বয়সকালে হাড়ের সন্ধিস্থলে ও মাংসপেশিতে ব্যথা হয়। যাকে সহজ ভাষায় বাতের ব্যথা বলা হয়।
Published : 28 May 2014, 09:06 AM
অনেকে মনে করেন শীতে বাতরোগ হয়। আসলে ঠাণ্ডার সময় বাতরোগ হয় না বরং রোগীর ব্যথা শীতে বাড়ে। গরমকালে বাতের ব্যথার তীব্রতা কিছুটা কমতে পারে।
বাতের ব্যথা কোনো রোগ নয়, এটা বিভিন্ন রোগের উপসর্গ মাত্র। এই বিষয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন রাজধানীর মোহাম্মদপুরের ডিপিআরসি হাসপাতালের ফিজিওথেরাপি ও পূর্ণবাসন বিশেষজ্ঞ ডাঃ মোঃ সফিউল্যাহ্ প্রধান।
বাতব্যথার রোগীর ঠাণ্ডা লাগলে ব্যথা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। তখন ডাক্তারের পরার্মশে বা রোগী নিজেই ব্যথার জায়গায় গরমভাপ দিলে এবং কুসুম গরম পানিতে গোসল করলে, অনেকটা আরাম বোধ করেন। এখানে ‘শীত’ ডাক্তারি ভাষায় ‘প্রিডিসপোজিং ফ্যাক্টর’ হিসেবে কাজ করে।
এখন গরমকাল। মাঝে মাঝে বৃষ্টি হচ্ছে। ঘনঘন আবহাওয়ার এই পরিবর্তনে ঠাণ্ডা লেগে জ্বর-কাশি হচ্ছে। যাদের বাতের সমস্যা রয়েছে সর্দিগরমিতে তাদের সমস্যা বাড়তেই পারে।
দীর্ঘদিন যারা এই ব্যথায় আক্রান্ত, তারা দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে রোগ নির্ণয় করে সঠিক ও আধুনিক ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা নিলে আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠবেন।
সাধারণত চল্লিশোর্ধ মহিলা ও পঞ্চাশোর্ধ পুরুষ বয়সজনিত শরীরের জয়েন্টের সমস্যা বা সন্ধিস্থলের ব্যথায় ভুগে থাকেন।
আমাদের দেশে পঞ্চাশোর্ধ বয়সী জনসংখ্যার শতকরা ৬৫ ভাগ লোক ব্যথা জনিত সমস্যায় ভোগেন। বিশেষ করে যেসব সন্ধিস্থল শরীরের ওজন বহন করে এবং অতিরিক্ত ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে ঘাড়, কোমর, কাঁধ বা সোল্ডার জয়েন্ট এবং হাঁটুব্যথার রোগী সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়।
বাতব্যথার অনেক কারণের মধ্যে রয়েছে ‘মেকানিকেল সমস্যা’। মেকানিকেল সমস্যা বলতে মেরুদণ্ডের মাংসপেশি, লিগামেন্ট মচকানো বা আংশিক ছিড়ে যাওয়া, দুই কশেরুকার মধ্যবর্তী ডিক্স সমস্যা ও কশেরুকার অবস্থানের পরিবর্তনকে বোঝায়।
অন্যান্য কারণের মধ্যে আছে— বয়সজনিত হাড় ও জোড়ার ক্ষয় বা বৃদ্ধি, রিউমাটয়েড আথ্রাইটিস বা গেঁটেবাত, অস্টিওআথ্রাইটিস, অস্টিওপোরোসিস, এনকাইলজিং স্পন্ডাইলোসিস, বার্সাইটিস, টেন্ডিনাইটিস, স্নায়ুবিক রোগ, টিউমার, ক্যান্সার, মাংসপেশির রোগ, শরীরে ইউরিক এসিড বেড়ে গেলে, অপুষ্টিজনিত সমস্যা, শরীরের অতিরিক্ত ওজন ইত্যাদি।
এভাবে চলতে থাকলে ধীরে ধীরে রোগী তার দেহের হাড়ের জোড়ার কর্মক্ষমতা বা নড়াচড়ার ক্ষমতা হারায় এবং জোড়া সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে রোগী পঙ্গুত্ব বরণ করতে পারে। অনেক সময় দীর্ঘদিন রোগেভোগে শরীরের মাংস পেশীগুলোও শুকিয়ে যেতে পারে।
