অসমাপ্ত কথা

Baby-Moudud-1113.jpgবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Oct 2016, 10:34 AM
Updated : 20 Oct 2016, 01:10 PM

প্রয়াত সাংবাদিক, লেখক বেবী মওদুদের অপ্রকাশিত একটি স্মৃতিকথায় উঠে এসেছে জীবনের শেষদিকে এসে তাঁর সংসদ সদস্য হওয়ার ঘটনাক্রম। ২৫ জুলাই, তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে বাংলাদেশের পথিকৃৎ এই নারী সাংবাদিকের ঘটনাবহুল জীবনের খণ্ডাংশ পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হল। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সোস্যাল অ্যাফেয়ার্স এডিটর বেবী মওদুদের অপ্রকাশিত লেখাটি দিয়েছেন তাঁর ছেলে, রবিউল হাসান অভী।

মঙ্গলবার; ২২ নভেম্বর, ২০১১। রাতে অফিস থেকে ফিরে খেতে বসেছি। ভাত খাবার শখ মুছে ফেলতে হয়েছে নিষ্ঠুর ডায়াবেটিসের জন্য। ইনসুলিন নিতে হয় খাওয়ার সময়। দিনে একবার শুধু ভাত, মাছ ও ভর্তা খাওয়ার সুযোগ হয়। ১৬ দিন হাসপাতালে থেকে ১০ নভেম্বর ঘরে ফিরেছি। ডায়াবেটিস এখন নিয়ন্ত্রণে। রাত ৯টা ১৩ মিনিটে নজিবের (শেখ হাসিনার সাবেক ব্যক্তিগত সহকারী এবং বর্তমানে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক) ফোন এল, ‘‘আপা, তৈরি থাকেন, আপনাকে এবার এমপি হতে হবে। এটা আমার মিশন। আমি আপার অনুমতি নিয়েছি। আপনার জন্য ফর্ম কিনে আমি পৌঁছে দেব। ফর্মের দশ হাজার টাকা আমি দিয়ে দিচ্ছি। আপনি এবার কোনো কথা বলবেন না।’’

ওর একটানা কথা শেষ হলে আমি বললাম: ‘‘আমি খেতে বসেছি। এখন তোর পাগলামির কথা শোনার সময় নেই। এসব কথা আর বলবি না।’’

আমার কথা ও শেষ করতে দিল না। বলল: ‘‘রাখেন, আপনার সময় নাই। আমি যা বলছি তাই শুনবেন এখন। এবার আপনাকে হতেই হবে। আপা এই মাত্র মিটিংয়ে ঢুকেছেন। আমি তাঁকে বলেছি, ‘আমার কথা আছে।’ আপা জিজ্ঞেস করেছেন, ‘বল, কার তদবির করবি?’ আমি আপনার কথা বলতেই আপা বলেছেন, ‘তুই আমার মনের কথা বলেছিস।’’’

আমি ওটস খাচ্ছিলাম ঠাণ্ডা করে করে। বাঁধাকপি ও কাঁচা টমেটো দিয়ে তৈরি করেছে মাহমুদা (বুয়া)। খেতে বিশ্রী, স্বাদহীন। নজিবের কথায় মন আরও তিক্ত হল। ওকে বলি: ‘‘তোর তো সাহস কম নয়। তুই আপার কাছে আমার কথা বলবি কেন? আপা কি আমাকে চেনে না? আমি আশা করিনি, নজিব, তুই আমার জন্য আপাকে বলবি। আমি কিন্তু রাগ করলাম।’’

নজিব বলল: ‘‘আমার অন্যায় হয়ে থাকলে আপনি মাফ করবেন। তবে এবার আর কোনো কথা শুনব না। আমার দুটো ভাগ্নের মুখের দিকে তাকিয়ে আপনাকে এমপি হতেই হবে। তারা তো বাইরে মায়ের পরিচয় দিতে পারবে।’’

আমি উত্তর দিলাম: ‘‘আমাকে এসব কথা বলিস না। আমার ছেলেরা আমার পরিচয় জানে। আমি কোনো কিছু পাওয়ার জন্য কখনও কোনো কাজ করি না। তুই আপার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা নষ্ট করিস না।’’

নজিব নাছোড়বান্দা। বলল: ‘‘আপনি ফর্ম পেয়ে ফিল আপ করে জমা দেবেন। আর কোনো কথাই আপনার শুনব না। আপনাকে এবার এমপি বানাবই।’’

ফোন রেখে খেয়ে উঠলাম। ওষুধ খেলাম। নজিবের কথায় আমার দুচোখ ভরে এল। আমাকে আবার সে ঝামেলায় ফেলে দিল। ইনসুলিন নিতে হচ্ছে বলে মনোকষ্টে আছি। খুব হিসাব করে খেতে হয়। এমনিতেই আমি নিরিবিলি নিঃসঙ্গ থাকতে অভ্যস্ত। এমপি হওয়া মানেই তো শত ব্যস্ততা, নানা তদবির শোনা। আমি এসবে জড়াতে কখনও চাইনি। ছাত্রজীবনে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম। ঊনসত্তরে, একাত্তরে আমরা আন্দোলনে, মিছিল-সমাবেশে অংশগ্রহণ করেছি। কিন্তু নিজেকে সাহিত্য-সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন রাখিনি।

ছাত্রজীবনেই সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি এবং এখনও রয়ে গেছি। মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই নারীআন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিই। সর্বজনশ্রদ্ধেয় সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে আমরা দেশব্যাপী নারীমুক্তি আন্দোলনে কাজ করি। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন স্থানে গিয়ে সভায় বক্তৃতা দিয়েছি, প্রশিক্ষণ দিয়েছি। পাশাপাশি রাজনৈতিক আন্দোলনেও অংশ নিয়েছি। বিশেষ করে পনেরই আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে একদল সেনা সদস্যের হাতে নিহত হওয়ার পর দেশে সামরিক শাসন জারি হয়। তারপর আমার পরিবারেও অনেক টানাপড়েন শুরু হয়। তবুও সামরিক শাসনবিরোধী কাজকর্মে জড়িত ছিলাম। লিফলেট বিতরণ, বাড়িতে গোপন বৈঠক ইত্যাদি কাজে সহযোগিতা করেছি।

হরতালের আগের দিন আমার বাসায় পিকেটাররা অবস্থান করত। এর মধ্যে আমার ছোট ছেলেটা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে আমি হতাশ হয়ে পড়ি। তার চিকিৎসাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তায় আমার ঘুম আসত না। আমার স্বামী ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতির সঙ্গে ছাত্রজীবন থেকেই জড়িয়েছিলেন। আইনজীবীর পেশায় যখন তাঁর পসার জমতে থাকল, হঠাৎ একদিন তিনি হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেন। তখন জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসন চলছে। আমি দুটো শিশু সন্তানসহ সাংবাদিকতার চাকরি করে জীবনযাপন করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি।

বেবী মওদুদ: প্রয়াত লেখক ও সাংবাদিক।