বাংলাদেশে সংবাদপত্রের প্রচার সংখ্যা বাড়ার নেপথ্যে কী

অনলাইন গণমাধ্যমের প্রসারে বিশ্বব্যাপী ছাপানো সংবাদপত্রগুলোর প্রচার সংখ্যা দিন দিন কমছে, কিন্তু বাংলাদেশে সরকারি নথি দেখাচ্ছে ভিন্ন চিত্র।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকশহীদুল ইসলামবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Jan 2020, 04:07 PM
Updated : 12 Jan 2020, 04:07 PM

চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের (ডিএফপি) হালনাগাদ তথ্যে দেখা যায়, প্রচার সংখ্যার শীর্ষে থাকা সংবাদপত্রগুলোর প্রচার সংখ্যা তো কমেনি, বরং কয়েকটির বেড়েছে।

অথচ সংবাদপত্র মালিকরাই সরকারি বিভিন্ন সুবিধা চাওয়ার সময় বলে আসছেন, অনলাইনের প্রসারে ছাপানো সংবাদপত্র শিল্প হুমকির মুখে আছে। আবার সংবাদপত্রগুলোর কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করেই প্রচার সংখ্যার হিসাব দেখিয়েছে ডিএফপি। ফলে এই তথ্য নিয়ে দেখা দিচ্ছে প্রশ্ন।

প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান মুদ্রিত সংবাদপত্রের মালিকদের সংগঠন নোয়াবের সভাপতি হিসেবে ২০১৮ সালে এক প্রাক বাজেট আলোচনায় বলেছিলেন, “টিভি, অনলাইন ইত্যাদির কারণে এখন বিশ্বব্যাপী সংবাদপত্র পাঠক হারাচ্ছে। আমাদের হিসাব মতে, বিগত কয়েক বছরে ৫ থেকে ১০ শতাংশ হারে আমাদের পাঠক কমছে।”

এক বছর পর গত বছরের প্রাক বাজেট আলোচনাতেও তিনি বলেছিলেন, “সংবাদপত্রশিল্প সঙ্কটের মধ্য দিয়ে পার করছে। বিজ্ঞাপন থেকে আয় কমে যাচ্ছে। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও সংবাদপত্রের পাঠক কমে যাচ্ছে।”

অথচ ডিএফপির হিসাবে প্রথম আলোর পাঠক সংখ্যা কমেনি। এ বছরের ১ জানুয়ারির তালিকা অনুযায়ী, তাদের প্রচার সংখ্যা ৫ লাখ ১ হাজার ৮০০। দুই বছর আগেও ডিএফপি যে হিসাব দিয়েছিল, তাতেও প্রথম আলোর প্রচার সংখ্যা একই ছিল।

মজার বিষয় হচ্ছে, ডিএফপির হিসাবে শীর্ষে থাকা বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রচার সংখ্যায়ও দুই বছরে কোনো হেরফের হয়নি। দ্বিতীয় স্থানে থাকা প্রথম আলোর মতো বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রচার সংখ্যাও আগের মতোই ৫ লাখ ৫৩ হাজার ৩০০ই রয়েছে।

আরও মজার বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশ প্রতিদিন ও প্রথম আলোর পরের অবস্থানে থাকা কালের কণ্ঠ, যুগান্তর ও ইত্তেফাকের প্রচার সংখ্যাও হুবহু এক থেকে গেছে। দুই বছর আগে এই সংবাদপত্রগুলোর প্রতিটির প্রচার সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৯০ হাজার ২০০। দুই বছর পরও ওই তিনটি পত্রিকার প্রচার সংখ্যা হুবহু এক।

তবে ২০২০ সালে এসে আমাদের সময় ও জনকণ্ঠের প্রচার সংখ্যা বেড়ে কালের কণ্ঠ, যুগান্তর ও ইত্তেফাকের সমান অর্থাৎ ২ লাখ ৯০ হাজার ২০০টিতে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ শীর্ষ দুটির পর এখন পাঁচটি সংবাদপত্রের প্রচার সংখ্যা একই অঙ্কে।

