একসময় বেদবাক্যের মতোই ছিল বিষয়টা। রমণীর গুণে সংসার সুখের হওয়াটা এখন অতীত। বরং স্বামী-স্ত্রী নিজেদের মধ্যে ছাড় দিতে না পারলে সংসারটায় সঙ হতে বেশি সময় লাগে না। আবার একজন বেশি আর অন্যজন কম ছাড় দিল, সেটাতেও ঘটে বিপত্তি।
তাহলে কী করা উচিত!
এই বিষয়ে কথা বলেন মনোবিদ ফরিদা আক্তার।
যখন একটা বিয়ে হয় তখন কয়েকটা বন্ধন তৈরি হয়। সেগুলো হল সামাজিক বন্ধন, ধর্মীয় বন্ধন, আইনগত বন্ধন। কিন্তু যেটা হয় না, সেটা হল মানসিক বন্ধন। এটা হতে সময় লাগে।
পাত্রপাত্রির মধ্যে আগে থেকে যোগাযোগ না থাকলে, পারিবারিকভাবে বিয়ে হলেই সাধারণত এই পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। আর এই বন্ধন গড়তে তাড়াহুড়োয় নয়, বরং ধীরে ধীরে ছোট ছোট পদক্ষেপে তৈরি হয়।
বন্ধন গড়তে গিয়ে মতবিরোধ হতে পারে। ধরা যাক, একজন একটা ভুল করল, অপরজন সেটা থেকে কষ্ট পেল। যে কষ্ট পেল, সে ভুলে না গিয়ে বরং বিভিন্ন সময় সেই ‘কষ্ট’টা নিয়ে ভাবতে থাকে। একসময় অবচেতম মনে গেঁথে বসে কষ্টটা।
পরে কোনো সময় দুজনের মধ্যে ঝগড়া লাগলে সেই পুরোনো বিষয় মনে করিয়ে নতুন করে ঝগড়া শুরু হয়। ‘আমি এটা করেছি, তুমি তো ওটা করেছিলে’— ফলে সংসারে অশান্তি লেগেই থাকে।
এই সমস্যার একটি সহজ সমাধান হল একজন অপরজনকে মাফ করে দেওয়া। এতে মনের ভার কমে আর ধর্মীয় দিক থেকেও এটা সমর্থন করে।
এবার বিবাহিত দম্পতির মধ্যে ভালোবাসার বিষয়ে আসা যাক। কয়েকটি উপাদানের উপর ভালোবাসা নির্ভর করে।
- পারস্পরিক বিশ্বাস।
- পারস্পরিক শ্রদ্ধা।
- পরস্পরের প্রতি যত্নশীল হওয়া।
- পরস্পরের প্রতি শারীরিক আকর্ষণ থাকা। এবং
- স্বচ্ছতা।
তবে ভালোবাসা মানে এই নয়, কেউ কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি হয়ে গেল। যদি কেউ সঙ্গীকে সম্পত্তি ভেবে বসে, তখন ব্যক্তিস্বাধীনতা নষ্ট হয়ে যায়। অনেকটা মালিক-চাকর সম্পর্কের মতো, সঙ্গীর যেটা ভালোলাগে সেটাই করতে হবে, নিজস্বতা বলে কিছু থাকে না। এটা করলে সম্পর্কে কখনও স্বাভাবিকতা আসবে না।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ছেলের পরিবার বা ছেলে নিজেও আশা করে বিয়ের পর মেয়ে বরের বাড়ির পরিবেশ সংস্কৃতি আয়ত্ব করবে। অনেক সময় উল্টা ব্যাপারও ঘটে। এতে জটিলতা তৈরি হয়। মানসিক চাপ বাড়ে।
এ ক্ষেত্রে স্বামী স্ত্রী দুজনকেই দুজনের পরিবারের কাছ থেকে ভালো জিনিসগুলো আয়ত্ব করে নিজের সংসার গোছাতে হবে। আসলে দুজনকেই পরিবর্তীত হতে হবে। ভালো বিষয়গুলো গ্রহণ করা বা দুজনের পরিবারের বাইরের কোনো বিষয়, যেটা সংসারের জন্য মঙ্গল হবে সেগুলো নিয়েও নিজেদের ঘর সাজানো যায়।
আর কোনটা গ্রহণ করবে কোনটা বাদ দেবে তা আলাপ আলোচনার মাধ্যমে দুজনকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনুশীলন করতে হবে।
কারণ ভালো থাকতে হলে ‘ডিসিশন মেইকিং’টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একজনের সিদ্ধান্ত অন্যজনের উপর চাপিয়ে দিলে সংসারে কখনও শান্তি বিরাজ করবে না। তাই সংসারে যে কোনো বিষয় চূড়ান্ত করার সময় দুজনের সমান অংশগ্রহণ থাকা জরুরি।
আর এই সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে অনেক বিষয় ছাড় দিতে হয়। এ ক্ষেত্রে শুধু একজনের ছাড় দেওয়া মোটেই সুখের বিষয় হয় না।
ফরিদা আক্তারের পরামর্শের রেশ ধরে যদি বলা হয়, সংসার শুধু যে রমনীর গুণে তা নয়; বরং দুজনের ছাড় দেওয়ার গুণের উপরে সুখের বিষয়গুলো নির্ভর করে। সেটা হয়ত বাড়িয়ে বলা হবে না। তাছাড়া সংসারে কেই-বা ঝামেলা চায়।
