জলপথে ছোটহরিণা

রোমাঞ্চকর অভিযানে কর্ণফুলি নদীর সৌন্দর্যে আপ্লুত হবে মন।

সমির মল্লিকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 April 2015, 10:43 AM
Updated : 4 April 2015, 08:54 AM

ছোটহরিণা বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জনপদ। ভারতের মিজোরামের সীমান্ত ঘেঁষা এই ইউনিয়নের উপর দিয়ে বয়ে আসে কর্ণফুলির মূল স্রোত। মিজোরামের ব্লু মাউন্টেইন বা নীল পাহাড়ের (লুসাই পাহাড়) স্রোতধারা এসে মিশেছে বাংলাদেশের ঠেগামুখ সীমান্তে।

ঠেগামুখ থেকে বড়হরিণা পর্যন্ত ৭২ কিলোমিটারের এই পথ যেন অন্যরকম মিলনের সুর— নদীর ডান পাশে ভারত আর বাম পাশে বাংলাদেশ। দেমাগ্রীতে নদীর বুকে ভেসে বেড়ায় ভারত আর বাংলাদেশের পতাকাবাহী মাছধরার নৌকা।

ঠেগামুখ পেরিয়ে বড়হরিণা— ছোটহরিণা হয়ে কর্ণফুলি নদী এসেছে এ দেশে। রাঙামাটি জেলা সদর থেকে ছোটহরিণার জলপথের দূরত্ব প্রায় ৭২ কিলোমিটার।

আমাদের এবারের গন্তব্য বরকলের শেষ বাজার ছোটহরিণা। অনেক আগেই গল্প শুনেছি ব্রিটিশ আমলের এই বাজার সম্পর্কে। তবে হরিণার যাত্রাপথ আর লঞ্চের সময় সর্ম্পকে বিস্তারিত ধারণা নিলাম লঞ্চের মাস্টার আল আমিনের কাছ থেকে।

লংগদু হয়ে আমাদের যেতে হবে শুভলং বাজার। সেখান থেকে দুপুর আড়াইটায় বরকলের শেষ লঞ্চ ধরতে হবে। বরকল হয়ে হরিণা যেতে সময় লাগবে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা।

সারা দিন ক্লান্তিহীন প্রায় ১০ ঘণ্টার লঞ্চ ভ্রমণ। সকালে লংগদু থেকে ছেড়ে আসা লঞ্চে চার ঘণ্টার পথ পেরিয়ে  দুপুরে পৌঁছাই শুভলং বাজারে। তারপর আবার আমাদের লঞ্চ যাত্রা শুরু। কাপ্তাই লেকের কোল ঘেঁষে থাকা পাহাড়, দলছুট বাড়ি, নীল জলরাশির ভিড়ে কোথাও কোথাও পাখির ঝাঁক। কর্ণফুলির মোহানায় দাঁড়িয়ে থাকা উঁচু পাহাড়ের গায়ে ঢলে পড়া সূযর্টা কত সুন্দর হতে পারে! সেই সঙ্গে শেষ বিকেলে নদীর পাড়ের কাশবনের উপর সাত রংয়ের কারুকাজ করে বাহারি রংধনু।

বিকেল বেলায় বরকল বাজারে কিছুক্ষণের যাত্রা বিরতি। হাতে ১০ মিনিট সময়। এর মধ্যেই ঘুরে দেখলাম বরকল বাজার। ছোট আর ছিমছাম। বিদ্যুৎ সংযোগ নেই, সৌরবিদ্যুৎ একমাত্র ভরসা। একপাশে কর্ণফুলির স্রোতধারা, অন্যপাশে উঁচু পাহাড়। নদী-পাহাড় ঘেঁষে বরকল বাজার।

লঞ্চ যখন বরকল ছেড়ে ছোটহরিণার দিকে যাত্রা আরম্ভ করল তখন প্রায় শেষ বিকেল। বরকল বাজার পাড়ি দিতে না দিতেই চোখ ধাঁধানো সব দৃশ্যপট। পাহাড়ের নিচে নিচে বিচ্ছিন্ন সব জুমঘর। মেঘের ছায়ায় ঢেকে ‌আছে গ্রামগুলো। কাশবন ঘেঁষা পাহাড়ের কোলজুড়ে রংধনুর রেখা, সবুজ পাহাড়কে যেন আরও উজ্জ্বল করে তুলেছে।

পথ চলতে চলতে কথা হল লঞ্চের কিছু যাত্রীর সঙ্গে। লঞ্চের বেশিরভাগ যাত্রীর গন্তব্য ছোটহরিণা, একদিন পরই ছোটহরিণার সাপ্তাহিক বাজার। শেষ বিকেলের শান্ত জলপথ। সন্ধ্যার উজ্জ্বল আকাশ! এ যেন পূর্ণিমার আলোয় ডুবে থাকা নীরব-নিঝুম পাহাড়। কর্নফুলির দুধারে এমন নিরবিচ্ছিন্ন পাহাড়ের সারি আর কোথাও বোধহয় পাওয়া যাবে না।

