জালিয়াতির মাধ্যমে ‘কপিরাইট লঙ্ঘনের’ অভিনব অভিযোগ

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিবেদন ছবিসহ হুবহু কপি করে পুরনো তারিখ দিয়ে তথাকথিত ব্লগসাইটে প্রকাশ করে উল্টো বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের বিরুদ্ধে কপিরাইট লঙ্ঘনের অভিযোগ করা হয়েছে সার্ভার ব্যবস্থাপনাকারী কর্তৃপক্ষের কাছে।

হাসান বিপুলবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Jan 2021, 05:29 PM
Updated : 2 Jan 2021, 05:00 AM

সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে কাজ করেন, এমন একজন বিশেষজ্ঞ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, এমন হতে পারে যে কেউ চাইছে, ওই প্রতিবেদনগুলো আর দেখা না যাক, সে কারণে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে মিথ্যা অভিযোগ করেছে। 

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের একজন মুখপাত্র বলেন, “গত দশ দিনের মধ্যে এরকম দুটো ঘটনা ঘটেছে। দুটো ক্ষেত্রেই আমরা সার্ভার ব্যবস্থাপনাকারী কোম্পানিকে জানিয়ে দিয়েছি, ওই দাবি মিথ্যা এবং অভিযোগকারী নিজেই কনটেন্ট চুরি করে কপিরাইট লঙ্ঘন করেছে।”

গত ২৯ ডিসেম্বর সার্ভার ব্যবস্থাপনাকারী কোম্পানিকে মেইল পাঠিয়ে সর্বশেষ অভিযোগটি করেন মাসুদ আলম নামের এক ব্যক্তি, যিনি educationbangla.xyz নামে একটি ব্লগ সাইট চালান বলে সেখানে উল্লেখ করা হয়।

তিনি দাবি করেন, ‘বেস্ট হোল্ডিংসে সরকারি ব্যাংকের বিনিয়োগ কেন, জানতে চায় মন্ত্রণালয়’ শিরোনামে ২২ ডিসেম্বর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি তার ওই ব্লগ সাইটে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯ ডিসেম্বর। এর একটি লিংকও তিনি অভিযোগের সঙ্গে দিয়েছেন।

ওই লিংকে গেলে দেখা যায়, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত প্রতিবেদনটিই সেখানে ১৯ ডিসেম্বরের তারিখ দিয়ে ‘মাসুদ আলমের ব্লগ’ হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে, এমনকি ছবিটিও এক।    

কিন্তু তার ওই অভিযোগ যে মিথ্যা, তার প্রমাণ ওই প্রতিবেদনের প্রথম তিন প্যারার মধ্যেই রয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা ছিল-

রাষ্ট্রায়ত্ত চারটি ব্যাংক ৬৫ টাকা দরে শেয়ার কিনে ঢাকার পাঁচ তারকা হোটেল লো মেরিডিয়ানের পরিচালনাকারী কোম্পানি বেস্ট হোল্ডিংস লিমিটেডে যে বিপুল অংকের অর্থ বিনিয়োগ করেছে, তার ‘যৌক্তিকতা’ জানতে চেয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।

সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী/ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে বেস্ট হোল্ডিংসে বিনিয়োগ অনুমোদনের ক্ষেত্রে পরিচালনা পর্ষদের সভার কার্যবিরণী এবং বিনিয়োগ ধারাবাহিকতার পরিপূর্ণ চিত্রও জানতে চাওয়া হয়েছে।

মঙ্গলবার আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের বিএসইসি ও বিআইসিএম শাখা থেকে সিনিয়র সহকারী সচিব সিদ্দিকুর রহমানের স্বাক্ষরে ওই চিঠি ব্যাংকগুলোতে পাঠানো হয়।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ওই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছিল আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ওই চিঠির ভিত্তিতে, যা ২২ তারিখই পাঠানো হয়েছিল। সেদিন ছিল মঙ্গলবার এবং বাংলাদেশের অন্যান্য সংবাদমাধ্যম সেদিনই এ বিষয়ে সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। 

অথচ অভিযোগকারী মাসুদ আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিবেদনের হুবহু সবকিছু ছাপিয়ে দিয়ে দাবি করেছেন, তার ওই ব্লগ প্রকাশিত হয়েছে ১৯ ডিসেম্বর, যখন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে ওই চিঠি পাঠানোই হয়নি।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের স্ক্রিনশট
কথিত ব্লগসাইটে হুবহু তুলে দেওয়া হয়েছে সব কিছু, শুধু বসানো হয়েছে নাম আর পুরনো তারিখ