তাই বাতের ব্যথা নিয়ে কষ্ট না পেয়ে যতদ্রুত সম্ভব চিকিৎসা নিতে হবে এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যারা বাতের ব্যথায় ভুগছেন তারা একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চিকিৎসা ও পরামর্শে ভালো থাকতে পারেন। ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা বাতব্যথার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া বিহীন অত্যন্ত আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি।
ডাক্তার রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা ও পরামর্শ দিলে অবশ্যই বাতের কষ্ট থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব।
যেহেতু ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসকের কলাকৌশল নির্ভর। তাই দেখেশুনে ভালো ফিজিওথেরাপি সেন্টারে চিকিৎসা ও পরামর্শ নেওয়া উচিত।
মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস হয় না, ডায়াবেটিস হলে মিষ্টি খাওয়া নিষেধ। তেমনি, যাদের বাতের ব্যথা বা অস্থিসন্ধির সমস্যায় ভুগছেন তাদেরও কিছু কাজ করা একদম নিষেধ।
নিচের পরামর্শগুলো ঠিকমতো মেনে চললে বাতের ব্যথা থেকে অনেকাংশে মুক্ত থাকা সম্ভব।
* ব্যথা বেশি হলে সাতদিন সম্পূর্ণ বিশ্রাম নিন।
* ব্যথার জায়গায় গরম/ঠাণ্ডা ভাপ দিবেন ১০ থেকে ১৫ মিনিট।
* বিছানায় শোয়া ও উঠার সময় যেকোনো একদিকে কাত হয়ে হাতের উপর ভর দিয়ে শোবেন ও উঠবেন।
* মেরুদণ্ড ও ঘাড় নিচু করে কোনো কাজ করবেন না।
* নিচু জিনিস যেমন- পিড়া, মোড়া বা ফ্লোরে না বসে চেয়ারে পিঠ সাপোর্ট দিয়ে মেরুদণ্ড সোজা করে বসবেন।
* ফোম ও জাজিমে না শুয়ে, উঁচু শক্ত সমান বিছানায় শোবেন।
* মাথায় বা হাতে ভারী ওজন বা বোঝা বহন নিষেধ।
* দাঁড়িয়ে বা চেয়ারে বসে রান্না করবেন।
* চিকিৎসকের নির্দেশমতো দেখানো ব্যায়াম নিয়মিত করবেন, ব্যথা বেড়ে গেলে ব্যায়াম বন্ধ রাখবেন।
* শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখবেন, পেট ভরে খাওয়া নিষেধ, অল্প অল্প করে বার বার খাবেন। প্রতিবার খাবারের আগে দুই গ্লাস পানি পান করুন।
* লাল মাংস অর্থাৎ চার পা বিশিষ্ট পশুর মাংস, দোকানের কেনা মিষ্টি, ডাল ও ডালজাতীয় খাবার, ঘি, ডালডা, চর্বি, ফাস্টফুড— এগুলো শরীরের ওজন বাড়ায়। তাই যাদের ওজন বেশি তাদের এসব খাবার খাওয়া নিষেধ।
* কোনো প্রকার মালিশ করা নিষেধ।
* অনেক্ষণ এক জায়গায় বসে বা দাঁড়িয়ে থাকবেন না, এক ঘন্টা পর পর অবস্থান বদলাবেন।
* শোবার সময় একটি পাতলা নরম বালিশ ব্যবহার করুন।
* হাই হিল যুক্ত জুতা ব্যবহার করবেন না, নরম জুতা ব্যবহার করবেন।
* ব্যথা তীব্র হলে উঁচু কমোডে বসে টয়লেট করুন।
* চলাফেরায় ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন ও রাস্তা এড়িয়ে চলবেন। সামনের বা মাঝামাঝি আসনে বসবেন।
* ব্যথা কমে গেলে নিয়মিত সমতল জায়গায় কমপক্ষে এক থেকে দুই ঘন্টা হাঁটুন।