একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর নিধনযজ্ঞের খবর বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দিয়ে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধুতে পরিণত হওয়া সায়মন ড্রিং চলতি শতকের গোড়ার দিকে একুশে টেলিভিশনে দায়িত্ব নিয়ে ফিরেছিলেন এই দেশে।
রয়টার্স, টেলিগ্রাফ ও বিবিসির হয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা ব্রিটিশ এই সাংবাদিক তরুণ এক ঝাঁক সাংবাদিক নিয়ে নতুন এক পথচলা শুরু করেছিলেন; তাদের মনে বাজছে ‘শিক্ষক’ হারানোর শূন্যতা।
প্রতিষ্ঠাকালে একুশের টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে সায়মন ড্রিংয়ের ভূমিকা তুলে ধরে কোম্পানির তৎকালীন যুগ্ম ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরহাদ মাহমুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সায়মন যে শুধু আমাদের পার্টনার ছিলেন, তা না, তিনি আমাদের পরিবারের একজন ছিলেন। আমি খুবই মর্মামত, খুবই আপসেট। তার হাত ধরেই একুশে টেলিভিশন একটি সফল ধারার সূচনা করতে পেরেছিল।”
একুশে টেলিভিশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এ এস মাহমুদের ছেলে ফরহাদ মাহমুদ বর্তমানে লন্ডনে থাকেন।
তখন সায়মন ড্রিংয়ের হাতেই সংবাদের ভিন্ন রকম উপস্থাপন ও নানা প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন যারা, তারাই এখন দেশের নানা টেলিভিশনে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছেন।
‘সায়মনের বুকে ছিল বাংলাদেশ’
বাংলাদেশের জন্য সায়মন ড্রিংয়ের অকৃত্রিম ভালোবাসার কথা বললেন একুশে টিভিতে তার সহকর্মী মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল।
একাত্তরে সায়মন ড্রিংয়ের ভূমিকার কথা স্মরণ করে জ্যেষ্ঠ এই সাংবাদিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তিনি বাংলাদেশকে ভালোবেসেছেন। তার বুকের মধ্যে ছিল বাংলাদেশ।”
“পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে সায়মনকে তাকে সম্মাননা জানানো হয়। সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেওয়া হয়।”
সায়মন ড্রিংকে বাংলাদেশের ব্রডকাস্ট জার্নালিজম বা সম্প্রচার সাংবাদিকতার ‘জনক’ অভিহিত করেন বুলবুল।
“কারণ, টেলিভিশনে যে সাংবাদিকতা করা যায়, একুশে টেলিভিশনের আগে বা সায়মন ড্রিংয়ের আগে বাংলাদেশে অন্তত কেউ বিশ্বাস করাতে পারত না।”
তিনি বলেন, “সায়মন ড্রিংয়ের নেতৃত্বে একুশে টেলিভিশন প্রমাণ করেছিল বাংলাদেশে সরকার নিয়ন্ত্রিত বেতার-টেলিভিশনের বাইরে স্বাধীন সাংবাদিকতা করা যায়। অত্যন্ত সৃজনশীলভাবে ও দক্ষতার সঙ্গে একুশে টেলিভিশনকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এতে একুশে টিভি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উপকৃত হয়েছে। আমাদের গোটা সাংবাদিকতাই উপকৃত হয়েছে।”
