'মেনোপজ' মানেই শেষ নয়!

বয়স ৪৫ থেকে ৫০, কি ৫৫! এই বয়সের নারীদের শরীরে বেশ কিছু পরিবর্তন আসে। খিটখিটে মেজাজ, অবসাদ, ক্লান্তি যেন এই বয়সী নারীদের নিত্য সঙ্গী হয়ে দাঁড়ায়। আর এর মূল কারণ এই বয়সেই সাধারণ জীবনের দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করে ‘মেনোপজ’ বা রজঃনিবৃত্তি।

ইরা ডি. কস্তাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Sept 2014, 11:14 AM
Updated : 20 Sept 2014, 11:14 AM

এ সময় শারীরিক নানান ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকেন নারীরা। রাতে ঠিক মতো ঘুম না হওয়া, কাজে আগের মতো স্বতঃস্ফূর্ত ‌না থাকা আর অবসাদ তো আছেই। শরীরের এমন পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গিয়ে হিমশিম খান বেশিরভাগ নারী। মনে করেন ‘এইতো বুড়ি হয়ে গেলাম, জীবন এখানেই শেষ’।

‘মেনোপজ’ মানে কি আসলেও জীবনের অন্তিম মোড়! এক সময় এই অবস্থাকে অনেকটা সে দৃষ্টিতেই দেখা হতো। তবে আধুনিক নারীদের তো আর মেনোপজের কারণে প্রতিদিনের কাজ ফেলে বিলাপ করার সময় নেই। তাই এ সময়ের শারীরিক পরিবর্তনগুলোর সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে বেশ বেগ পেতে হয় তাদের।

নিজেকে ব্যস্ত রাখা আর বন্ধুর সঙ্গে সময় কাটানো এই সময় মানসিক শান্তি দিতে পারে। ছবি: শর্মিলী আহমেদ এবং ওয়াহিদা মল্লিক জলি / রঙ 'শ্রদ্ধা'।

আর তাদের জন্যই এ সময় কি ধরনের পরিবর্তন এবং সমস্যা হতে পারে আর এর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার বিষয়গুলো জানা থাকা জরুরি।

ফ্রেন্ডস অফ বাংলাদেশ/ইউএসএ হাসপাতালের গাইনি ও ফ্যামিলি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লিন্ডা সুপর্ণা সমাদ্দার মেনোপজের বিষয়ে বিস্তারিত জানান।

তিনি বলেন, “একটা বয়সে যখন নারীদের মেনস্ট্রুয়েশন বন্ধ হয়ে যায় তাকে মেনোপজ বলে। এই সময় ওভারিতে ডিম্বাণুর সংখ্যা একদম কমে যায়, ফলে নিয়মিত পিরিয়ড বন্ধ হয়ে যায়।”

জন্মের সময় মেয়েদের ওভারিতে নির্দিষ্ট পরিমাণ ডিম্বাণু থাকে আর পিরিয়ড শুরু হওয়ার পর প্রতি মাসে ডিম্বাণু নিঃসৃত হয়। বয়স ৫০ পার হলে ওভারিতে ডিম্বাণু শেষ হয়ে যায় ফলে মেনস্ট্রুয়েশন বন্ধ হয়ে যায়। আর এটাই হলো মেনোপজ।

পিরিয়ড বন্ধের কয়েক বছর আগে থেকেই মেনোপজের লক্ষণ দেখা যায়। ৫০ বছর বয়সের পর মেনোপজ হলে একে বলা হয় ‘নরমাল মেনোপজ’। যদি ৪০ পেরোবার আগেই কোনো নারীর মাসিক বন্ধ হয়ে যায় তাহলে তাকে বলে ‘প্রিম্যাচিওর মেনোপজ’। আবার যদি কোনো কারণে অপারেশন করে ওভারি বাদ দেওয়া হয় তাহলেও মেনোপজ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। একে বলা হয় ‘সার্জিকাল মেনোপজ’।

মেনোপজের লক্ষণ

ডা. সুপর্ণা বলেন, “সবার ক্ষেত্রে এর লক্ষণ এক রকম হয় না। তবে মেনোপজের কিছু সাধারণ লক্ষণ রয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নারীরা বুঝতে পারেন যে তাদের মাসিকের পরিমাণ কমে এসেছে।"

ব্লিডিংয়ের পরিমাণ কমে আশার পাশাপাশি মাসিকের স্থায়িত্বও কমে যায়। সাধারণত টানা ১২ মাস যদি পিরিয়ড না হয়, তাহলে বুঝতে হবে মেনোপজ হয়ে গেছে।

