সুস্থসবল শিশুর জন্য

শিশুর সঠিক বিকাশ ও বর্ধনের প্রক্রিয়া শুরু হয় মায়ের গর্ভ থেকেই। তাই শিশুর সঠিক বিকাশের জন্য মায়ের সঠিক যত্ন নেওয়া প্রয়োজন।

তৃপ্তি গমেজবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 May 2015, 09:20 AM
Updated : 2 August 2016, 10:58 AM

শিশুর বিকলাঙ্গতা ও প্রতিবন্ধকতা এড়ানো প্রসঙ্গে কথা বলেন বাংলাদেশ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের ‘শিশু বিকাশ ও সামাজিক সম্পর্ক’ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রুমানা বাসার।

তিনি বলেন, “দেহের পূর্নাঙ্গ গঠন ভ্রূণ পর্যায়ে শুরু হয়। এ সময় ভ্রুণের যে কোনো রকম ক্ষতি চিরস্থায়ী ফেলতে পারে যা কোনোভাবেই ঠিক করা সম্ভব হয় না।”

ভ্রূণ পর্যায়ে শিশুর হৃৎপিণ্ড, দুটি চোখ ও দুটি কান অবশ্যই তৈরি হবে। দেহের নির্দিষ্ট স্থানের কুড়ির মতো কোষপিণ্ড ক্রমশ দুইটি হাত ও পায়ে রূপান্তরিত হয়। এই পরিবর্তণ ভ্রূণ পর্যায়ে সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন না হলে পরবর্তিতে হাত বা পা তৈরি হয় না বলে জানান রুমানা বাসার।

তাই এই সময়ে, গর্ভজাত শিশুর সঠিক বিকাশে প্রয়োজনীয় পুষ্টি নিশ্চিত করা জরুরি। তাই মা যেনো পর্যাপ্ত পরিমাণ পুষ্টি পায় সেদিকে বিশেষ নজর রাখা দরকার। 

রুমানা বাসার জানান, দেহ গঠন, বংশবৃদ্ধি ও রক্তের উপাদান ঠিক রাখার জন্য ফলিক অ্যাসিড খুবই জরুরি একটি উপাদান। মায়ের খাদ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণে লোহাজাতীয় খাবার না থাকলে শিশুর রক্তস্বল্পতাও হতে পারে এবং মায়ের খাদ্যে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি হলে শিশুর হাড় গঠনেও সমস্যা হতে পারে। তাছাড়া আমিষের অভাবে শিশু খর্বাকার হতে পারে আবার অনেক সময় আমিষের অভাবে মানসিক প্রতিবন্ধিকতাও দেখা দেয়।

শিশুর বিকলাঙ্গতারোধ ও মায়ের সার্বিক সুস্থতা নিশ্চিত করার জন্য কয়েকটি পুষ্টি উপাদান অত্যন্ত প্রয়োজন বলে জানান এই অধ্যাপক।

ফলিক অ্যাসিড

গর্ভবতী মহিলাদের জন্য ফলিক অ্যাসিড খুব জরুরি। সুস্থভাবে সন্তান প্রসব করার জন্য ফলিক অ্যাসিড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর অভাবে মস্তিষ্কে সমস্যা দেখা দেয়।

মাতৃগর্ভে ৩০ দিন বয়সে শিশুর স্নায়ুতন্ত্র গঠিত হয়ে থাকে। এ সময় মায়ের শরীরে ফলিক অ্যাসিডের ঘাটতি থাকলে শিশুর স্নায়ুতন্ত্র ও মস্তিষ্ক গঠনে বড় ধরনের ত্রুটি হতে পারে। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণের পাশাপাশি যে সব মা অতিরিক্ত ফলিক অ্যাসিড গ্রহণ করছেন তাদের গর্ভজাত শিশুদের মধ্যে স্নায়ুতন্ত্রের ও মস্তিষ্কের এসব ত্রুটির পরিমাণ শতকরা ৬০ থেকে একশত ভাগ পর্যন্ত কম হয়।

পুঁইশাক, পাটশাক, মূলাশাক, সরিষা-শাক, পেঁপে, লেবু, ব্রোকলি, মটরশুঁটি, শিম, বরবটি, বাঁধাকপি, গাজর ইত্যাদি শাকসবজিতে ফলিক অ্যাসিড পাওয়া যায়। আম, জাম, লিচু, কমলা, আঙুর, স্ট্রবেরি ইত্যাদিও ফলিক অ্যাসিডের চাহিদা মেটায়।

বিভিন্ন ধরনের ডাল যেমন- মসুর, মুগ, মাষকালাই, বুট ইত্যাদিতে প্রচুর ফলিক অ্যাসিড রয়েছে। এছাড়াও সরিষা, তিল, তিসি, সূর্যমুখীর বীজ, লাল-চাল, লাল-আটা ইত্যাদি ফলিক অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার।

