বিষয় যখন ‘পরকীয়া’

পরকীয়া প্রেম নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে হাজারো কথা বলা যায়। এ নিয়ে বয়ে যায় নিন্দার ঝড়। তবে পরকীয়া যে মানব সমাজে রয়েছে সে কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।

শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 June 2015, 10:17 AM
Updated : 10 June 2015, 10:17 AM

তাহলে জানা যাক জীবনের কিছু গল্প। নামগুলো পাল্টে দেওয়া হয়েছে মাত্র। ঘটনা নির্ভেজাল সত্যি।

ঘটনা: এক

অনেক ভালোবেসে, পরিবারের সকলের মতের বিপরীতে যেয়ে রীতিমতো যুদ্ধ করে সহপাঠী আসিফের সঙ্গে বিয়ে হল রিনার। বন্ধুরা তাদের এ বিয়েতে খুশি হলেও বিষন্নতা এসে ভর করল মারুফের মনে। কারণ? সেই পুরানো সমস্যা— এক নারী দুই পুরুষ। মারুফও ওদের সহপাঠী। বহুদিন ধরেই সে ভালোবাসে রিনাকে। এই ভালোবাসা মাঝেমধ্যে প্রকাশও করেছে সে রিনার কাছে। মারুফকে বন্ধু হিসেবে পছন্দ করলেও রিনা তখন আসিফের প্রেমে নিমজ্জিত।

তবে বিয়ের দুবছর পর প্রেম যখন একটু আধটু পানসে হয়ে এসেছে তখন রিনার বারে বারে মনে পড়ে মারুফের কথা। এই ভাবনা চিন্তাতেও গড়িয়ে গেছে তিন বছর। মারুফ ততোদিনে বিবাহিত। দুজনের সংসারেই এসেছে সন্তান। তারপর আবার ফেইসবুকে নতুন করে মারুফ-রিনার সুখ-দুঃখের বিনিময় শুরু। এরপর দুজোড়া চোখকে ফাঁকি দিয়ে অভিসার। তবে যতই সাবধানী হোক, কে কবে লুকিয়ে রাখতে পেরেছে প্রেমকে? বিশেষ করে ‘পরকীয়া প্রেম’ ব্যধির মতোই চোখে পড়ে যায় সমাজের। তারপর শুরু চিকিৎসা। ঘরে বাইরে গঞ্জনা, স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া, সন্তানদের বিষন্ন মুখ। শেষ পর্যন্ত আসিফের সঙ্গে ডিভোর্স। মারুফের স্ত্রীর সঙ্গে সেপারেশন। প্রেমিক প্রেমিকার সাময়িক লিভ টুগেদার, পরে ‘অনাড়ম্বর’ বিয়ে। বাবা মায়ের প্রেমের খেসারত দিতে সন্তানরা এখন পড়ছে বোর্ডিং স্কুলে।

ঘটনা দুই:

বিয়ে হয়েছিল জীবনের ভোরবেলায়। একুশ বছরের মধ্যেই দুটি সন্তান। তারপর এই চল্লিশ ছুঁইছুঁই বয়সেও রেবা সুলতানা রূপের দৌড়ে অনায়াসে পাল্লা দিতে পারেন সদ্য তরুণীর সঙ্গে। গানের গলা মন্দ নয়। কিছুটা লেখালেখির অভ্যাসও রয়েছে। সেই সূত্রেই আলাপ কবি রফিক রহমানের সঙ্গে। আলাপের পর দুজনেরই মনে হয়েছে যেন ‘এরই লাগি’ প্রতীক্ষায় ছিলেন।

রফিকও কচি খোকা নন। ভালো প্রতিষ্ঠানের চাকুরে। ঘরে স্ত্রী রয়েছে। ছেলেমেয়েরা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। যা হোক সমাজ সংসারের মতো তুচ্ছ বিষয় নিয়ে খুব বেশি ভাবনা চিন্তা করেননি রেবা ও রফিক। মন পবনের নাওতে পাল তুলে হারিয়েছেন ভালোবাসার নদীতে। তারপর?