“এ ছিলো মেনোপজ হওয়ার সময়ে মেনস্ট্রুয়াল পরিবর্তন। এছাড়া এই সময় আরও বিভিন্ন ধরনের উপসর্গ দেখা যায়। এর মধ্যে অন্যতম ‘হট ফ্লাশ’।"

হঠাৎ করে মনে হবে শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে গরম হল্কা বের হচ্ছে। ‘নাইট সোয়েট’- মাঝে মাঝে রাতে ঘুম ভেঙে যেতে পারে আর সারা শরীরে ঘাম হতে পারে, মুড সুইং হয় ও অবসাদ দেখা দেয়।

"তাছাড়া এ সময় খুব জলদি হাপিয়ে ওঠেন নারীরা। ডিপ্রেশন, চিড়চিড়ে মেজাজ, ভ্যাজাইনাল ড্রাইনেস ও ঘন ঘন বাথরুম হওয়া এ সবই মেনোপজের উপসর্গ।” বলেন, ডা. সুপর্ণা।

প্রভাব

মেনোপজ সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে নারীর হাড়ে। একে বলে অস্টিওপোরেসিস। কারণ মেনোপজের কারণে হাড়ের ক্যালশিয়াম কমতে শুরু করে। তাই হাড় দুর্বল হয়ে যায়। আর খুব সামান্য আঘাত বা হোঁচটেও বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে। বিশেষ করে কোমর এবং কোমরের নীচের দিকের হাড় খুবই দুর্বল হয়ে যায়। তাই বেশিরভাগ নারীই কোমরের ব্যথায় ভুগে থাকেন। জানালেন ডা. সুপর্ণা।

মেনোপজের উপসর্গগুলো দেখা দেওয়ার পরই বেশিরভাগ নারীই ভাবতে শুরু করেন যে, তিনি বুড়ো হয়ে গেছেন। এটা একেবারেই ঠিক নয়। এরপরও জীবনের অনেকটা সময় বাকি থাকে। মেনোপজ কোনো অসুখ নয়, এটি নারীর জীবনের অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ। তাই এর কোনো চিকিৎসাও হয় না।

সুন্দর সহচার্য এই সময়ের মানসিক সমস্যা অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে। ছবি: শর্মিলী আহমেদ এবং ওয়াহিদা মল্লিক জলি / রঙ 'শ্রদ্ধা'।

মেনোপজের শারীরিক উপসর্গগুলো বেশ অস্বস্তিকর, তবে মনের উপর এর প্রভাব আরও বেশি। অনেক নারীই শারীরিক পরিবর্তনগুলো চট করে মেনে নিতে পারেন না। আর এ কারণে নানান ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা দেয়।

যে নারীরা স্বামী, সংসার ও সন্তানদের নিয়েই বেশি সময় কাটিয়ে জীবনের বেশিরভাগ সময় পার করেছেন তাদের সঙ্গে এ সময় স্বামী ও সন্তানদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়। কারণ মধ্যবয়স্ক একজন নারীর স্বামীরাও তাদের কর্মজীবন নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। অন্য দিকে সন্তানরাও বড় হয়ে নিজেদের জীবন নিয়ে ব্যস্ত। আর তাই তিনি একা হয়ে যান। আর ওই সময়ই মেনোপজের কারণে মানসিক অবস্থার আরও অবনতি ঘটে।

বরাবরই তাদের মধ্যে ভর করে একাকিত্ব। ডা. সুপর্ণা জানান, মনোবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় ‘এম্পটি নেস্ট সিন্ড্রোম’। আর এ পরিস্থিতি থেকে নিজেকে বাঁচাতে নারীর নিজের একটি আলাদা স্থান তৈরি করে নেওয়া উচিত।

ভালো থাকার চেষ্টা

সময়ের অভাবে এক সময় যে শখগুলো পূরণ করা হয়নি সেগুলো নতুন করে শুরু করা যেতে পারে। নতুন কোনো ভাষা শেখা, গান বা কোনো বাদ্যযন্ত্র বাজাতে শেখা, রান্না শেখা, সেলাই শেখা, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা বা ছুটি কাটাতে যাওয়া— ইত্যাদি যে কোনো উপায়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করাই আসল উদ্দেশ্য। নিজের জীবনকে সুন্দর করে গুছিয়ে নিতে পারলে মেনোপজের সময়ও এর প্রভাব থেকে নিজেকে আলাদা রাখা যাবে।

মেনোপজের বিভিন্ন শারীরিক এবং মানসিক লক্ষণ যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় তাহলে চিকিৎসা করানো উচিত।