ডিএফপির তথ্য অনুযায়ী, এর পরের অবস্থানে থাকা সমকালের প্রচার সংখ্যা এখন ২ লাখ ৭১ হাজার, সংবাদের ২ লাখ ১ হাজার ১০০ এবং ভোরের কাগজ ও আমাদের নতুন সময়ের প্রচার সংখ্যা ১ লাখ ৬১ হাজার ১৬০ করে।

ইংরেজি দৈনিকগুলোর মধ্যে প্রচার সংখ্যায় শীর্ষে রয়েছে ডেইলি স্টার, ডিএফপির হিসাবে তাদের প্রচার সংখ্যা ৪৪ হাজার ৮১৪। এর পরের অবস্থানে থাকা ফাইনানশিয়াল এক্সপ্রেস ও ডেইলি সানের প্রচার সংখ্যা ৪১ হাজার। এর মধ্যে ডেইলি স্টারের প্রচার সংখ্যায় ২০১৮ সালের হিসাবের সঙ্গে কোনো হেরফের নেই।

তথ্য মন্ত্রণালয় এই সব সংবাদপত্রের প্রচার সংখ্যার যে তথ্য দিচ্ছে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে অনেকেরই

তথ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, সংবাদপত্রগুলোর কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই তারা প্রচার সংখ্যার হিসাব করেন, যদিও তাদের মধ্যেও সন্দেহ রয়েছে।

প্রচার সংখ্যা কীভাবে বাড়ছে- পত্রিকাগুলোর কর্তৃপক্ষকে সেই প্রশ্ন করা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ইসতাক হোসেন।

রোববার তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নে বলেন, “হঠাৎ বাড়ল (প্রচার সংখ্যা) কেন, সেই প্রশ্ন আমরাও করেছি। তারা বলেছেন, আগে সব জেলায় পত্রিকা পাঠানো হত না, এখন কম করে হলেও সব জেলায় বিক্রি করা হয়। সেই হিসেবে করে তারা সংখ্যাটা দেয়।”

 

পত্রিকার প্রচার সংখ্যা ঠিক আছে কি না-সেই জিজ্ঞাসায় তথ্য সচিব কামরুন নাহার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা খোঁজ নেব, যাচাই করব।”

চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের (ডিএফপি) হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশ থেকে মোট ৭০৬টি পত্রিকা প্রকাশিত হয়, এরমধ্যে ঢাকা থেকে ৩৬৫টি ও মফস্বল থেকে ৩৪১টি।

নেপথ্যে বিজ্ঞাপনের দর

প্রচার সংখ্যা বাড়ছে কেন- এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে তথ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকারি বিজ্ঞাপনের দর বাড়াতে এই কাজটি করা হয়।

মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোন পত্রিকার প্রচার সংখ্যা আসলে কত, সরকারের একটি কমিটি তা যাচাই করে সে অনুযায়ী ওই পত্রিকার জন্য সরকারি বিজ্ঞাপনের হার ঠিক করার কথা।

“প্রকৃত সত্যটা হচ্ছে- পত্রিকা কর্তৃপক্ষ প্রচার সংখ্যার যে তালিকা সরবরাহ করে, সেই তালিকা ধরেই ডিএফপি বিজ্ঞাপনের হার ঠিক করে দেয়। যাচাই-বাছাইটা হচ্ছে না। দীর্ঘদিন ধরেই এমনটা চলে আসছে।”

গত সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নোয়াবের কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক সভার পর পত্রিকার প্রচার সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। বর্তমান তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদও গত বছরের ৭ নভেম্বর পত্রিকার প্রচার সংখ্যা বেশি দেখিয়ে অতিরিক্ত সুবিধা নেওয়ার প্রবণতা বন্ধে নজরদারি বাড়ানো নিয়ে কথা বলেন।

ওইদিন তিনি বলেন, “মন্ত্রী হয়ে আমি দেখেছি, এমনও পত্রিকা আছে যার সার্কুলেশন ঢাকায় এক হাজার, সারাদেশে পাঁচ হাজার, অথচ সুবিধা নেওয়ার জন্য ঘোষণা দেয় দেড় লাখ।”

ডিএফপির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে দৈনিক সংবাদের প্রচার সংখ্যা ছিল ১ লাখ ২৭ হাজার, তখন এই পত্রিকায় সরকারি বিজ্ঞাপনের দর ছিল ৮৫৯ টাকা। ২০২০ সালে পত্রিকাটির প্রচার সংখ্যা ৭৪ হাজার ১০০ বেড়ে বিজ্ঞাপনের দর দাঁড়িয়েছে ৯০০ টাকা।

