিয়ে সব কিছু পণ্ড করে দিচ্ছিল সেখানে নিরস্ত্র কলম সৈনিকেরাও ছিল অসহায়। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে লেখক, কবি-শিল্পীরা সামনে আসতে শুরু করেন। এর আগের বছর ১৯৭৭ সালে বাংলা একাডেমির একুশের কবিতা পাঠের আসরে কবি নির্মলেন্দু গুণ, ‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি’ বলে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম প্রকাশ্য প্রতিবাদ করেছিলেন। এ বছরের বাংলা ছাত্র ইউনিয়নের একুশের স্মরণিকা ‘জয়ধ্বনি’ (১৯৭৭)-তে কবি কামাল চৌধুরীর বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে প্রথম কবিতা ‘জাতীয়তাময় জন্ম-মৃত্যু’ প্রকাশিত হয়। কবিতাটি লেখা হয়েছিল ৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৭ তারিখে। (সচিত্র বাংলাদেশ জুলাই-আগস্ট, ২০০৯)
আদমজী জুটমিলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও কামাল চৌধুরীর কবিতা
১৯৭৭ সালের ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে আদমজী জুট মিলের অফিসার্স কোয়ার্টারে ছেলেমেয়েদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ওই অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দুটি কবিতা পাঠ করেন তখনকার তরুণ কবি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কামাল আবদুল নাসের, যিনি এখন কবি কামাল চৌধুরী নামেই খ্যাত। পরবর্তী সময়ে তিনি বাংলাদেশ সরকারের মুখ্য সচিব হিসেবে অবসর নেন। অনুষ্ঠানে পঠিত কবিতা দুটির মধ্যে একটি তাঁর নিজের লেখা এবং আরেকটি কবি নির্মলেন্দু গুণের (‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি’)।
ওপরের তথ্যটি জানা যায়, বাংলাদেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদার এক লেখায়। ১৯৭৭ সালে তিনি ছিলেন আদমজী জুট মিলস এর ২ নম্বর মিলের সহকারী ব্যবস্থাপক। ওই সময় মিলের চীফ লেবার অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার অফিসার প্রয়াত আহমদ হোসেন চৌধুরী ছিলেন কামাল চৌধুরীর বাবা। স্বাধীনতা দিবসের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন কে এম নুরুল হুদা। তিনি জানাচ্ছেন, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বাংলাদেশে দঃসহ নিস্তব্ধতা নেমে আসে। তখন সামরিক শাসনের কারণে বঙ্গবন্ধুর নামও উচ্চারণ করা যেত না। সারা দেশের মানুষ আতঙ্কের মধ্যে বাস করছিল। ... আহমদ হোসেন চৌধুরীর মেজো ছেলে কামাল চৌধুরী তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তরুণ কবি হিসেবে তাঁর একটা পরিচিতিও তৈরি হয়েছে। ...সেই অনুষ্ঠানে আমরা কামালকে কবিতা পাঠের জন্য আমন্ত্রণ জানাই। কামাল মঞ্চে ঊঠে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে শ্রদ্ধা জানালেন এবং বললেন, ‘আজকে ২৬ মার্চ স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতাকে স্মরণ না করে কোনো অনুষ্ঠান হতে পারে না।’ একথা বলে কামাল নিজের লেখা একটি কবিতা এবং নির্মলেন্দু গুণের একটি কবিতা আবৃত্তি করলেন। ‘জয় বাংলা’ বলে কামাল কবিতা পাঠ শেষ করলেন।
কামালের বক্তব্য ও কবিতা পাঠের সঙ্গে সঙ্গে অনেকে ততক্ষণে আতঙ্কিত হয়ে অনুষ্ঠানস্থল থেকে চলে গেছে। কামাল এ অবস্থায় আবার মঞ্চে উঠে সবাইকে সাহস দিলেন। এবং সবার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আমি নিজ দায়িত্বে এ কবিতা পড়েছি, এতে কারো ভয়ের কোনো কারণ নেই। (বঙ্গবন্ধু হত্যা: আদমজী জুট মিলে প্রকাশ্য প্রতিবাদ; কালের কণ্ঠ, ১৫-০৮-২০১৯)