“আজকে আমাদের যেসব তরুণ, সাহসী সাংবাদিক সম্প্রচার মাধ্যমে দেখি, তার নেতৃত্বে ছিলেন সায়মন ড্রিং। তার কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে” বলেন তিনি।
‘শূন্যতা অনুভব করছি’
প্রিন্ট মিডিয়ায় এক দশক সাংবাদিকতা করে সায়মন ড্রিংয়ের নেতৃত্বে একুশে টেলিভিশনে যোগ দিয়েছিলেন মুন্নী সাহা, তিনি এখন এটিএন নিউজে প্রধান নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন।
মুন্নী সাহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কী শিখি নাই উনার কাছ থেকে? যেটুকু শিখে থাকি, ওইটুকু সায়মনের।.. সায়মনের জন্য এখন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।
সায়মন ড্রিংয়ের মৃত্যুতে স্মৃতিকাতর হয়ে মুন্নী সাহা বলেন, “[উনার মৃত্যু] এটা আমাজের জন্য মেনে নেওয়াটা আসলেই অত্যন্ত কঠিন। দূরে থাকা, জীবিত থাকা আর মারা যাওয়ার মধ্যে অনেক পার্থক্য। দূরে থাকলেও এক-দেড় মাস আগেও আমার একটা স্ট্যাটাস দেখে কমেন্ট করেছে। কুশল বিনিময়ও হয়েছে ইনবক্সে। কর্মক্ষেত্রে উনি সবাইকে পছন্দ করতেন। আর আমাকে দুষ্টুমি করে মুনি আপা বলতেন। আমিও সায়মনের সঙ্গে মজা করতাম।”
একুশে টেলিভিশনের পরে যমুনা টেলিভিশনে কাজ করার সময়েও সায়মন ড্রিংয়ের সঙ্গে নানা বিষয়ে অভিজ্ঞতা বিনিময় হয়েছে মুন্নী সাহার।
“উনার সঙ্গে এতে অভিজ্ঞতা! মৃত্যুর খবরটা শোনার পর খুব শূন্য লাগে। মনে হয় কী, আমরা আরও অনেক কিছু করতে চাই, কাজ করতে চাই। তাহলে আমরা কার কাছে জিজ্ঞেস করব?”
‘যেটুকু শিখেছি, উনার কাছেই’
একুশে টেলিভিশনে সায়মন ড্রিংয়ের হাত ধরে টেলিভিশন সাংবাদিকতা শুরু করেন শাহনাজ মুন্নী, তিনি এখন নিউজ টোয়েন্টিফোরের প্রধান বার্তা সম্পাদকের পদে রয়েছেন।
শাহনাজ মুন্নী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সায়মন ড্রিংয়ের অসাধারণ নেতৃত্ব গুণ ছিল। উনি নিউজ রুম লিডার। আমাদের প্রতিটি কাজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন; কীভাবে ভালো করা যাবে, কোথায় আরেকটু ভালো করা যেত, সব বলতেন।
“টেলিভিশন সাংবাদিকতায় যেটুকু শিখেছি, পুরোটাই আসলে উনার কাছ থেকে শেখা। একেবারেই হাত ধরে, হাতে-কলমে আমাদের শিখিয়েছেন।”
বাংলাদেশের টেলিভিশন সাংবাদিকতায় সায়মন ড্রিং ‘অমর’ হয়ে থাকবেন বলে মনে করেন শাহনাজ মুন্নী।
“বাংলাদেশে টেলিভিশন সাংবাদিকতার জনক বলে যদি কেউ থাকেন, তিনি সায়মন ড্রিং। যতদিন টেলিভিশন সাংবাদিকতা থাকবে, ততদিন আমরা সায়মন ড্রিংয়ের কথা মনে রাখব।”
‘তার শিক্ষা মনে রাখব আজীবন’
বর্তমানে এটিএন বাংলার প্রধান নির্বাহী সম্পাদক জ ই মামুন বাংলাদেশে পেশাদার টিভি সাংবাদিকতার শুরুর কৃতিত্ব সায়মন ড্রিংকেই দিচ্ছেন।
তিনি ফেইসবুকে লিখেছেন, “বিদায় সায়মন ড্রিং, বাংলাদেশের জন্মের বন্ধু, আমার পিতার অধিক পিতা! …২০০০ সালে তাঁর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় একুশে টেলিভিশন। তিনিই গড়ে তোলেন বাংলাদেশের প্রথম প্রজন্মের পেশাদার টিভি সাংবাদিকদের।
