গর্ভাবস্থায় পুষ্টি

গর্ভবতী হওয়ার পরপরই যে প্রশ্নগুলো মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে শুরু করে তার একটি হল গর্ভকালীন ডায়েট।

জনস্বাস্থ্য পুষ্টিবিদ: আসফিয়া আজিমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Dec 2014, 12:31 PM
Updated : 21 Jan 2015, 02:57 PM

বিশেষ এই শারীরিক অবস্থায় কোন ধরনের খাবার খাওয়া যাবে, কোনটি যাবে না, কোন খাবারটি বেশি পরিমাণে, কোনটা কম করে খেতে হবে— এমন নানান প্রশ্নে মন আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। পাশাপাশি আত্মীয়, বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষীদের হরেক রকম উপদেশ। কোনটা মানবো, কোনটা শুনব, কোনটাকে পাশ কাটাব, এই নিয়ে হরেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব।

এসব দ্বিধা ভুলে জেনে নিন গর্ভাবস্থায় একজন নারীর কী কী পুষ্টির প্রয়োজন এবং তা ঠিক কতটা পরিমাপে।

‘পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট’-এর চার্টটি আপনাকে সঠিক খাবার ঠিক ঠিক পরিমাণে বেছে নিতে সাহায্য করবে।

স্বাভাবিক স্বাস্থ্য

কিলো ক্যালরি: ২০০০

প্রোটিন (গ্রাম): ৪০। ক্যালসিয়াম (মি.গ্রা.) ৪৫০।  আয়রন (মি.গ্রা.) ২৮। ভিট-বি-১ (মি.গ্রা.) ১.০। ভিটা বি-২ (মি.গ্রা.) ১.১। নায়াসিন (মি.গ্রা.) ১৩.২। ভিটা সি (মি.গ্রা.) ৩০। ভিটা-ডি (মাইক্রো) ২.৫। ফলিক অ্যাসিড (মাইক্রো) ২০০।

গর্ভাবস্থায়

কিলো ক্যালরি: ১ম তিন মাস: ২০০০+১৫০। ২য় ও ৩য় তিন মাস: ২০০০+৩৫০।

প্রোটিন (গ্রাম): ৪০+১৪। ক্যালসিয়াম (মি.গ্রা.) ৪৫০+৬৫০।  আয়রন (মি.গ্রা.) ২৮+৫। ভিট-বি-১ (মি.গ্রা.) ১.০+০.১। ভিটা বি-২ (মি.গ্রা.) ১.১+০.২। নায়াসিন (মি.গ্রা.) ১৩.২+১.৯। ভিটা সি (মি.গ্রা.) ৩০+২০। ভিটা-ডি (মাইক্রো) ২.৫+৭.৫। ফলিক অ্যাসিড (মাইক্রো) ২০০+২০০।

কী কী প্রয়োজন

প্রোটিন: গর্ভাবস্থায় শরীরে প্রোটিনের চাহিদা বৃদ্ধি পায় প্রায় এক তৃতীয়াংশ। স্বাভাবিক অবস্থায় শরীরে যে পরিমাণ প্রোটিনের দরকার, এই সময় তা বেড়ে যায় অনেকটা। তাই প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় যেন অতিরিক্ত ১৪ গ্রাম প্রোটিন থাকে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। স্বাভাবিক অবস্থায় আপনার খাদ্যতালিকায় যেসব খাবার ছিল, তার সঙ্গে অতিরিক্ত একটি ডিম, এক বাটি ডাল বা শিমের দানা অথবা এক ঠোঙা বাদাম গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত চাহিদা মেটাতে সক্ষম।

একটি ডিম থেকে ছয়-সাত গ্রাম প্রোটিন পাওয়া যায়। বাদাম থেকে পাওয়া যায় আট গ্রামের মতো প্রোটিন। শিমের দানা ও ডাল থেকেও ১৪ গ্রাম প্রোটিন পাওয়া যায়।

ক্যালসিয়াম: স্বাভাবিক অবস্থায় যতটুকু ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন, গর্ভাবস্থায় এর প্রয়োজন বেড়ে যায় প্রায় ২০০ মি.গ্রামের মতো। গর্ভস্থ ভ্রূণের বৃদ্ধি, নিজের শরীরের দেখভাল এবং বুকের দুধ তৈরিতে অতিরিক্ত ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন।

দুধ, দই, পনির থেকেই এই অতিরিক্ত চাহিদা পূরণ করা যায়। বাটা মাছ, রুই মাছ ইত্যাদিতে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ অনেক বেশি। তবে বেশিরভাগ শুঁটকি মাছ, বিশেষ করে চিংড়ি মাছের শুঁটকিতে, ক্যালসিয়ামের পরিমাণ এতটাই বেশি যে সামান্য পরিমাণে খেলেও এটি গর্ভাবস্থায় দৈনিক চাহিদা মেটাতে সক্ষম।