ঝামেলামুক্ত সংসারজীবন চাইলে আপস করতে শিখতে হবে। ভাবছেন কী কী বিষয়ে ছাড় দেবেন! আধুনিক যুগে জীবনের গতিধারা ভিন্ন। অনেক সময় যে জায়গায় আপস করা উচিত সেখানে ছাড় দেওয়ার কথা মনে থাকে না।
স্বামী স্ত্রী কী কী বিষয়ে আপস করবেন সেসব নিয়ে সম্পর্কবিষয়ক একটি ওয়েবসাইটে কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়।
সময় কাটানো
যেমন— সপ্তাহের কোনো না কোনো দিন বন্ধুদের সঙ্গে সময় হয়ত কাটাতে হয়। সাপ্তাহিক বন্ধের দিন হলেও অন্তত একটি দিন সঙ্গীর সঙ্গে কাটান।
পছন্দ অপছন্দ
আপনার পছন্দ বিদেশি কার্পেট, সঙ্গীর পছন্দ শতরঞ্জি। এসব বিষয়ে ঝগড়া না করে বরং দুজনেই মার্কেটে চলে যান। দুজনের যেটা পছন্দ হবে সেটা দিয়েই ঘর সাজান। আর যদি মার্কেটে যেতে আলসেমি লাগে তবে কোনো ইন্টেরিয়র ডেকোরেটরের সাহায্য নিতে পারেন। অথবা পরিচিত এমন কারও পরামর্শ নিন যার গৃহসজ্জায় অভিজ্ঞতা আছে।
সহনশীলতা
আপনি হয়ত গোছাল, জায়গার জিনিস জায়গায় রাখেন। আর আপনার সঙ্গী বড্ড অগোছালো! যেখানে সেখানে জিনিস রেখে দেয়। এই বিষয়ে ঝগড়া করে কোনো লাভ নেই। যার যা অভ্যেস!
বরং এক কাজ করুন, সব ঘর থেকে অপ্রয়োজনীয় জিনিস (সেটা আসবাবও হতে পারে আবার পোশাক বা শোপিস হতে পারে) সরিয়ে ফেলুন। বাড়তি জিনিস যত কম থাকবে অগোছালো ততই কম হবে।
ঘুমের কায়দা
ঘুমের সময় আপনার দরকার অন্ধকার ঘর আর হালকা সংগীত। তবে সঙ্গীর পছন্দ ডিমলাইট আর নীরবতা। কারও পাখার জোর বাতাস লাগে, কারও আস্তে দরকার হয়। সমস্যা মেটাতে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করুন, যাতে দুজনেই ঘুমাতে পারেন।
যার সংগীত পছন্দ না, সে কানে ‘ইয়ার প্লাগ’ ব্যবহার করুন। যার ঘুমের সময় আলো সহ্য হয় না, তিনি চোখের ঢাকনি ব্যবহার করতে পারেন। আর তাও যদি না পারেন তো আলাদা আলাদা ঘরে ঘুমান।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান দ্য ন্যাশনাল স্লিপ ফাউন্ডেশনের মতে শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ দম্পতি, ঘুমের জন্য আলাদা ঘর ব্যবহার করেন।
যৌনজীবন
দম্পতিদের জীবনে এটা অনেকটা সাপ্তাহিক কাজের মতোই ব্যাপার। তবে বিষয় হচ্ছে কেউ চায় সপ্তাহে চারদিন। কেউ চায় একদিন। যদি স্বাস্থ্যগত সমস্যা আর মানসিক চাপ (যেমন অফিসের ঝামেলা) না থাকে তবে বিষয়টা নিজেরাই সমাধান করে নিতে পারেন, দরকার শুধু উদ্যোগ।
দক্ষিণ ফ্লোরিডার সার্টিফায়েড থেরাপিস্ট ব্রি মারিস্কা-ক্রেইমার বলেন, “আসল কথা হল দুজনকেই মাঝামাঝি জায়গায় এসে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
তো আপনিও সেটা করুন।
ছুটি কাটানো
আপনার পছন্দ বালুকা বেলা, নীল সাগর আর সৈকতে আরাম করা। আর সঙ্গীর পছন্দ পাহাড়ে ওঠা, সাগরের গভীরে নেমে সাঁতার কিংবা আরও রোমাঞ্চের খোঁজে সাগরতলে গিয়ে হাঙর দেখা বা গুহায় ঢুকে বাদুর দেখা।
এ রকম পরিস্থিতিতে মারিস্কা-ক্রেইমারের পরামর্শ হচ্ছে, সময়টাকে ভাগ করে ফেলুন। যেখানে সমুদ্র সৈকতে বেশি সময় থাকতেন, সেখানে অর্ধেক সময় কাটান। বাকি সময় সঙ্গীর পছন্দের জন্য ছাড় দিন।
তবে, সঙ্গীর পছন্দ বলেই আপানাকে যে হাঙর দেখার মতো চরম অ্যাডভেঞ্চারে যেতে হবে এর কোনো মানে নেই। খুব বেশি হলে আপনি তার সঙ্গে স্পিড বোটে অথবা গুহামুখ পর্যন্ত যেতে পারেন।
সন্তান লালনপালন
আর বিয়ের পর এই ভাবনা আসলে সন্তান নেওয়ার আগেই বিষয়গুলো নিয়ে সঙ্গীর সঙ্গে আলোচনা করুন।
যদি এই বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে না আসতে পারেন বা ছাড় দিতে না চান তবে শিগগিরই কোনো মনোবিদের পরামর্শ নিন।
ছবি: রয়টার্স।