শ্রমিক বিক্ষোভের খবর প্রকাশ করায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের বিরুদ্ধে মামলা

নীলফামারীর উত্তরা ইপিজেডে শ্রমিক বিক্ষোভ, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার খবর প্রকাশ করায় ‘মানহানি’ হয়েছে দাবি করে দুই কোটি টাকা ‘ক্ষতিপূরণ’ চেয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের বিরুদ্ধে মামলা করেছে এভারগ্রীণ প্রোডাক্টস ফ্যাক্টরী বিডি লিমিটেড নামের এক কারখানার মালিকপক্ষ।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 March 2021, 03:47 PM
Updated : 4 March 2021, 04:18 AM

করোনাভাইরাসের মহামারীর মধ্যে গতবছর ২৭ জুন নীলফামারীতে ওই কারখানায় শ্রমিক বিক্ষোভ ও ভাঙচুরের ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশের মূল ধারার সব সংবাদমাধ্যমের মত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমও প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

জেলা পুলিশ, ইপিজেড কর্তৃপক্ষ এবং জেলা প্রশাসক সেদিন সেখানে ওই ঘটনা নিয়ে সাংবাদিকদের সামনে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তার ভিত্তিতেই ওই প্রতিবেদন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রকাশ করে। তাদের সেই বক্তব্যের ভিডিও বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলেও দেখানো হয়েছে।

কিন্তু এভারগ্রীণ কর্তৃপক্ষ এখন অভিযোগ করছে, ‘ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এবং সুনাম ক্ষুণ্ন করে ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত’ করার জন্য ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।

গতবছর জুন মাসের শেষে ওই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালতে মামলাটি দায়ের করে এভারগ্রীণ প্রোডাক্টস ফ্যাক্টরী বিডি লিমিটেড কর্তৃপক্ষ। আদালত সেই আর্জি গ্রহণ করে অভিযোগের বিষয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের বক্তব্য জানতে চেয়ে সমন জারি করে।

আদালতের আদেশের ওই নথি মার্চের শুরুতে হাতে পাওয়ার পর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম মামলার বিষয়টি জানতে পারে।

সেখানে বলা হয়, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদীকে ১৪ মার্চ আদালতে উপস্থিত হয়ে অথবা তার আইনজীবী বা প্রতিনিধির মাধ্যমে অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য এবং তার পক্ষে সাক্ষ্য-দলিল উপস্থাপন করতে হবে।

গতবছর ২৭ জুন নীলফামারীতে এভারগ্রীণ প্রোডাক্ট ফ্যাক্টরী বিডি লিমিটেড কারখানায় শ্রমিক বিক্ষোভ ও ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে

কী ঘটেছিল

এভারগ্রীণ প্রোডাক্টস ফ্যাক্টরী বিডি লিমিটেড নীলফামারীর উত্তরা ইপিজেডে তাদের কারখানায় পরচুলা উৎপাদন ও রপ্তানি করে আসছে। কয়েকজন শ্রমিককে ছাঁটাইয়ের অভিযোগে গত বছর ২৭ জুন ওই কারখানার কর্মীরা বিক্ষোভ করে এবং ব্যাপক তাণ্ডব চালায়।

প্রায় চার ঘণ্টার বিক্ষোভে পাঁচটি কভার্ডভ্যান, ১০টি মোটরসাইকেল এবং অফিসের কাগজপত্র ও কম্পিউটারে আগুন দেয় শ্রমিকরা।

ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট পরে সেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। জেলা প্রশাসক হাফিজুর রহমান চৌধুরী ঘটনাস্থলে গিয়ে শ্রমিকদের বুঝিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেন।

শ্রমিকদের বক্তব্য ছিল, বেপজার বিধি লঙ্ঘন করে ওই কারখানায় ‘কর্মী ছাঁটাই’ করার প্রতিবাদেই তারা বিক্ষোভে নেমেছেন। তবে অভিযোগের বিষয়ে এভারগ্রীণের কর্মকর্তারা কেউ সেদিন কথা বলেননি।

এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে উত্তরা ইপিজেডের জোনাল ম্যানেজার এনামুল হক সেদিন বলেছিলেন, “শ্রমিকদের দাবির বিষয়গুলো মালিকপক্ষের সঙ্গে কথা বলে সমাধান করা হবে। ইপিজেডে এই একমাত্র কোম্পানিতে সমস্যা আছে, অন্য কোম্পানিগুলো বেপজার আইন অনুযায়ী সবকিছু করে। এখানেই একটু সমস্যা আছে, আমি মনে করি এটা আলোচনা করে অবশ্যই সমাধান করা সম্ভব।”

তিনি আরও বলেন, “এরইমধ্যে প্রতিষ্ঠানের মালিক বিষয়গুলো পরিষ্কারভাবে ওয়ার্কারদের মাঝে তুলে ধরেছেন। উনি নিজে ক্ষমাও চেয়েছেন এবং বিষয়গুলো সমাধান করবেন বলে বলেছেন।”