এ বিষয়ে জানতে চাইলে তথ্যপ্রযুক্তি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ফাইবার অ্যাট হোমের প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা সুমন আহমেদ সাবির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, যে কোনো ওয়েবসাইটের কনটেন্ট কোনো সার্ভারে হোস্ট করতে হয়। সাইটটি যদি প্রথম সারির কোনো হোস্টিং সার্ভিস থেকে সেবা নিয়ে থাকে, তাহলে ওই প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করলেই ওই পেইজটির 'ফাইল ক্রিয়েশন ডেট' বের করা সম্ভব।

“কিন্তু কেউ যদি নিজেই একটি সার্ভার বসিয়ে নেন তাহলে তিনি তার সাইটে সাংবাদটি প্রকাশের তথ্য হিসেবে যে কোনো তারিখ বসিয়ে দিতে পারেন এবং তিনি না চাইলে আপনি ওই ফাইল ক্রিয়েশনের তারিখ দেখতে পারবেন না।”

এখন কোনো একটি নির্দিষ্ট সংবাদ প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে এভাবে জালিয়াতির মাধ্যমে কপিরাইট লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে কার কী লাভ হতে পারে?

সুমন বলেন, “টেকনিক্যালি বললে, এমন কাজ করা সম্ভব… ধরুন কেউ একজন আপনার সংবাদ পছন্দ করছেন না বা তিনি চান না সংবাদটি প্রকাশিত অবস্থায় থাকুক। তখন নিজস্ব সার্ভারে সাইট হোস্ট করে আপনাদের সংবাদ হুবহু কপি করে সেখানে তার সংবাদ প্রকাশের সময় হিসেবে পুরনো তারিখ বসিয়ে দিতে পারেন।

“তারপর আপনার সাইটের হোস্টিং সেবার কাছে কপিরাইট নিয়ে অভিযোগ জানাতে পারে এবং তাদের মাধ্যমে আপনার ওপর চাপ দিতে পারে যেন সংবাদটি সরিয়ে ফেলা হয়। আর সেটা যদি করা সম্ভব হয়, তখন তাদের নিজেদের সাইট থেকে ওই কপি করা সংবাদটি সরিয়ে ফেললেই হল।”

ঢাকার পাঁচ তারকা হোটেল লো মেরিডিয়ানের পরিচালনাকারী কোম্পানি বেস্ট হোল্ডিংস লিমিটেডে সম্প্রতি নিয়ম এড়িয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে সরাসরি তালিকাভুক্তির মাধ্যমে ২৮৩ কোটি টাকা তোলার আবেদন করলে আইনি প্রশ্ন তুলে তা আটকে দেয় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন।

নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওই পদক্ষেপ এবং পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, যার মধ্যে একটি নিয়ে ‘কপিরাইট লঙ্ঘনের’ মিথ্যা অভিযোগ তুলেছেন ‘মাসুদ আলম’ নাম ব্যবহারকারী ওই ব্যক্তি।

মাসুদ আলমের সেই ব্লগ সাইটে গিয়ে দেখা যায়, সব মিলিয়ে সেখানে মোট ১১টি পোস্ট আছে, যার প্রথমটি তারিখ দেওয়া হয়েছে ১ ডিসেম্বর ২০২০।

আর যে সংবাদমাধ্যমটির বিরুদ্ধে ওই মিথ্যা অভিযোগ করা হয়েছে, সেই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলা হয় বাংলাদেশে ডিজিটাল সংবাদ সেবার পথিকৃৎ। গত ১৪ বছরে পাঠকের সবচেয়ে আস্থার সংবাদ উৎসে পরিণত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।

অভিযোগকারী মাসুদ আলমের কথিত ব্লগসাইট educationbangla.xyz এর নামে একটি ফেইসবুক পেইজ পাওয়া যায়। গত ১৭ নভেম্বর খোলার পর সেখানে কোনো ব্লগ বা অন্য কোনো পোস্ট দেওয়া হয়নি।

ওই ফেইসবুক পেইজে একটি ফোন নম্বরও দেওয়া আছে। শুক্রবার বিকালে ওই নম্বরে ফোন করলে এক ব্যক্তি ধরেন। তিনি বলেন, তার নাম জিল্লুর রহমান এবং এই ফোন নম্বরটি তার।