আমার সংবাদের প্রচার সংখ্যা দুই বছরে ৩৫ হাজার ১০০ বাড়ায় বিজ্ঞাপনের দর ৪৪ টাকা বেড়েছে। বণিকবার্তা, ইনকিলাব, বর্তমান, ভোরের ডাক, প্রতিদিনের সংবাদসহ বেশ কয়েকটি পত্রিকার প্রচার সংখ্যার বাড়ার ফলে সরকারি বিজ্ঞাপনের দরও বিভিন্ন অঙ্কে বেড়েছে।

ডিএফপির তথ্য বলছে, মানবকণ্ঠ, ইনকিলাব, প্রতিদিনের সংবাদ, বাংলাদেশের খবর, আমার সংবাদ, আমাদের অর্থনীতি, মানবজমিন, ভোরের ডাক, আমার বার্তা, আলোকিত বাংলাদেশ, ভোরের পাতা, নবচেতনা, ঢাকা প্রতিদিন, বর্তমান, মুক্ত খবরের প্রচার সংখ্যাও দেড় লাখের বেশি।

ফাইনানশিয়াল এক্সপ্রেস ও ডেইলি সানের পাশাপাশি কয়েকটি ইংরেজি দৈনিকের প্রচার সংখ্যা বাড়ায় সেগুলোর বিজ্ঞাপনের দরও বেড়েছে।

 

প্রচার সংখ্যা বিবেচনা করে কোন পত্রিকায় সরকারির বিজ্ঞাপনের দর কত হবে, তা ঠিক করা হয় বলে জানান চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ইসতাক।

তিনি বলেন, “প্রচার সংখ্যা বাড়লে বিজ্ঞাপনের দরটা বাড়ে।”

সংবাদপত্র কর্তৃপক্ষ তাদের প্রচার সংখ্যা নিয়ে সরকারকে যে তথ্য দেয়, তা যাচাই করা হয় কি না- এ প্রশ্নে ইসতাক বলেন, “তারা তো আরও বেশি চায়, আমরা যাচাই করি, সার্ভে করি। একটি কমিটি আছে তারা কথা বলে… রিজেনেবল একটা দেওয়া হয়। যদিও সবক্ষেত্রে সব ঠিক থাকে তা না, মোটামুটি দেওয়া হয়।”

পত্রিকাগুলোর প্রচার সংখ্যা বিশ্বাসযোগ্য মনে করেন কি না- এই প্রশ্নে সরাসরি উত্তর এড়িয়ে তিনি বলেন, “বিষয়টি বলা কঠিন। কারণ এটি আমার অফিস থেকে দিচ্ছে, আমি যদি বলি গ্রহণযোগ্য না … তবে আমরা দেখেশুনেই দিই।”

বিজ্ঞাপনের দরের সঙ্গে সংবাদপত্রগুলো সংবাদকর্মীদের জন্য ঘোষিত ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়ন করছে কি না, তাও সম্পর্কিত।

ঢাকার ১০২টি এবং মফস্বলের ৬১টিসহ মোট ১৮৮টি সংবাদপত্রের কর্তৃপক্ষ সরকারকে জানিয়েছে, তারা অষ্টম ওয়েজবোর্জ বাস্তবায়ন করেছে। এর মধ্যে ঢাকার ২৫টি ইংরেজি দৈনিকও রয়েছে। সরকারি হিসেবে অষ্টম ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়ন করেছে ২৬ দশমিক ৬৩ শতাংশ পত্রিকা।

তবে বিভিন্ন গণমাধ্যমের অনেক সংবাদকর্মীই বলছেন, অষ্টম ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়ন নিয়ে পত্রিকাগুলো সরকারের কাছে যে তথ্য হাজির করেছে, তার বেশিরভাগই ঠিক নয়। বিজ্ঞাপনের দর বাড়াতেই মিথ্যা তথ্য দিচ্ছে কর্তৃপক্ষ।

এ বিষয়ে সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন নিউজপেপার্স ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (নোয়াব) সভাপতি ও সমকালের প্রকাশক এ কে আজাদের সঙ্গে কথা বলতে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেননি।