‘শিশুদের সুরক্ষার কথা চাই ইশতেহারে, আচরণবিধিতে’  

নির্বাচন ঘিরে মিছিল-পথসভা, শোভাযাত্রাসহ ভোটের প্রচারে শিশুর ব্যবহার বন্ধে রাজনৈতিক দলগুলোকে আরও উদ্যোগী হওয়ার তাগিদ এসেছে এক গোল টেবিল আলোচনা থেকে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Dec 2018, 01:22 PM
Updated : 14 Dec 2018, 01:24 PM

আসন্ন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকায় প্রতিটি দল যাতে শিশুর অধিকার রক্ষার বিষয়টি দলের ইশতেহারে যুক্ত করে নেয় এবং নির্বাচন কমিশন যাতে ভোটের কাজে শিশুদের ব্যবহার বন্ধের বিষয়টি আচরণবিধিতে অন্তর্ভুক্ত করে- সে আহ্বানও জানিয়েছেন আলোচকরা। 

দেশে শিশু সাংবাদিকতার প্রথম সাইট হ্যালো শুক্রবার ‘রাজনীতিতে শিশুকে ব্যবহার: গণমাধ্যমের ভূমিকা’ শীর্ষক এই গোল টেবিল আলোচনার আয়োজন করে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা তাতে অংশ নিয়ে শিশুদের বিষয়ে আরও সচেতন হওয়ার, আরও নৈতিক আচরণ করার আহ্বান জানান রাজনীতিবিদদের প্রতি।      

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম কার্যালয়ে আয়োজিত এ গোলটেবিল আলোচনার সঞ্চালনায় ছিলেন হ্যালোর দুই শিশু সাংবাদিক রূপকথা রহমান ও সাদিক ইভান।

৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় একাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সারা দেশে চলছে প্রচারের উৎসব। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও সমর্থকদের অসহিষ্ণু মনোভাবের কারণে তা কখনও কখনও সহিংস হয়ে ওঠে।

এ অবস্থায় শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দল, প্রার্থী, ভোটার, গণমাধ্যম ও অভিভাবকের কী করা উচিত তা উঠে আসে আলোচকদের কথায়। 

তারা বলেন, শিশুরা রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে বেড়ে উঠবে। কিন্তু কোনোভাবেই তাদের ঝুঁকিতে ফেলা যাবে না, সহিংসতার মধ্যে ঠেলে দেওয়া যাবে না।

নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি নাসিমুন আরা হক মিনু বলেন, শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ হলেও তারা অবহেলিত। ভবিষ্যতের জন্য তাদের গড়ে তুলতে গণমাধ্যমকেও সুযোগ করে দিতে হবে।

“ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস সম্পর্কে তাদের জানাতে হবে। নৈতিকতা শেখানো, বিশেষ করে নারীকে শ্রদ্ধা করার বিষয়টি শেখাতে হবে, যাতে তারা ইভটিজিং বা অন্যান্য অনৈতিক বিষয়গুলো থেকে দূরে থাকে। শিশুকাল থেকেই যাতে তারা দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে পারে, সে শিক্ষা দিতে হবে”।

গণমাধ্যমে শিশুদের সংবাদ পরিবেশন বিষয়ক নীতিমালার নানা দিক এ আলোচনায় তুলে ধরেন জিটিভির প্রধান সম্পাদক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা।

তিনি বলেন, শিশুদের সংবাদ পরিবেশনে ন্যায্যতা বিবেচনা করে ছবি ও শব্দ ব্যবহার সচেতন হতে হবে গণমাধ্যমকে। নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে যারা রয়েছেন- প্রধান সম্পাদক, বার্তা সম্পাদক তাদের শিশুদের নিয়ে সংবাদ প্রচারে দায়িত্বশীল হতে হবে।

“নির্বাচনী প্রচারে শিশুদের ব্যবহার করা যাবে না। রাজনৈতিক প্রচারের সময় দলগুলো চিৎকার করে প্রচার চালায়, মাইক ব্যবহার করে, যা শিশুদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। শিশুদের পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটে। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আচরণবিধি প্রতিপালনে কঠোর হতে হবে নির্বাচন কমিশনকে।”

তিনি বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারে শিশুদের বিষয়টি রাখতে হবে। গণমাধ্যমকেও দায়িত্বশীল হতে হবে, দেখতে হবে তারা শিশুদের উপযোগী করে বলছে বা লিখছে কিনা। রাজনৈতিক দলগুলোকে সচেতন করার ক্ষেত্রেও গণমাধ্যমকে ভূমিকা নিতে হবে।”

দৈনিক সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি বলেন, শুধু শাস্তি বাড়িয়ে কাজ হয় না। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সচেতনতা। অপরাধের বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে পারলে শিশুদের ঝুঁকি থেকে রক্ষা করে নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত সম্ভব হবে।

