শনিবার সন্ধ্যায় সব বিভাগের সহকর্মীদের পাশে নিয়ে বর্ষপূর্তির কেক থেকে একটি অংশ কেটে নিয়ে তিনি বললেন, “এটা টোয়েন্টিফোর-সেভেন নিউজ রুম, কোনো ফুলস্টপ এখানে থাকবে না।”
এক সময় বিবিসিতে কাজ করা তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলছিলেন ‘নো ফুলস্টপ ইন ইনডিয়া’ নামের সেই বইটির কথা, যেটা লিখেছেন বিবিসির আরেক সাংবাদিক মার্ক টালি। যতিচিহ্নের সীমানা পেরিয়ে মানব জীবনের বাস্তবতার একগুচ্ছ প্রতিবেদন তিনি সেখানে লিখেছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক খালিদী যতিচিহ্ন ছেঁটে ফেলে সেই বার্তাকক্ষের দর্শনের কথা বললেন, যা বাহ্যিক কোনো চাপের কাছে শৃঙ্খলিত নয়, যা পরিচালিত হয় নৈতিক মানদণ্ডের ছক মেনে ।
“এই ১৫ বছর আসলে আমাদের মোটামুটি দীর্ঘ এক আনন্দ-বেদনার কাব্য। এই সময়ে আনন্দ ছিল, উৎসব ছিল, বিজয় ছিল। সেই সাথে আঘাত ছিল, আক্রমণ ছিল। আমরা অন্যায়ের শিকার হয়েছি। প্রতিবাদ করেছি। প্রতিহত করার চেষ্টা করেছি।
“বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিজয়ী হয়েছি। সেটা আমাদেরকে আরও শক্তিশালী করেছে। মনোবল বাড়িয়েছে।”
নির্ভিক প্রত্যয়ে, গৌরবের ১৫
শুরুটা হয়েছিল ২০০৫ সালের প্রথমার্ধে। অন্যান্য বার্তা সংস্থার মতো ‘বিডিনিউজ’ তখন সংবাদ মাধ্যমগুলোর জন্য খবর সরবরাহ করত। দেশের অন্য সংবাদ সংস্থাগুলো টেলিপ্রিন্টারে খবর সরবরাহ করলেও বিডিনিউজ কাজটি শুরু করে ইন্টারনেটের মাধ্যমে।
২০০৬ সালে বার্তা সংস্থাটির মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা বদলের পর এর খোল-নলচে বদলে যায়। সাংবাদিক তৌফিক ইমরোজ খালিদীর নেতৃত্বে নতুন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এ সংবাদমাধ্যমকে দেশের প্রথম ডটকম কোম্পানির রূপ দেয়। ২৩ অক্টোবর নতুন আঙ্গিকে শুরু হয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ২৪ ঘণ্টার পথচলা।
“শুরুই হয়েছিল আমাদের এমন যে, পাঠক সংখ্যার বিচারে, জনপ্রিয়তার বিচারে, বিশ্বাসযোগ্যতার বিচারে আমরা শুরুতেই বাংলাদেশে এক নম্বরে ছিলাম।”
তিনি বলেন, “সে সময় জাতীয় পর্যায়ে সংবাদ সংগ্রহ ব্যবস্থা হিসাবে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের মত আরেকটি নজির আছে বলে আমাদের জানা নেই।”
“অনেক সাহসের কাজ ছিল সেটা। অনেকে বলেছিলেন- ‘পাগলামি’। কিন্তু আমরা সফল হয়েছিলাম।”
২৩ অক্টোবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীই শুধু নয়, বাংলাদেশে ইন্টারনেট সংবাদপত্রেরও যাত্রা শুরুর দিন, বাংলাদেশে কোনো বার্তা কক্ষের ২৪ ঘণ্টা সচল থাকার সূচনা লগ্ন।
তিনি বলেন, “আমি ব্যাখ্যা করেছি। প্রতিনিয়ত আমরা উদ্ভাবন করেছি। রাজস্ব আহরণের চেষ্টা হয়েছে। কখনও সফল হয়েছি, কখনও ব্যর্থ হয়েছি।
“সেই সাথে একটা সমস্যা যেটা হয়েছে, তা হচ্ছে আমাদের সাফল্য অনেকে ভালোভাবে নেয়নি। অনেকে ঈর্ষার চোখে দেখেছে, পরাজিত করার চেষ্টা করেছে, আঘাত করবার চেষ্টা করেছে। অন্যায়ভাবে আঘাত করার চেষ্টা করেছে…। কিন্তু আমরা সব সময় ঘুরে দাঁড়িয়েছি। এর কৃতিত্ব দিতে হবে আমার বার্তাকক্ষের সহকর্মীদের।”
যাদের কঠোর পরিশ্রমে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম কোটি পাঠক, দর্শক, শ্রোতার আস্থার সংবাদমাধ্যম হয়ে উঠতে পেরেছে, তাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানান খালিদী।
দীর্ঘ অভিযাত্রায় নতুন অনেক মাইলফলক পেরিয়ে আসার কথা তিনি নবীন-প্রবীণ সহকর্মীদের মনে করিয়ে দেন প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে।
