করোনাভাইরাসের ধাক্কা গণমাধ্যমেও

যুদ্ধ থেকে শুরু করে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ধকল গেলেও যেভাবে কাজ করে গেছে গণমাধ্যম, সেই গণমাধ্যমের কাজের ধরন অনেকটাই বদলে দিয়েছে অতিক্ষুদ্র এক জীবাণুর সংক্রমণ।

রিয়াজুল বাশারও ফয়সাল আতিকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 March 2020, 06:27 PM
Updated : 30 March 2020, 07:26 PM

নভেল করোনাভাইরাস নামের এই জীবাণু বিশ্বে মহামারী সৃষ্টি করার পর বাংলাদেশেও লেগেছে তার ধাক্কা। ৪৯ জনের আক্রান্ত হওয়া এবং ৫ জনের মৃত্যু সংখ্যার বিচারে কম হলেও আতঙ্ক কম ছড়ায়নি।

এই ধাক্কা সামলাতে না পেরে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকেই মুদ্রিত সংবাদপত্র বন্ধ হওয়ার খবর আসছে। টেলিভিশন ও অনলাইন সংবাদপত্রগুলো চালু থাকলেও কাজের ধারায় এনেছে ব্যাপক পরিবর্তন।

সার্বিকভাবে দেশের সংবাদ মাধ্যমের কাজের পরিবেশে এমন পরিবর্তন আগে কখনও দেখেনি বাংলাদেশের গণমাধ্যমকর্মীরা।

জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি সাইফুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সবকিছু মিলেই কিন্তু এখন গণমাধ্যম দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে এবং অর্থনৈতিক ভিত্তির ক্ষেত্রে কিন্তু ক্রমশই দুর্বল হয়ে পড়ছে। কঠিন একটা সময়ে মধ্য দিয়ে এখন গণমাধ্যম চলছে।”

বাংলাদেশে কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হওয়ার পর ভাইরাসের ব্যাপক বিস্তার রোধে অন্য দেশগুলোর মতোই লম্বা ছুটি ঘোষণা করে সরকার; ২৬ মার্চ থেকে শুরু হয়েছে এই ছুটি, এই সময় সবাইকে বলা হয়েছে সংক্রমণ এড়াতে ঘরে থাকতে।

এই পরিস্থিতিতে বদলে যায় গণমাধ্যমকর্মীদের কাজের ধরন।

সোমবার সন্ধ্যায় কথা হয় দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি দৈনিকের এক জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকের সঙ্গে। সারাদিন তিনি খবরের পেছনে ছোটেন বিরামহীনভাবে। কিন্তু এখন বাসায় বসে। যতটুকু পারা যায়, বাসা থেকেই প্রতিবেদন করছেন।

“নিজের জন্য না হোক, আক্রান্ত হলে আশপাশের মানুষগুলোও তো ঝুঁকিতে পড়তে পারে, সেজন্যই ঘরে থাকা। বাসা থেকে যতটুকু পারা যায়, ততটুকু করছি। আর অফিসও তো ফাঁকা,” বলেন তিনি।

প্রায় সবগুলো মুদ্রিত সংবাদপত্রের চিত্র একই। আগে ঘটনা ঘটলেই প্রতিবেদক বা আলোকচিত্র সাংবাদিকদের ঝাঁপিয়ে পড়ার যে চিত্র, ছিল তাও সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ সম্মেলনগুলোও হচ্ছে অনলাইনে।

দৈনিক সমকালের স্টাফ রিপোর্টার মিরাজ শামস বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে অধিকাংশ কর্মীকেই হোম অফিস বা বাসায় বসে কাজ করতে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আমি নিজেও বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া বের হচ্ছি না। বাসায় বসেই অফিসের কাজগুলো করছি।