ভোটের ডামাডোলের শুরুতেই মোহাম্মদপুরে দুই কিশোরের মৃত্যুর বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়ে ইনডিপেনডেন্ট টিভির প্রধান বার্তা সম্পাদক আশিষ সৈকত বলেন, “শিশুরা রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার হচ্ছে। মিছিলে-শোভাযাত্রায় সবখানে শিশুদের সম্পৃক্ত করা হচ্ছে।”

তিনি বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলো এখন তাদের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করছে। এখন তাদের চাপে রাখতে পারে গণমাধ্যম, যাতে রাজনীতিতে বা নির্বাচনী কাজে যেন শিশুদের ব্যবহার করা না হয়, এ বিষয়টি তারা যেন ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করেন।”

আশিষ সৈকত বলেন, ইশতেহারে শিশুদের জন্য কী থাকতে পারে- প্রতিটি গণমাধ্যম যদি এ বিষয়ে সংবাদ পরিবেশন করে, তাহলে তা সহায়ক হতে পারে। শিশুদের চাওয়া কী- তা নিয়ে প্রতিবেদনের পাশাপাশি জনপ্রতিনিধিদের প্রতিশ্রুতিও আদায় করতে হবে।

নির্বাচনী আইন-বিধিতে শিশুদের ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা না থাকার বিষয়টি তুলে ধরে আশিষ সৈকত বলেন, “ভবিষ্যতে আচরণবিধিতেও এ বিষয়ে সচেতনতামূলক ও বিধিনিষেধ রাখার সুপারিশ করা যেতে পারে।”

চ্যানেল আইয়ের বিশেষ প্রতিনিধি সোমা ইসলাম বলেন, “অনেক রাজনৈতিক দল শিশুকে ব্যবহার করছে। ভাড়া করে লোক সমাগম বাড়াচ্ছে। অনেক প্রার্থী তাদের প্রচারে শিশুদের রাখছে। ভোটকেন্দ্র পাহারা দেওয়ার কাজেও শিশুরা- কিশোর ও তরুণদের তারা ব্যবহার করতে পারে।”

আইনি অস্পষ্টতার বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, “ভোট যদি উৎসব হয়, তার পাশাপাশি কিন্তু সহিংসতাও দেখছি আমরা। নির্বাচনী আইনের ক্ষেত্রে শিশুদের ব্যবহার করা যাবে না- সেই জায়গাটি নিয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। প্রার্থীদের নৈতিক দায়িত্ব হবে যে তারা শিশুদের ব্যবহার করবে না।”

আইনে যা আছে, তার প্রয়োগ নিশ্চিত করার পাশাপাশি পারিবারিকভাবে সচেতনতা বাড়ানোর ওপর জোর দেন সোমা।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মঈনুল হক চৌধুরী বলেন, নির্বাচন ও ভোটের বিষয়ে শিশুদের সচেতন করতেই মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যসূচিতে আলাদা অধ্যায় রাখা হয়েছে। শিক্ষার্থী ও প্রশিক্ষণের সুবিধার জন্য নায়েম, বিএড, পিটিআইসহ নানা ধাপে রয়েছে নির্বাচন সংক্রান্ত সিলেবাস।

“বিদ্যমান আইন-বিধির কঠোর প্রয়োগ ও ইসির কার্যকর পদক্ষেপ থাকলে ভোটে সহিংসতা রোধ হবে। ভোট পরিণত হবে উৎসবে। এক্ষেত্রে সব দলকে সহায়তা করতে হবে।”

তিনি বলেন, “শিক্ষার্থীদের যাতে কোনো সমস্যা না হয় তা বিবেচনা করছে ইসি। সেজন্য বিদ্যমান আচরণবিধিতে মাইকে প্রচারের সুযোগ রাখা হয়েছে বেলা ২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত।”

দেশের ১৬ কোটি মানুষের ১০ কোটি ৪২ লাখই এখন ভোটার। ১৮ বছরের নিচে রয়েছে এমন নাগরিকের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৫ কোটি।

শিশুদের সংগ্রহ করা খবর নিয়ে শিশুদের জন্য বিশেষায়িত ওয়েবসাইট  হ্যালোর যাত্রা শুরু হয় ২০১৩ সালের ৩১ মার্চ। সংবাদ সংগ্রহ থেকে পরিবেশন পর্যন্ত এর সব কাজেই যুক্ত রয়েছে শিশু ও কিশোর সাংবাদিকরা।

সংবাদভিত্তিক এই ওয়েবসাইটটি পরিচালনা করছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। প্রশিক্ষিত শিশু সাংবাদিকরা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের অভিজ্ঞ সাংবাদিকদের তত্ত্বাবধানে মূলধারার গণমাধ্যমেও ভূমিকা রাখছে।