যে কোনো পরিস্থিতিতে সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশের যে নীতি নিয়ে ১৫টি বছর পেরিয়ে এসেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, সেই নীতি নিয়েই আগামীর পথে ছুটে চলার প্রত্যয় ঝরে তার কথায়।
তিনি বলেন, “আমাদের অজ্ঞানতা আছে, অশিক্ষা আছে, প্রশিক্ষণ ছাড়া লোকজন ভরে গেছে; সেই সাথে আছে দুর্বৃত্তপনা, কালো টাকার দৌরাত্ম্য।
“কেউ একজন ফেইসবুকে পোস্ট দিয়েছেন,... তারা আমাদেরকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। যেখানে বাংলাদেশের প্রায় পুরো গণমাধ্যম কালো টাকার উপর নির্ভরশীল, একটি গণমাধ্যম উদাহরণ তৈরি করেছে, কষ্ট করে হলেও টিকে আছে, যারা কালো টাকার উপরে নির্ভরশীল নয়।”
২০০৭-০৮ সালের সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে এবং পরে বিভিন্ন সময় অন্যায় চাপের মুখোমুখি হওয়ার কথাও অনুষ্ঠানে বলেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক।
“এদেশের গণমাধ্যমের ব্যবস্থাপনা এবং এর অর্থায়ন সম্পর্কে আপনাদের ধারণা নিশ্চয় আছে। আমরা তার ব্যতিক্রম ছিলাম। এই ব্যতিক্রম হওয়ার কারণে আমাদের সমস্যা হয়েছে। আমরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছি।
“এতোটাই সংখ্যালঘু, যে আমাদের পাশে দাঁড়ানোর দ্বিতীয় আরেকটি প্রতিষ্ঠান নেই। তারপরও আমরা টিকে থেকেছি। টিকে থাকবার চেষ্টা করেছি। এর কারণ হচ্ছে আমাদের বিপুল সংখ্যক পাঠক, দর্শক, শ্রোতা।”
মোবাইল ফোনে ব্রেকিং নিউজ সেবা এবং প্রথম বাংলায় এসএমএস সংবাদ সেবার পথিকৃত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
খালিদী বলেন, “আমরা অনেক কিছু প্রথম করেছি। সেটা শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বেও প্রথম। সেগুলো অনেক সময় অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে আমরা অব্যাহত রাখতে পারিনি।
“সেগুলো অন্যরা করেছে। অনেক সময় এমন হয়েছে যে আমাদের হাত-পা বেঁধে রাখা হয়েছে। হাত-পা বাঁধা অবস্থাতেও আমরা সাঁতরে টিকে থাকার চেষ্টা করেছি। আমরা ডুবে যাইনি। আমার ধারণা, আমরা ডুবে যাব না।”
তিনি বলেন, ”আমাদের হাত পা বাঁধা অবস্থায় সাঁতরাতে হয়েছে, এতে কার লাভ হয়েছে জানি না। আমি নিশ্চিত, এতে বাংলাদেশের সাংবাদিকতার লাভ হয়নি, সমাজের লাভ হয়নি, জনগণের লাভ হয়নি, রাষ্ট্রের লাভ হয়নি।”
পথচলার শুরু থেকে দেশে সাংবাদিকতার মৌলিক পরিবর্তনে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ‘উদাহরণ সৃষ্টিকারী’ ভূমিকার কথা তুলে ধরেন প্রধান সম্পাদক খালিদী।
স্পর্শকাতর তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে অন্তত দুই সূত্র থেকে নিশ্চিত হওয়া এবং নামহীন সূত্র ব্যবহার না করার যে চর্চা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম চালিয়ে আসছে, সে কথাও তিনি বলেন।
“অনেকে বলেছিলেন- ‘এটা সম্ভব নয় বাংলাদেশে। সেটা বিদেশে হতে পারে, বাংলাদেশে সম্ভব নয়।’ সেটা আমরা করে দেখিয়েছি।”
তিনি বলেন, মৌলিক এই পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় জল্পনা ও গুজবভিত্তিক সংবাদ প্রকাশ এবং গুজব সৃষ্টিতে সংবাদমাধ্যমের ব্যবহার অনেকটা বন্ধ করে দিতে পেরেছিল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
“তখন ‘বড় সংবাদমাধ্যম’ হিসেবে যেগুলো পরিচিত ছিল, মূলধারার সংবাদমাধ্যম হিসেবে পরিচিত ছিল, তারা বাধ্য হয়েছিল আমাদের সেই ধারা অনুসরণ করতে।”