ক্যালসিয়াম

হাড় ও দাঁত সুস্থ রাখার জন্য ক্যালসিয়াম দরকার। গর্ভাবস্থায় হাড়ের ক্ষয় রোধ করার জন্য ক্যালসিয়াম জরুরি। ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতেও ক্যালসিয়াম প্রয়োজন। সাধারণত ৩৫ বছরের পর থেকেই মেয়েদের হাড় ক্ষয় হতে থাকে। তাই এই সময় ক্যালসিয়াম-জাতীয় খাবার খাওয়া প্রয়োজন। দুধ, পনির, কালো বিন ও কাগজী-বাদাম ইত্যাদি ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার।

আয়রন

শরীরের বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য খুবই দরকরী এই উপাদানের অভাবে ক্লান্তি, মনযোগের অভাব ও নিদ্রাহীনতা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। আয়রন শরীরে অক্সিজেন সরবরাহের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। ঋতুকালীন সময়ে শরীর থেকে যে পরিমাণ আয়রন ক্ষয় হয় তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এই ঘাঠতি মেটাতে গরু, ভেড়া ও খাসির মাংস, কলিজা, কিডনি বিন, ব্রোকলি ইত্যাদি খাওয়া প্রয়োজন। তাছাড়া আয়রনের অভাবে শিশুর রক্ত স্বল্পতাও দেখা দিতে পারে।

ভিটামিন ডি

মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে ভিটামিন ডি অত্যন্ত জরুরি। গর্ভবতী মা ও শিশুর জন্য ভিটামিন ডি দরকার। 

ভিটামিন ই

ভিটামিন ই প্রধানত স্নেহজাতীয় খাদ্যে বেশি থাকে। যেমন তেল, বাদাম ও বীজ। তাছাড়া এটি একটি শক্তিশালী অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। বায়ু দূষণ, সিগারেটের ধোঁয়া ও সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে ত্বক রক্ষা করে এই ভিটামিন।

তাই গর্ভবতী মায়ের প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় বাদামি পাউরুটি, বাদাম অথবা সূর্যমুখীর বীজ ইত্যাদি রাখা ভালো। রুচি পরিবর্তণের জন্য বাদাম ও বীজসিদ্ধ সবজি, সালাদের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে।

ভিটামিন সি

শরীরের বিভিন্ন পেশী, ত্বক ও টিসু সুস্থ রাখতে ভিটামিন সি কাজ করে। এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বজায় রাখে। লাল মরিচ, কমলা লেবু, কিউই, স্ট্রবেরিতে ভিটামিন সি থাকে।

ম্যাগনেসিয়াম

শিশুর নার্ভ, পেশী ও হাড়ের জন্য ম্যাগনেসিয়াম জরুরি। কালো বিন, পালং-শাক, কুমড়ার বীজে প্রচুর ম্যাগনেসিয়াম থাকে। তাই গর্ভাবস্থায় মা’কে ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ানো উচিত। 

ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড

স্নেহজাতীয় পদার্থের মধ্যে এই ফ্যাটি অ্যাসিড মহিলাদের জন্য অতি প্রয়োজনীয়। ওমেগা থ্রি রক্তচাপ কমাতে, জ্বালাভাব কমাতে, ক্যান্সার ও বিভিন্ন রকম হৃদরোগ থেকে শরীর রক্ষা করে। প্রতিদিন একজন নারীর ১.১ গ্রাম ফ্যাটি এসিড প্রয়োজন হয়। স্যামন মাছ, টুনা মাছ, হেরিং মাছ ইত্যাদি সামৃদ্রিক মাছে এই ফ্যাটি অ্যাসিড পাওয়া যায়।

পটাসিয়াম

সুস্থ হাড় ও পেশীর জন্য প্রয়োজনীয়। অনেক খাবারেই পটাসিয়াম থাকে। সব ধরনের মাংস, স্যামন মাছ, মিষ্টি আলু, ব্রোকলি, পালংশাকে প্রচুর পটাসিয়াম থাকে। ১৯ বছর বয়সের পর থেকে দৈনিক ৪,৭০০ মিলিগ্রাম পটাসিয়াম প্রয়োজন হয়।

ফাইবার বা আঁশ

গর্ভবতী মহিলাদের জন্য এটি অত্যন্ত প্রয়োজন। এটি পাকস্থলীর নিম্নভাগের সমস্যা দূর করে। ১৯ থেকে ৫০ বছর বয়সীদের জন্য দৈনিক ২৫ গ্রাম ও ৫১ বছর বয়সীদের জন্য দৈনিক ২১ গ্রাম ফাইবার প্রয়োজন। বিভিন্ন ফল ও সবজিতে ফাইবার থাকে। এছাড়া গমের রুটি, সিরিয়াল, বার্লি ও লালচালের ভাতেও তন্তু থাকে।

ছবির প্রতীকী মডেল: সানায়া ও শায়লা। ছবি: আসাদুজ্জামান প্রামানিক