পঁচাত্তরের পরের সময়ে, ১৯৭৮ সালের একুশের সংকলন হিসেবে ‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়’ শিরোনামে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে একটি সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল উল্লেখযোগ্য কবি-ছড়াকারদের প্রচেষ্টায়।
এ বিষয়ে একটি তথ্যসমৃদ্ধ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় সচিত্র বাংলাদেশ জুলাই-আগস্ট ২০০৯ সংখ্যায়। ‘প্রথম প্রতিবাদী সংকলন’ শিরোনামে প্রতিবেদনটি এরকম:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সূর্য তরুণ গোষ্ঠী’র নামে এটি প্রকাশিত হয়। এটা নেপথ্যে সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন আলতাফ আলী হাসু এবং আবদুল আজিজ। গুণে গুণে ৩০ জন প্রবীণ-নবীন কবি ও ছড়াকার এই সাহসী কাফেলায় তাদের নাম লেখায়। পশ্চিম বাংলা থেকে অন্নদাশংকর রায় লিখে পাঠিয়েছিলেন একটি ছড়া, যা এই সংকলনেই প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল এবং পরে তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে জনপ্রিয় স্লোগানে পরিণত হয়েছিল। যে ৩০ জন কবি ও ছড়াকারের লেখা সংকলনে স্থান পেয়েছেন তারা হলেন :
১. অন্নদাশংকর রায়ের ছড়া (এটা ‘অন্নদাশংকর রায়ের ছড়া’ নামেই প্রকাশিত হয়েছিল) ২. দিলওয়ার- ছড়া (এটা ‘ছড়া’ শিরোনামেই প্রকাশিত হয়েছিল) ৩. হায়াৎ মামুদ- মুজিবের এপিটাফ ৪. রাহাত খান- যখন সময় হবে ৫. মাশুক চৌধুরী- চিৎকার ৬. ফরিদুর রহমান বাবুল ছড়া- সাম্প্রতিক ৭. সুকুমার বড়ুয়া- ৭ মার্চ ৮. মোহাম্মদ মোস্তফা- আবার আসে ‘বাং-কর্ণো ৯. মাহমুদুল হক- বকুল গন্ধ বাঘের চোখে ১০. আমিনুল ইসলাম বেদু- প্রণাম, তোমাকে বঙ্গবন্ধু ১১. নির্মলেন্দু গুণ- মুজিব মানে মুক্তি ১২. তুষার কর- বঙ্গবন্ধুর জন্যে ১৩. আলতাফ আলী হাসু- অঙ্গীকার ১৪. মোহাম্মদ রফিক- ব্যাঘ্র বিষয়ক ১৫. আবদুল আজিজ- সরম লাগার ছড়া ১৬. শান্তিময় বিশ্বাস- পিতার জন্য ১৭. আখতার হুসেন- সোনার বরণ ছেলে ১৮. ভীষ্মদেব চৌধুরী- পিতা: তোমার জন্যে ১৯. জিয়াউদ্দীন আহমদ- শেখ মুজিব
২০. জাহিদুল হক- গোলাপ ২১. ইউসুফ আলী এটম- ছবির ছড়া ২২. সিরাজুল ফরিদ- ছড়া (‘ছড়া’ নামেই এটি প্রকাশিত হয়েছিল) ২৩. ফজলুল হক সরকার- শেখ মুজিব ২৪. মহাদেব সাহা- আবার আসিব ফিরে ২৫. জাফর ওয়াজেদ- একটি মুজিব ২৬. লুৎফর রহমান রিটন- একটি ছেলের কথা ২৭. নূর-উদ্-দীন শেখ- সেই ছেলেটি ২৮. ওয়াহিদ রেজা- জাতির পিতা ২৯. কামাল চৌধুরী- একজন প্রেমিকের কথা ৩০. খালেক বিন জয়েনউদদীন- রাখাল রাজার জন্যে।
রাজনৈতিক কবিতায় সাধারণভাবে স্লোগান-রসের প্রাধান্য থাকে। কিন্তু পঁচাত্তর-উত্তর কবিদের এসব ছড়া ও কবিতায় আবেগের যে প্রাবল্য ঘটে তা যুগের দাবিকে তো পূরণ করেছিলই, সাথে সাথে তা হয়ে উঠলো কালজয়ী। কোনো কোনো ছড়া-কবিতার মাহাত্ম্য হৃদয়কে স্পর্শ করে। যেমন-
১.
যত দিন রবে পদ্মা মেঘনা
গৌরী যমুনা বহমান
তত দিন রবে কীর্তি তোমার
শেখ মুজিবুর রহমান।
[অন্নদাশংকর রায় : ছড়া]
২.
বঙ্গবন্ধু আট কোটি
খুলবে এবার দাঁত কটি!
[দিলওয়ার : ছড়া]
৩.
আমরাও বেঁচে থাকি স্মৃতি নিয়ে তোর
তোর রক্ত ফুল হবে, আঙিনায় ভোর।
[হায়াৎ মামুদ : মুজিবের এপিটাফ]
৪.
বঙ্গবন্ধু, আপনার যখন সময় হবে
এসে ডাক দেবেন, সবাই আছে
[রাহাত খান : যখন সময় হবে]
৫.
একদিন মনে হয়েছিল, আমার ভিতরে
একজন নেতা রক্তবীজের মতো ঢুকে গেছে।
আমি চিৎকার করে উঠলাম :
জয়বাংলা
[মাশুক চৌধুরী : চিৎকার]
৬.
বংশী বাদক বঙ্গবন্ধু
হারিয়ে গেছে ঠিক
সঞ্জীবনী বাঁশীর সে সুর
সাজছে সুনির্ভীক।
[ফরিদুর রহমান বাবুল : ছড়া : সাম্প্রতিক]
৭.