স্ত্রীর পরকীয়া প্রেমের খবর অচিরেই বন্ধুবান্ধবের কাছে পেয়েছেন স্বামী। মনের দুঃখে অ্যালকোহলকে সঙ্গী বানিয়েছেন তিনি। মায়ের এই কিচ্ছা কাহিনিতে তরুণ ছেলেমেয়েরা লজ্জায় অধোবদন। রফিকের স্ত্রী বহু মান অভিমানের পর স্বামী সম্পর্কে নির্লিপ্ত। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেটি মাদকাসক্ত, মেয়েটি মনোরোগী।

পরকীয়ার এমন সত্যি ঘটনার উদাহরণ দেওয়া যায় রাশি রাশি। সব ঘটনা বিশ্লেষণ করে মোটামুটি পাওয়া যায় সেই একই ফল। পরকীয়া প্রেমে অতলস্পর্শী সুখ যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে চুরমার হয়ে যাওয়া দাম্পত্য জীবন আর সন্তনদের নরক যন্ত্রণা। যুগে যুগে সাহিত্য ও শিল্পকলাকে যা করছে সমৃদ্ধ, মানুষের জীবনকে তা করছে ক্ষতবিক্ষত।

কেনো পরকীয়া প্রেম? কেনো স্বখাত সলিলে ডুবে মরা? কেনো জেনে শুনে পান করা অমৃতরূপী গরল? কী ভাবছেন এ সম্পর্কে ফ্রয়েড, হ্যাভলক এলিশের মতো মনোবিজ্ঞানীরা?

অনেক মনোবিজ্ঞানীর মতে, পরকীয়ার অন্যতম কারণ যৌনজীবনে অতৃপ্তি ও বিবাহিত জীবনের একঘেঁয়েমি। আবার অনেক সময় ব্যক্তির শৈশবে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা কিংবা বাবা মায়ের অসফল দাম্পত্য জীবনও প্রভাব ফেলে আচরণে। পরকীয়ার অনেকটাই নাকি মোহ, এক ধরনের অবসেশন। মোহ ভঙ্গ হতেও দেরি হয় না। তখন আবার অতৃপ্তির শুরু। যা পেয়েও হারিয়েছি তা আবার ফিরে পাওয়ার তৃষ্ণা। অনেক পরকীয়া প্রেমেরই পরিণতি তাই অনুতাপে।

অবশ্য এর উল্টোটাও আছে। প্রথম ইনিংসে ব্যর্থ হলেও দ্বিতীয় ইনিংসে সুখী হয়েছে অনেক দম্পতি।

তবে পরকীয়া প্রেমের জন্য যে জিনগত বৈশিষ্ট্যও কিছুটা দায়ী সে কথা বলছে আধুনিক বিজ্ঞান। জিনগত বৈশিষ্ট্যের জন্যই কোনো কোনো ব্যক্তির মস্তিষ্কে এমন কিছু রাসায়নিক উপাদানের ক্রিয়া বিক্রিয়া ঘটে যা তাকে বিয়ে বহির্ভূত প্রেম করতে বা অন্য সঙ্গী বেছে নিতে প্ররোচনা দেয়। আবার কিছু ব্যক্তির মস্তিষ্কে ওই বিশেষ রাসায়নিক বস্তুটি আছে কম মাত্রায়। ফলে দাম্পত্য জীবনে সে যতই অসুখী হোক পরকীয়ার ছায়াও মাড়াবে না। এই রাসায়নিক উপাদানের ক্রিয়াবিক্রিয়া বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য (আদৌ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে কিনা সে প্রশ্নও রয়েছে) চলছে গবেষণা।

বিজ্ঞানের কচকচি এড়িয়ে মোদ্দা কথাটা তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে? ভবিষ্যতে কি পরকীয়া প্রেমের এন্টিডোট পাওয়া যাবে? মানে পরকীয়া প্রেমকে প্রতিহত করার জন্য টিকা নেওয়া লাগবে? বিয়ের পরপরই স্বামী-স্ত্রী এক ডোজ করে পরকীয়া প্রতিষেধক ইঞ্জেকশন নিয়ে নেবেন। মন্দ নয়! কল্পনা করুন একবার। রাতবিরেতে মোহন-বাঁশি শুনেও যেন রাধার প্রাণ আনচান না করে সেজন্য নিয়ম করে বৌকে ইঞ্জেকশন দেওয়া হচ্ছে!