“ব্যবসা বাণিজ্য ও নিত্যপণ্যের বাজার পরিস্থিতি নিয়ে কাজ করার কারণে মাঝে মধ্যে বাসা থেকে বের হতে হচ্ছে। আবার বাণিজ্য বিষয়ক পাতা বের হচ্ছে- তার জন্য অফিসেও একবার যেতে হচ্ছে। অফিসেও আগের মতো জনসমাগম নেই।”

করোনাভাইরাস মহামারীর এই সময়ে উপস্থিতি কমিয়ে ফেলেছে টেলিভিশনগুলো

টেলিভিশনে ফুটেজ সংগ্রহের একটি বিষয় থাকে, সেগুলো সম্পাদনা করে সম্প্রচারের জন্যও কর্মীর দরকার হয়। তাই তাদের লোকবলের প্রয়োজন হয় বেশি।  

একটি বেসরকারি টেলিভিশনের একজন প্রতিবেদন বললেন, তাদের এখন টানা তিন দিন অফিস করার পর টানা তিন দিন ছুটি।

অবশ্য সব টেলিভিশনের চিত্র এমন নয়, সুবিধা মনে করে একেক টিভি একেক কর্মপদ্ধতি ঠিক করেছে।

সময় টেলিভিশনের বার্তা প্রধান তুষার আব্দুল্লাহ বিডিনিউজ টোযেন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “থেমে থাকার সুযোগ নেই, খবরটা তো জানাতে হবে। আমরা বিভিন্ন বিভাগে ১২ ঘণ্টা (রোটেশন) করে কাজ করছি। যারা আজ কাজ করছে পরদিন তাদের ছুটি।”

তুষার আব্দুল্লাহর ভাষায়, সময় টেলিভিশনের সংবাদকর্মীরা স্বাস্থ্যগত যে সুরক্ষা তা নিয়েই তারা কাজ করছেন।

“আমরা খুবই গর্বিত যে, তারা সাধারণ মানুষের কাছে গিয়ে কাজ করছে। আমাদের পক্ষ থেকে যতটা সম্ভব, একেবারে গণপরিবহনে উঠতে না দেওয়া, অফিসে নিয়ে আসা, পৌঁছে দেওয়া, অফিসের ভেতরের সুরক্ষা দেওয়া, সেগুলো আমরা করছি।”

গণপরিবহনে চলাচল সব গণমাধ্যম থেকেই নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।

আবার সবার ঘরবন্দি অবস্থার মধ্যে অন্য সংবাদ হওয়ার মতো ঘটনাও কমেছে।

সচিবালয়, আদালত কার্যত বন্ধ, স্টক এক্সচেঞ্জ বন্ধ, রাজনৈতিক কোনো কর্মসূচি নেই, নেতাদের নিয়মিত বিবৃতি-ব্রিফিংও নেই, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও বন্ধ।

ফলে স্বল্প লোকবলেও এই সময়ে কাজ চালিয়ে নিতে তেমন অসুবিধা হচ্ছে না বলে গণমাধ্যমের বার্তা কক্ষগুলোর কর্মকর্তারা জানান।

মুদ্রিত সংবাদপত্র বড় সঙ্কটে

সঙ্কটের এই সময়ে দেশের বিভিন্নস্থান থেকে ছাপানো সংবাদপত্র বন্ধের ঘোষণা আসছে।

ঢাকা থেকে দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশিত মানবজমিন ও দেশকাল ঘোষণা দিয়েছে, তারা আপাতত ছাপা বন্ধ করে দিয়ে এখন শুধু অনলাইন সংস্করণ চালু রাখবে।

সিলেট, সুনামগঞ্জসহ অন্যান্য জায়গায় থেকেও খবর আসছে সেখানে ছাপা সংবাদপত্র বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।

নভেল করোনাভাইরাসের মহামারী রুখতে বিধিনিষেধের বেড়াজালে স্থবির জীবনে সংবাদপত্র বিক্রি ঢাকায় ৭৫ শতাংশের মতো কমেছে, চট্টগ্রামে কমেছে প্রায় ৯০ শতাংশ।