‘রক্ত দিলাম- রক্ত দেবো
মুক্তি আমার ছিনিয়ে নেবো’।
[সুকুমার বড়ুয়া : ৭ই মার্চ]
৮.
যেই ছেলেটি বাংলাদেশের দুর্গ গড়ে লক্ষ
ঘাতক এসে দীর্ণ করে তার সে বিশাল বক্ষ
[মোহাম্মদ মোস্তফা : আবার আসে ‘বাং-কর্ণো’]
৯.
মুজিব অর্থ আর কিছু না
মুজিব মানে রক্ত,
মুজিব আমার শক্তি সাহস
আমি মুজিব ভক্ত।
[নির্মলেন্দু গুণ : মুজিব মানে মুক্তি]
১০.
বাংলা জুড়ে আঁধার নামে কী হারালো কী?
হারিয়ে গেছে কাছের মানুষ, সোনার মানিকটি।
[তুষার কর : বঙ্গবন্ধুর জন্যে]
১১.
বাঙালির শুদ্ধ নাম শেখ মুজিবুর রহমান।
[মোহাম্মদ রফিক : ব্যাঘ্র বিষয়ক]
১২.
হঠাৎ রঙিন গোলাপ দেখে
মুজিব বলে ভুল করি
[জাহিদুল হক : গোলাপ]
১৩.
বুকের এই এ্যালবামে রক্ষিত ছবি এক
ভালো করে দেখে নিন, কোটি বুকে সবই ‘শেখ’
[ইউসুফ আলী এটম : ছবির ছড়া]
১৪.
আজকের কেন
বাপ মানি না যদিও তিনি জন্মদাতা বাপ
কেউবা বলেন জন্মদাতার নামটি বলাও পাপ।
[সিরাজুল ফরিদ : ছড়া]
১৫.
আবার আসিব ফিরে এই বাংলায়
কোনো শংখচিল নয়, শেখ মুজিবের বেশে
[মহাদেব সাহা : আবার আসিব ফিরে]
১৬.
যেই ছেলেটা শিখিয়ে ছিলো
কেমন করে বাঁচতে হয়
অস্ত্র দেখে ভয় না পেয়ে
মুক্তি নেশায় নাচতে হয়
[লুৎফর রহমান রিটন : একটি ছেলের কথা]
১৭.
একটি ছেলে দেশের প্রিয়, দেশকে ভালবাসতো
সেই ছেলেটির ডাকেই আবার সবাই ছুটে আসতো।
[নূর-উদ-দীন শেখ: সেই ছেলেটি]
১৮.
আর যদি ঐভাবে গুলি চলে একটা
লাথি মেরে শালাদের করে দেব চেপ্টা।
[ওয়াহিদ রেজা: জাতির পিতা]
১৯.
প্রগতির মিছিলে মিছিলে
আছে তাঁর অমর ভাষণ
পৃথিবীর ঘাস জুড়ে তাঁর সেই বজ্রকণ্ঠ জেগে থাকে
[কামাল চৌধুরী : একজন প্রেমিকের কথা]
২০.
ইকড়ি মিকড়ি চাম চিকড়ি কুতুর কুতুর ছা,
টুঙগি পাড়া শেখের বাড়ী উইড়া সেথায় যা।
সেই খানেতে রাখাল রাজার ছোট্ট কবরখানি,
সন্ধ্যে সকাল ঝরায় কেবল লক্ষ চোখের পানি।
[খালেক বিন জয়েনউদ্দিন: রাখাল রাজার জন্যে]
ছড়া-কবিতাগুলো শুধু আবেগকে প্রতিফলিত করেনি, এতে ভেসে এসেছে সেই সময়ের অবরুদ্ধ সমাজচিত্র, যখন বঙ্গবন্ধুর নামটি নেওয়া যেত না, ইতিহাস পালটে যাচ্ছিল, বাকস্বাধীনতা হারিয়েছিল সমগ্র বাংলাদেশ। ছড়া-কবিতাগুলোতে কোথাও সাবধানতার শব্দ চয়নে, কোথাও প্রতীকী শব্দে, কোথাও সরাসরি বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে, এখনো হচ্ছে, আরো লেখা হবে, কিন্তু বিদ্রোহী এই ‘প্রথম সংকলন’- ‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়’ অনন্য হয়ে থাকবে ইতিহাসে। এর রূপকাররা আজ অনেকেই জীবিত নেই, কিন্তু সেদিন যারা এর পরিকল্পনা করেছিলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে এভাবে প্রকাশ্যে কলমকে তলোয়ারের মতো উন্মোচিত করেছিলেন জাতি তাদের চিরদিন স্মরণ রাখবে।
এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা করা হয়েছে, ‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়’ ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম দালিলিক প্রতিবাদ। (সচিত্র বাংলাদেশ: জুলাই-অগাস্ট, ২০০৯)
লেখক: সম্পাদক-ইতিহাসের খসড়া, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণাকর্মী। প্রকাশিত গ্রন্থ ১০টি।