জিল্লুর রহমান দাবি করেন, তিনি কৃষিকাজ করেন এবং থাকেন রায়গঞ্জে। মাসুদ আলম এবং এডুকেশন বাংলার বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “আপনার কথা আমি কিছু বুঝতে পারছি না।”

educationbangla.xyz এর নামে সেই ফেইসবুক পেইজ

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের মুখপাত্র বলেন, “আমাদের প্রায়ই উদ্দেশ্যমূলকভাবে ইমেইলে বিভিন্ন ‘লিগ্যাল নোটিস’ পাঠানো হয় যুক্তরাষ্ট্র কিংবা পশ্চিমা কোনো দেশের কোনো আইনজীবীর নাম দিয়ে। প্রভাবশালী ব্যক্তিদের, বিশেষ করে ব্যবসায়ীদের বিষয়ে বিভিন্ন সংবাদ প্রতিবেদন তুলে ফেলতে বলা হয়। ওই ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নিয়ন্ত্রক সংস্থার পদক্ষেপ বা আইনি ব্যবস্থার ভিত্তিতে প্রকাশিত ওইসব প্রতিবেদনের কোনো কোনোটি বহু বছরের পুরনো, কোনোটি আবার সাম্প্রতিক। তারা এগুলো সরাতে চায়, কারণ তারা মনে করে এসব প্রতিবেদন ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবে থাকলে তাদের ক্ষতি হতে পারে।   

“কখনও কখনও তারা মৌখিকভাবে অনুরোধ করে ওইসব প্রতিবেদন সরিয়ে ফেলার জন্য। তাতে সাড়া না পেয়ে আইনি ব্যবস্থার হুমকি দিয়ে চিঠি পাঠায়। হুমকিতেও কাজ না হলে অনেক সময় তারা আমাদের প্রধান সম্পাদকের বিরুদ্ধেও অবাস্তব সব মিথ্য অভিযোগ ইন্টারনেটে ছড়াতে থাকে, যেগুলো রীতিমতো মানহানিকর।”

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের স্ক্রিনশট
কথিত ব্লগসাইটে হুবহু তুলে দেওয়া হয়েছে সব কিছু, শুধু বসানো হয়েছে নাম আর পুরনো তারিখ

‘অভিষেক চক্রবর্তী’ নামে এক ব্যক্তির পক্ষ থেকে আরও একটি অভিযোগ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সার্ভার ব্যবস্থাপনাকারী কোম্পানির কাছে পাঠানো হয় গত ২১ ডিসেম্বর।

সেখানে দাবি করা হয় ‘Why Bashundhara Group chief's son acquitted of Sabbir murder charge: HC’ শিরোনামে ২০১৬ সালের ১১ এপ্রিল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি তার নিজের নামের ব্লগসাইট avishekchakraborty.com এ প্রকাশিত হয়েছিল ২০১০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি।

এক্ষেত্রেও অভিযোগকারীর জালিয়াতির প্রমাণ রয়ে গেছে তার কাজের মধ্যেই।

প্রতিবেদনের শুরুর দুই প্যারায় বলা হয়েছে-

The High Court has asked why the verdict acquitting Bashundhara Group chief’s son Shafiyat Sobhan Sanvir and four others of charges of murdering Humayun Kabir Sabbir, a director of a concern of the conglomerate in 2006, should not be overturned.

The court issued the rule on Sunday on hearing a petition filed by the State challenging the 2011 verdict.

অর্থাৎ, অভিষেক চক্রবর্তী নামধারী ওই ব্যক্তি দাবি করছেন, ২০১১ সালে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের একটি রায় চ্যালেঞ্জ করে রাষ্ট্রপক্ষের রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে হাই কোর্ট যে রুল জারি করেছে, সেটি তিনি প্রকাশ করেছেন ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে!

তার ওই কথিত ব্লগসাইটে পোস্ট আছে সাকুল্যে চারটি, তার মধ্যে তিনটিই বিভিন্ন অনলাইন সংবাদমাধ্যমের সংবাদ প্রতিবেদন থেকে হুবহু কপি করে ছবিসহ চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে দুটি ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে দশ বছর আগের তারিখ, যখন ওই ঘটনাই ঘটেনি।