ঢাকা সংবাদপত্র হকার্স বহুমুখী সমবায় সমিতির মহা ব্যবস্থাপক মোবারক হোসেন টিটু সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই কয়দিনে পত্রিকার বিক্রি ৭৫ শতাংশ কমে গেছে। দায়িত্বশীল কোনো জায়গা থেকে এই পরিস্থিতি উত্তরণের উদ্যোগ না নিলে এই শিল্প বিলুপ্তির হুমকিতে পড়বে।”

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে ঢাকা থেকে প্রকাশিত বেশিরভাগ সংবাদপত্র তাদের পৃষ্ঠা সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি বাংলা দৈনিক ২৪ পৃষ্ঠার বদলে এখন ছাপছে ১২ পৃষ্ঠা।

ছাপা সংবাদপত্রের এই বিপর্যয়ের অনলাইন সংবাদপত্রের প্রতি মানুষের আরো আগ্রহ বাড়ছে।

প্রেস ক্লাবের সভাপতি সাইফুল আলম বলেন, “একটা নজিরবিহীন পরিস্থিতির মুখোমুখি আজকে সমগ্র বিশ্ব। আজকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে সংবাদকর্মীরা। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই চ্যালেঞ্জটা আরও গভীর এবং প্রকট।”

তিনি বলেন, “আমাদের নানামুখী চাপের মধ্যে সাংবাদিকতা করতে হয়। সেই ক্ষেত্রে এখন নতুন যে উপসর্গ দেখা গিয়েছে, আমার মনে হয় না এর চেয়ে বড় কোনো চ্যালেঞ্জ আমরা মোকাবেলা করেছি।

কীভাবে পাল্টে যাচ্ছে ছাপা সংবাদপত্রের চেহারা, তারও বর্ণনা দেন যুগান্তরের সম্পাদক সাইফুল আলম।

তিনি বলেন, “যুগান্তরের অনলাইনটা ভালোভাবে চালু রাখতে পেরেছি আমরা। প্রিন্ট মিডিয়ায় আমরা পৃষ্ঠাসংখ্যা কমিয়ে এনে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার সাধ্যমত চেষ্টা করছি। সেক্ষেত্রে রিপোর্টাররা দারুণ কাজ করছে। যতজন না হলেই নয়, ততজনকে দিয়ে আমরা কাগজটি বের করছি।

“কর্মরতদের অফিসে আসা-যাওয়াটাও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। গণপরিবহনের ব্যবস্থা নাই। সেক্ষেত্রে অফিস করাটাও তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সেদিকেও আমাদের খেয়াল রাখতে হচ্ছে। অফিস থেকে যতদুর সম্ভব স্বাস্থ্য সুরক্ষার উপকরণ সরবরাহ করছি।”

এছাড়া বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থাটাও গণমাধ্যমের জন্য বড় ধাক্কা বলে মনে করেন তিনি।

“সরকারি-বেসরকারি অফিস ছুটি হয়ে যাওয়ার কারণে বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের সরবরাহ লাইনটাও ভেঙে পড়েছে। শুধু পত্রিকা ছাপলেই হবে না। পাঠকের দোড়গোড়ায় পৌছে দিতে হয়। সেক্ষেত্রে অনেক হকার বাড়ি চলে গেছে। অনেক জেলায় এজেন্টরা কাগজ নিচ্ছে না।”

প্রিন্টিংয়ে অর্ধেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ছুটি দেওয়া হয়েছে জানিয়ে সাইফুল আলম বলেন, “মোবাইল ফোন ব্যবহার করতেন এরকম এক কোটি দশ লাখ মানুষ ঢাকা শহর থেকে বেরিয়ে গেছেন। এদের মধ্যে অনেকেই কাগজের পাঠক ছিলেন। সেক্ষেত্রে অনেক বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে।”

এই সংক্রান্ত খবর