ডা. সুপর্ণা বলেন, “হট ফ্লাশ বা নাইট সোয়েট, ডিপ্রেশন, ঘুমের সমস্যা যদি বেশি দিন চলে তাহলে এর থেকে রেহাই পেতে হরমোন ট্রিটমেন্ট করানো যেতে পারে। ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোন কম ক্ষরণ বা ক্ষরণ না হওয়ার কারণেই মেনোপজ হয়। এই হরমোনগুলো প্রতিস্থাপন করা হলেই সমস্যার অনেকটা সমাধান করা যায়। তবে এটি যথেষ্ট সময় সাপেক্ষ এবং খরচ সাপেক্ষ একটি চিকিৎসা প্রক্রিয়া।”

“আমাদের দেশের অল্প শিক্ষিত বা অশিক্ষিত সমাজে বেশিরভাগ নারীই মেনোপজের বিষয়ে জানেন না। আর তাই তাদের মধ্যে কিছু ভুল ধারণা কাজ করে।" বললেন ডা. সুপর্ণা।

এই গাইনি চিকিৎসক আরও বলেন, "এটি নারীর জীবনের সাধারণ একটি ঘটনা, এবং প্রত্যেক নারীর জীবনেই এই মোড় আসে, এ বিষয়টি তারা বুঝেন না এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে জানেনও না। এ কারণে তারা নানান রকম ওষুধ খেয়ে থাকে এবং ইনজেকশন নেন। আর এগুলোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় তাদের আরও বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে।”

মেনোপজের সময় ‘এম্পটি নেস্ট সিন্ড্রোম’-এর কারণে অনেক নারীই ভাবতে শুরু করেন স্বামী এবং সন্তানদের কাছে তিনি অনাকাঙ্ক্ষিত একজন। সেখান থেকে তৈরি হয় বিরক্তি ও ডিপ্রেশন। অল্পেই রেগে যাওয়া, খিটখিটে মেজাজ— নিজেকে সামলাতে না পারলে এগুলোর পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে।

আবার কোনো কোনো নারীর মধ্যে অতিরিক্ত সন্দেহপ্রবণতা দেখা যায়। নিজেকে অসহায় ভাবতে শুরু করা, এ সময় সবচাইতে গুরুতর লক্ষণ। আর এসব কারণে দৈনন্দিন কাজেও ব্যঘাত ঘটে।

দেখা যায়, মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ার কারণে প্রতিদিনকার কাজও ঠিক মতো করতে পারছেন না মধ্য বয়সী একজন নারী। আর তার কাছ থেকে আগের মতো স্বতঃস্ফুর্ততা না পেয়ে স্বামী এবং পরিবারের অন্যরাও একটু বিরক্ত হন।

তবে পরিবারের সদস্যদেরও একজন নারীর ওই সময়ের মানসিক অবস্থা বুঝতে হবে। তাদের বুঝতে হবে এই পরিস্থিতি খুবই সাময়িক। দু’তিন বছরের মধ্যেই আবারও এ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

ডা. সুপর্ণা বলেন, “এ ধরনের মানসিক পরিস্থিতিতে স্বামী এবং পরিবারের সহযোগিতা খুবই জরুরি। স্বামী যদি স্ত্রীর মানসিক অবস্থা সম্পর্কে কিছুটা বুঝে তাকে সাহায্য করেন তাহলে মানসিক অস্থিরতা কিছুটা কম হয়। সারাদিন পর এক সঙ্গে গল্প করা বা পছন্দের জায়গায় ঘুরতে যাওয়া এ ধরনের মানসিক পরিস্থিতিতে খুবই কার্যকর।”

মেনোপজের কারণে শরীরে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি দেখা দেয়। তাই এ সময় খাবারের ব্যাপারে বিশেষ নজর দিতে হবে। আর মাঝ বয়সে সব ধরনের খাবারও খাওয়া যায় না। তাই নিয়ম করে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।

“এ সময় ভালো ‘প্রোটিন’ এবং ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার অভ্যাস তৈরি করা উচিত। তাছাড়া ভিটামিন বি কমপ্লেক্সও খেতে হবে। কিডনি বিন, হোলগ্রেইন আটার রুটি, মুরগির মাংস, কলিজা, লাল চালের ভাত, ব্রকলি, সবুজ শাকসবজি ইত্যাদি খাবার থাকতে হবে খাবারের তালিকায়। তাছাড়া ক্যালসিয়াম ও হার্ট ভালো রাখতে গরুর দুধ খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে।” বললেন ডা. সুপর্ণা।

কিছুটা সচেতন থাকলে, মেনোপজ সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকলে এবং পরিবারের সহায়তা পেলে, এই সময়ের মানসিক অবস্থা থেকে নিজেকে কিছুটা হলেও যে কোনো নারী সুস্থ রাখতে পারবেন।