জেলা প্রশাসক হাফিজুর রহমান চৌধুরী বলেছিলেন, “খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে একদিকে শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেছি। আরেক দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করা হয়েছে। সবাইকে নিয়ে মিনিমাইজ করার পর ওয়ার্কারা বাড়ি ফিরে ফিরে গেছেন। মালিক কর্তৃপক্ষ আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন ওয়ার্কারদের দাবিগুলো তারা বাস্তবায়ন করবেন।”

গতবছর ২৭ জুন নীলফামারীতে এভারগ্রীণ কারখানায় ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের ঘটনার পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন জেলা প্রশাসক হাফিজুর রহমান চৌধুরী

মামলা কেন?

এভারগ্রীণ কারখানায় বিক্ষোভের সেই ঘটনা নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম সেদিন যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে নিজস্ব কোনো অনুসন্ধান নেই।

বিক্ষোভরত শ্রমিক, জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও ইপিজেড কর্তৃপক্ষের বক্তব্যের ভিত্তিতেই তা প্রকাশ করা হয়েছে।

দেশের মূলধারার অন্যান্য সংবাদমাধ্যমও সেই খবর প্রকাশ করেছে এবং একই বক্তব্য তাদের প্রতিবেদনেও এসেছে। তাহলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের বিরুদ্ধে কেন ‘উদ্দেশ্যমূলক ও ষড়যন্ত্রমূলকভাবে’ সংবাদ প্রকাশের অভিযোগ আনা হল তা মামলার আর্জিতে স্পষ্ট নয়।

মামলার আর্জিতে বলা হয়েছে, “That in the said news the defendant publish that the plaintiff does not pay the salary of the employees which is completely false and fabricated as the plaintiff has been paying salary with all dues/facilities of the employees regularly. The plaintiff also has been providing health support including sanitizer, medicine, mask, hand gloves etc to its employees regularly during covid-19 pandemic.”

অথচ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, “এভারগ্রীণ প্রোডাক্টস ফ্যাক্টরী বিডি লিমিটেডের শ্রমিকদের অভিযোগ, বেপজার বিধি লঙ্ঘন করে মাঝে-মধ্যেই শ্রমিক ছাঁটাই করে কর্তৃপক্ষ। করোনাভাইরাসের এই সময়ে ছাঁটাইয়ের মাত্রা বেড়ে গেছে। অর্থ বাঁচাতে তারা দক্ষ শ্রমিক ছাঁটাই করে নতুন নিয়োগ করে। ছাঁটাই হওয়ারা অসহায় হয়ে কর্তপক্ষের শরণাপন্ন হলে তাদের নতুন শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দেয়, যাতে তারা মজুরি কম পান; নায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হন।

“তাদের অভিযোগ, করোনাভাইরাসের কারণে স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও সাবান সরবরাহ করেছে প্রতিষ্ঠান। এসব উপকরণের জন্য মাস শেষে বেতন থেকে প্রত্যেকের এক হাজার টাকা করে কেটে রেখেছে। এছাড়া অতিরিক্ত কাজের কর্মঘণ্টা কম দেখিয়ে মজুরি কম দেয়।”

আর উত্তরা ইপিজেডের জেনালের ম্যানেজার এনামূল হকও সেদিন বলেছিলেন, ইপিজেডে কেবল ওই কোম্পানিতেই ‘সমস্যা’ আছে, অন্য কোম্পানিগুলো বেপজার আইন অনুযায়ী সবকিছু করে।

অথচ এভারগ্রীণ কর্তৃপক্ষ এখন তাদের মামলায় দাবি করছে, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে ওই খবর প্রকাশিত হওয়ায় তাদের বিরাট ব্যবসায়িক ক্ষতি হচ্ছে, যার আর্থিক পরিমাণ ‘মাসে ২ কোটি টাকা’।

একটি ঘটনা, যার সংবাদ মূলধারার অধিকাংশ সংবাদমাধ্যমে এসেছে, সেই সংবাদ প্রকাশ করায় কেন, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দোষারোপ করা হচ্ছে, তা জানতে এভারগ্রীণ কারখানার মহা ব্যবস্থাপক শামীম উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।

তবে তিনি নিজে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করে কোম্পানির আইনি বিষয় দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, “আমি তাকে বলে দিচ্ছি, তিনি আপনাকে ফোন করবেন।”

কয়েক ঘণ্টা পর এভারগ্রীণের সহকারী ব্যবস্থাপক মো. জাহাঙ্গীর আলম ফোন করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের প্রশ্ন শুনতে চান। বলার পর তিনি বলেন, তার সামনে কাগজপত্র নেই। সন্ধ্যা ৬টায় আবার ফোন করবেন।

কিন্তু সন্ধ্যার পরও তার সাড়া না পেয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষ থেকে কয়েক দফা ফোন করে তার নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।