পরকীয়ার উপসর্গ

শাস্ত্রে আছে, ‘স্ত্রীয়াশ চরিত্রম, পুরুষেশ ভাগ্যম, দেবঃ না জনান্তি, কুতু মনুস্যা’— অর্থাৎ, নারীর চরিত্র ও পুরুষের ভাগ্যে কখন কী ঘটবে তা দেবতারাও বলতে পারেন না, মানুষ তো কোন ছাড়।

তবে কথাটা শুধু মেয়েদের চরিত্র সম্পর্কে কেনো? যেন পুরুষরা সব দুধে ধোয়া তুলসীপাতা আরকি। বহু পুরুষ আছে যারা স্ত্রীর চোখকে তো বটেই বিশ্বসুদ্ধু সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে দিব্যি পরকীয়া প্রেম চালিয়ে যাচ্ছেন। পরে যখন হাটে হাঁড়ি ভেঙেছে তখন অনেকের কাছেই মনে হয়েছে ‘এমন দেবতুল্য পুরুষের এই কীর্তি? ঘুণাক্ষরেও তো আগে বোঝা যায়নি।

যাক, শাস্ত্রকার হয়তো শুধু নারীর চরিত্র খোয়ানো নিয়েই চিন্তিত ছিলেন কিংবা সে যুগে পুরুষরা কিছুটা অকপট ছিল। এ যুগেও শ্লোকটা নারী পুরুষ দুজনের বেলাতেই প্রযোজ্য ধরে নেওয়া যায়।

মানুষের চরিত্র সম্পর্কে দেবতারা বলতে না পারলেও এ যুগের মনোবিজ্ঞানীরা বেশ কিছু ব্যাখ্যা বের করেছেন।

এই বিষয়ে ভারতীয় মনোবিজ্ঞানি ডা. হিমাংশু সাক্সেনা একটি প্রতিবেদনে জানান, বিশ্বাস করা হয় প্রাকৃতিকভাবেই পুরুষরা বহুগামী। তিনি মনে করেন এই যুগে এশিয়ার অনেক মানুষই যৌনবিষয়ে আগের চাইতে অনেক খোলামেলা।

তিনি বলেন, “দাম্পত্য বিরোধ প্রায়ই বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের দিকে নিয়ে যায়। পারিবারিক ভাবে বিয়ে হলে সঙ্গী যদি পছন্দ না হয় তাহলেও সম্পর্ক অন্যদিকে যায়। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ দুজন মানুষকে একত্র করে।”

“দেখা গেছে যদি বেশ কয়েক বছর বিবাহিত জীবন ভালো না যায় এবং পানসে মনে হয় তবে নতুন মানুষ আকর্ষণীয় হিসেবে আবির্ভূত হয়।”

দেবতারা জানতে না পারলেও মনোবিজ্ঞানিরা পরকীয়া ব্যাপারে অনেক রকম গবেষণা করে বসে আছেন। আর সেসব ফলাফলের ভিত্তিতে বিভিন্ন মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক ওয়েবসাইটে পরকীয়ার কিছু লক্ষণ উল্লেখ করা হয়। এসব লক্ষণ বা উপসর্গ মিলিয়েই বোঝা যাবে কোনো নারী বা পুরুষ গোপনে পরকীয়া প্রেম করছেন কিনা।

স্বামী বা স্ত্রী ডুবে ডুবে জল খাচ্ছেন কি না তা জানার যদি একান্ত ইচ্ছা থাকে তাহলে উপসর্গ মিলিয়ে দেখতে পারেন। এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো। আগে নিজের সঙ্গে গোপনে লক্ষণ মিলিয়ে নিন। যদি আপনার সঙ্গেই বেশি মিলে যায় তাহলে চেপে যান। কারণ তখন বুঝতে হবে তাকে নয়, রোগে ধরেছে আপনাকেই।