“আমি জীবনে যে ক’জন মানুষের কাছে চিরঋণী, সায়মন ড্রিং তাদের অন্যতম। তার মৃত্যুশোক আমার কাছে পিতৃশোকের সমান। তার স্নেহ, ভালোবাসা এবং শিক্ষা আমি আজীবন মনে রাখব।”
‘আমাদের এখানে পৌঁছনোর অবদান সায়মনের’
সময় টেলিভিশনের পরিচালক তুষার আবদুল্লাহ সাংবাদিক হিসেবে সায়মন ড্রিংয়ের দূরদর্শী দৃষ্টির কথা স্মরণ করছেন।
তিনি প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, “আজ আমরা যে জায়গায় আছি; গণমাধ্যমে আমরা যে জায়গায় রয়েছি, তা সায়মনের জন্য। সায়মনের কোচিং ছিল সংবাদকে কীভাবে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করতে হয়। সার্বক্ষণিক যে সংবাদের সঙ্গে থাকতে হয়, তা শিখিয়েছেন তিনি।
“একুশে টিভিতে যে দেশজুড়ে অনুষ্ঠান, তা বাংলাদেশিরা কিন্তু ভাবিনি; ভেবেছিলেন সায়মন। সংবাদ নিয়ে একেবারেই মানুষের কাছে যাওয়া, এই যে তৃণমূলে যাওয়া, গ্রামে যাওয়া, তা সায়মনের কাছ থেকে শিখেছি।”
“বিদায়ী অভিবাদন, সাইমন ড্রিং!” ফেইসবুকে লিখেছেন তুষার।
‘তার জন্য মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারা’
স্পিকআউটের নির্বাহী পরিচালক সুপন রায় ফেইসবুকে লিখেছেন, “কী করে মেনে নেব এ প্রয়ান? যার কারণে টুকটাক ইংরেজি শেখা, যার কারণে লন্ডনে লর্ডস মাঠে যেতে পারা| যার কারণে মাথা উঁচু করে পায়ের উপর দাঁড়াতে পারা …সেই মানুষকে হারিয়ে ফেললাম আজ চিরতরে| পরপারে আবার দেখা হবে Mentor|”
সাংবাদিক হিসেবে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে শিক্ষক হিসেবে সায়মন ড্রিংয়ের ভূমিকা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেছেন সুপন রায়। তিনি বলেছেন, তিনি আজ যে পর্যায়ে এসেছেন, তার পেছনেও রয়েছেন সায়মন ড্রিং।
‘দেশের সব খবরই ছিল তার নখদর্পনে’
দীপ্ত টিভির হেড অব নিউজ ইব্রাহিম আজাদ এক ফেইসবুক পোস্টে একুশে টিভির শুরুর দিনগুলো স্মরণ করেন।
তিনি লিখেছেন, “তার মতো একজন বিখ্যাত সাংবাদিকের সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়ে আমরা অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম।”
একটি শিফটে প্লানিং এডিটর হিসেবে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ইব্রাহীম আজাদ লেখেন, “অ্যাসাইনমেন্ট শিট নিয়ে সকাল ১০টার মধ্যে যেতাম সায়মনের রুমে। তারপর চা বা কফি খেতে খেতে বেশ কিছুক্ষণ আলোচনা। কোন অ্যাসাইনমেন্ট কিভাবে কাভার করতে হবে, তা নিয়ে থাকত দিক-নির্দেশনা। বাংলাদেশের সব খবরই ছিল তার নখদর্পনে। বাংলা পড়তে না পারলেও, বাংলা দৈনিকে কী কী গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ ছাপা হয়েছে, তাও বলতে পারতেন সায়মন!”
“সন্ধ্যা ৭টার বুলেটিনের পর নিউজরুমে এসে সবাইকে ধন্যবাদ জানাতেন ভালো বুলেটিন করার জন্য। একুশে টেলিভিশনের সেই দিনগুলো ছিল যেন স্বপ্নের মতো! …যা এখন অমলিন স্মৃতি হয়ে আছে…” লিখেছেন তিনি।