আয়রন: গর্ভের শিশু তার আয়রন পেয়ে থাকে মায়ের শরীর থেকে। জন্মের পর প্রথম ছয় মাস যেহেতু শিশু কেবল মায়ের দুধ খায় এবং মায়ের দুধে যেহেতু আয়রন থাকে না, ফলে এই ছয় মাস সময়কালের প্রয়োজনীয় আয়রন শিশু নিজের শরীরে জমা করে রাখে তার জন্মের আগেই। আর শিশু তার প্রয়োজনীয় এই আয়রন শোষণ করে মায়ের শরীর থেকে। তাই মায়ের শরীরে যদি আয়রনের ঘাটতি হয় তখন শিশু আর জমা রাখার মতো আয়রন পায় না; যার ফলে জন্মের পরপরই সে আক্রান্ত হয় রক্তাল্পতায়। এ জন্য গর্ভাবস্থায় আয়রনসমৃদ্ধ খাবার খাওয়া এত দরকারি।

আয়রনের সবচেয়ে ভালো উৎস ‘রেড মিট’। এ ছাড়া কচুতেও প্রচুর আয়রন পাওয়া যায়। ফলের মধ্যে কাঁচাআম, পাকা তেঁতুলে আয়রনের পরিমাণ বেশি। শুঁটকি মাছ থেকেও প্রচুর আয়রন পাওয়া যায়। এছাড়া ফুলকপির আগাসহ খেলেও আয়রনের চাহিদা পূরণ হয়।

ভিটামিন বি-১, বি-২ ও নায়াসিন: ভিটামিন-বি পরিবারভুক্ত ছয়টি ভিটামিনের মধ্যে গর্ভাবস্থায় চাহিদা বেড়ে যায় ভিটামিন বি-১ বা থায়ামিন, বি-২ বা রিবোফ্লাবিন ও বি-৩ বা নায়াসিনের। বি-ভিটামিন ডায়জেস্টিভ সিস্টেমকে চালু রাখে। ক্লান্তি কমাতে সাহায্য করে। পাশাপাশি চামড়ার শুষ্কভাব কমিয়ে সতেজ রাখে। গর্ভাবস্থায় যেহেতু হরমোনের পরিবর্তনের কারণে পেট, কোমর, গলা-এসব জায়গার চামড়ার রং পরিবর্তন হয়, পেটের চামড়া স্ফিত হওয়ায় টান লাগে, তাই বি-ভিটামিন এই সময় চামড়ার দেখভালে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

‘রেড মিট’, কলিজা, ডিম, কলা, কিডনি, বিনস, পালংশাক, কাঠবাদাম ও দুধে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি পাওয়া যায়।

ভিটামিন সি: আয়রন শোষিত হওয়ার জন্য ভিটামিন সির প্রয়োজন। এ জন্য ডাক্তার বা পুষ্টিবিদেরা আয়রনসমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার পরপরই লেবু, কমলা, বাতাবিলেবু বা আমলকী খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় পাওয়া যাচ্ছে ভ্রূণের মানসিক বৃদ্ধিতে ভিটামিন-সি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ভিটামিন-সি ফলিক অ্যাসিডকে কার্যকর করে তোলার চালিকাশক্তি।

গর্ভের শিশুর মাংসপেশি ও হাড় গঠনের কোলাজেন প্রোটিনের প্রয়োজন। ভিটামিন-সি কোলাজেন তৈরিতেও সাহায্য করে।

ভিটামিন ডি: ভিটামিন ডি মায়ের শরীরে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে। ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের সুষম ব্যালেন্স শিশুর হাড় ও দাঁত তৈরিতে সাহায্য করে। সে কারণে গর্ভবস্থায় ডিম, দুধ, পনির, দুই ও ছোট মাছ খাওয়া খুব দরকার এবং বেশি পরিমাণে।

ফলিক অ্যাসিড: স্বাভাবিক অবস্থার থেকে দ্বিগুণ পরিমাণে ফলিক অ্যাসিডের প্রয়োজন গর্ভবতী অবস্থায়। ফলিক অ্যাসিড খুব বেশি পরিমাণ পাওয়া যায় ব্রোকলি, ডাল ও পালংশাকে। এছাড়া, বাঁধাকপি, ফুলকপি, কমলা, মটরশুঁটি ও হোলগ্রেইন রুটিতেই ফলিক অ্যাসিডের পরিমাণ ভালো।

মনে রাখা প্রয়োজন, গর্ভাবস্থায় প্রায় সব ধরনের পুষ্টি উপাদানের প্রয়োজনীয়তাই বেড়ে যায়। কোনো কোনো ভিটামিন বা মিনেরালের চাহিদা দ্বিগুণ বা তিনগুণও হয়ে পড়ে। তবে সব ধরনের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করতে গেলে যে পরিমাণ খাবার খাওয়া দরকার তা সব সময় খাওয়া সম্ভব হয় না। এ কারণে গর্ভাবস্থায় এমন খাবার বেছে নেওয়া জরুরি, যাতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, মিনেরাল পাওয়া যায়। এতে করে পরিমাণে কম খেলেও পুষ্টির ঘাটতিতে কোনো কমতি হবে না।

ছবি সৌজন্যে: সাদাকালো।