* আপনাদের মধ্যকার সম্পর্ক কেমন যেন বদলে যাচ্ছে। সে হয়ে উঠছে বদমেজাজি। আপনার ভুল ধরছে কথায়, কথায়। দূরে সরে যাচ্ছে, স্নেহ, মমতার প্রকাশও যেন কমে গেছে। মোট কথা দূরত্ব বাড়ছে।

* বাড়িতে ফিরতে তার দেরি হচ্ছে প্রায়ই। কেনো দেরি হচ্ছে সে কথাও বুঝিয়ে বলছে না। ‘অফিসে কাজ খুব’ এই অযুহাতে দেরি করে বাড়িতে ফেরা বেড়েছে। লাঞ্চ করতে অফিসের বাইরে যাচ্ছে প্রায়ই। ‘বন্ধুদের সঙ্গে’ সময় কাটানো, ‘বসের সঙ্গে’ বাড়ির বাইরে থাকার পরিমাণ ক্রমেই বাড়ছে। এমনকি ছুটির দিনেও ‘কাজ আছে’ বলে বেরিয়ে যাচ্ছে বাড়ি থেকে।

* ব্যক্তিগত খরচ বেড়েছে। আগে হাত খরচে যা ব্যয় হত তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যয় হচ্ছে এখন। ক্রেডিট কার্ডে খরচের অংক বাড়ছে লাফিয়ে।

* টেলিফোনে কথা বলার অভ্যাসটা পাল্টাচ্ছে। ফোনে কথা বলতে ব্যালকনিতে চলে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ ধরে কার সঙ্গে যেন কথা বলছে। সেলফোনে এসএমএস আগের চেয়ে বেশি আসছে। আপনি ‘কে পাঠাল দেখি’ বললেই চট করে ডিলিট করছে বা বিরক্ত হচ্ছে, কিংবা কোনো পরিচিত ব্যক্তির নাম বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।

* নিজের চেহারা সুরতের প্রতি মনোযোগ হঠাৎ করে বেড়ে গেছে। চুলে নতুন রং, হেয়ার স্টাইল পাল্টানো, ফেইশল করতে ঘন ঘন পার্লারে বা সেলুনে দৌড়ানো, ডায়েটিং ও এক্সারসাইজে নতুন মনোযোগ, পারফিউমের দারুণ ঘটা, মাউথ ফ্রেশনারের অস্বাভাবিক ব্যবহার, নখের জন্য হঠাৎ বাড়তি যত্ন, নতুন কাপড় কেনার অস্বাভাবিক আগ্রহ।

* ফেইসবুক, স্কাইপ বা অন্য কোথাও চ্যাটিংয়ে হঠাৎ বাড়তি আগ্রহ। বিশেষ কারও সঙ্গে সারাক্ষণ চ্যাটিংয়ে মেতে থাকা। আবার কেউ যেন চ্যাটিংয়ের লেখা না দেখতে পারে সে বিষয়ে অনাবশ্যক সতর্কতা।

* ওয়ালেট বা পার্সে আপনার অজানা, অচেনা রেস্তোরাঁর বিল। আপনি সঙ্গে যাননি অথচ থিম পার্কের, সিনেপ্লেক্সের টিকেট তার ব্যাগে বা ড্রয়ারে। গাড়িতে সিগারেটের টুকরা (যা আপনার নয়), চকলেট, চুইংগাম বা অন্য কোনো খাবারের মোড়ক, ড্রিংকসের খালি ক্যান।

* ত্বকে রহস্যময় বাইট মার্ক, আঁচড়ের দাগ। বলতেই পারছে না ‘এটা কীভাবে হল’।

* শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহ কমে যাওয়া বা অভ্যাস বদলে যাওয়া।

* এছাড়া সেই চিরাচরিত শার্টে লিপস্টিকের দাগ, শাড়িতে সিগারেট কিংবা আফটার শেইভের গন্ধ (যা আপনার নয়) এসব তো রয়েছেই।