ধবধবে জোছনার আলোয় আলোকিত কর্ণফুলি ধরে লঞ্চ যাত্রাটা মায়াবী দেশের মতো মনে হয়। পথে পথে স্থানীয় যাত্রীদের ওঠা-নামায় লঞ্চ ভিড়ছে বিভিন্ন ঘাটে।

আমাদের রাতে থাকার ব্যবস্থা ভূষণছড়া বাজারে, সামাদচাচার কাঠের বোর্ডিংয়ে। তিনি জানান, আমারই এখানে প্রথম টুরিস্ট। সামাদচাচার বাসাতেই আমাদের রাতের খাবারের আয়োজন হল। সারা রাত জোছনার আলোয় আলোকিত এই দূরের গ্রামে রাত কাটানোই কেমন যেন একটা থ্রিলিং। 

খুব ভোরে রওনা হই ছোটহরিণার পথে। অদূরের পাহাড়গুলো সাদা কুয়াশার চাদরে মোড়ানো। নদীর বুকে টলটল পান। মোটরবাইকে কিছুটা পথচলা, বাকিটা হেঁটে আর খেয়া পার হয়ে পৌঁছে যাই ছোটহরিণায়।

কর্ণফুলির তীরে পাহাড়ের উপর ছোটহরিণা বাজার। পাহাড়গুলোকে ঘিরে আছে সকালের মেঘ। মনে হচ্ছে মেঘের দোলনায় শুয়ে আছে বাংলাদেশের এই সীমান্তবর্তী ছোট বাজার। দুর্গম পাহাড়ি সীমান্তে হরিণা বাজার বেশ জনপ্রিয়। বাজারের পাশেই বিজিবি ক্যাম্প। ছোট হরিণার পর কোনো বাঙালির প্রবেশের অনুমতি নেই, কড়া নিষেধাজ্ঞা।

ছোট হরিনার পর মিজোরামের সীর্মান্তবর্তী দেমাগ্রী, শ্রীনগর, বড়হরিণা, ভাল্লুকছড়ি, টেগামুথ— এসব জায়গায় কেবল আদিবাসীরা চলাচল করতে পারে।

স্থানীয়রা জানান, আদিবাসীরা নৌপথে টেগামুখ সীমান্ত দিয়ে মিজোরামের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। আলাদা আলাদা দুই দেশের পতাকা নিয়ে নৌকা চলাচল করে সীমান্তবর্তী অঞ্চলে। অনেক চেষ্টা তদবির করেও শ্রীনগর যাওয়ার অনুমতি মিলল না।

অগত্যা ফেরার পালা। ছোটহরিণা থেকে সকাল ৮ টার লঞ্চে যাত্রা শুরু করে শুভলং হয়ে লংগদু পৌঁছলাম শেষ বিকেলে। এত প্রাপ্তির ভিড়ে দেমাগ্রী, শ্রীনগর, বড়হরিণা, ভাল্লুকছড়ি, টেগামুথ সীমান্ত পথগুলো ভেসে ওঠে কল্পনার ছবিতে। এক মেঘের সীমান্ত ধরে নতুন কোনো সূযার্স্ত দেখার স্বপ্নজাল বোনা শুরু হল।

যেভাবে যাবেন

ছোটহরিণাতে একমাত্র নৌপথে যাওয়া যায়। রাঙামাটি থেকে দিনে দুতিনটি লঞ্চ ছেড়ে যায়। তবে ছোট হরিণার থাকার কোনো ভালো ব্যবস্থা নেই। ভূষণছড়ায় সামাদচাচার কাঠের বোর্ডিংয়ে থাকতে পারবেন।

প্রয়োজনীয় তথ্য

আপনি যদি সাঁতার না জানেন, তবে পানিতে নামবেন না, লেকের পানি বেশ গভীর। লাইফ জ্যাকেট ব্যবহার করতে পারেন। ছোট হরিণায় ভ্রমণে যে কোনো তথ্য ও সহযোগিতার জন্য যোগাযোগ করতে পারেন ০১৫৫৬ ৭১০০৪৩, ০১৮১৫৮৫৬৪৯৭ (সিএইচটি ট্র্যাভেল)।

খেয়াল করবেন

লেকের পানি খুবই স্বচ্ছ নীলাভ। লেকের পানিতে কোনো বোতল, প্যাকেট, প্ল্যাস্টিক ইত্যাদি ফেলবেন না। প্রকৃতিকে সুন্দর রাখুন।

ছবি: লেখক।