আগামী দিনেও সেই ধারা অব্যাহত রাখার প্রত্যয় জানিয়ে তৌফিক ইমরোজ খালিদী হ্যালো ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের মাধ্যমেও নতুন নতুন সাংবাদিক তৈরিতে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, “সৎভাবে, নৈতিকভাবে, নীতিনিষ্ঠভাবে সাংবাদিকতা করা বাংলাদেশে এখনো সম্ভব। অনেক অবক্ষয় হয়েছে সমাজে, অনেক খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যাই আমরা, অনেক সমস্যা আছে এই সমাজে। তারপরেও কিন্তু অনেক ভালো মানুষ আছেন, অনেক ভালো কাজ করা হয়, অনেক উদ্ভাবনী শক্তি আছে মানুষের মধ্যে; তারপরও কিন্তু এদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়- অনেক দুর্নীতির মধ্যেও, অনেক দুর্বৃত্তায়নের মধ্যেও।”
“তারা জোট বেঁধে যখন আপনাকে আক্রমণ করে, আপনি তখন অসহায় বোধ করেন। কারণ তারা টাকা দিয়ে প্রভাব খাটিয়ে বা অন্য প্রভাব খাটিয়ে, কখনও কখনও রাজনীতিবিদদের ব্যবহার করে রাষ্ট্রযন্ত্রের বড় বড় গুরুত্বপূর্ণ অংশকে কিনে ফেলে, কখনও কখনও ব্যক্তিদের কিনে ফেলে।
“এবং এই ব্যক্তিরা রাষ্ট্রের পক্ষে কাজ না করে, সরকারের পক্ষে কাজ না করে, জনগণের পক্ষে কাজ না করে ওইসব দুর্বৃত্ত শ্রেণির পক্ষে কাজ করে- এতে আমাদের মত প্রতিষ্ঠানের সমস্যা তৈরি হয়।... এদের অনেকের জবাবদিহিতা নেই; বদনাম হয় যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করছে- তাদের।”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক বলেন, “আমরা এইখানে রুখে দাঁড়াবার চেষ্টা করছি। আমরা প্রতিবাদ করার চেষ্টা করছি, প্রতিহত করার চেষ্টা করছি। আমরা প্রতিবেদন তৈরি করার চেষ্টা করেছি, ছেপেছি। অনেক চাপ দেওয়া হয়েছে সেগুলো তুলে নেওয়ার জন্য।
“তারা অত্যন্ত শক্তিশালী। তারা রাষ্ট্রের বিভিন্ন যন্ত্রকে শুধু ব্যবহার করার যোগ্যতা রাখে না, অপব্যবহার করার যোগ্যতাও রাখে। অর্থের জোরে তারা রাজনৈতিক ক্ষমতা কিনে ফেলার চেষ্টা করে। আমাদের লড়াইটা চলছে এবং চলবে। আমরা হারতে রাজি নই।”
মহামারীর বদলে যাওয়া বাস্তবতায় গতবারের মত এবারও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর উদযাপন ছিল ঘরোয়াভাবে।
অন্য বছর সমাজের বিভিন্ন অঙ্গনের রথী মহারথীরা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আনন্দ উদযাপনে শামিল হন। এবারের ঘরোয়া আয়োজনে সেই আড়ম্বর না থাকলেও লাল-সাদায় সাজানো বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের বার্তাকক্ষে উদযাপন আর স্মৃতির সন্তরণে মিলেছিলেন সাবেক সহকর্মীদের অনেকে।
কেউ কেউ হাজির হয়েছিলেন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে। হ্যালো ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের শিশু সাংবাদিকদের কেউ কেউ বাবা-মাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিল।
আড্ডায়, গল্পে, ‘ফুলস্টপহীন’ এই বার্তাকক্ষ পরিণত হয় মিলন মেলায়। মুখরোচক খাবারে আপ্যায়নের সঙ্গে ছিল র্যাফেল ড্রর আয়োজনও।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ওয়েবসাইটের স্পটলাইটের আদল যখন চলে আসে ছবি তোলার ফ্রেম হয়ে, অনেকেই আনন্দ নিয়ে নিজের মুখাবয়ব ফুটিয়ে তোলেন সেই ‘স্পটলাইটে’।
১৫ বছরের রোমাঞ্চকর অভিযাত্রা আর আগামীর স্বপ্ন নিয়ে কেক কাটার আগ মুহূর্তে প্রজ্জ্বলিত মোমের দিকে তাকিয়ে তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেন, “অন্ধকার আসবে, আমরা আলো জ্বেলে দেব।”