এই বিষয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন রাজধানী আদাবরের ডিপিআরসি হাসপাতালের চেয়ারম্যান ও ফিজিওথেরাপি বিশেষজ্ঞ ডা. মোঃ সফিউল্যাহ্ প্রধান।
কেইস স্টাডি
১. আলতাফ হোসেন উচ্চরক্তচাপ জনিত সমস্যায় ভুগছিলেন। বিকেল বেলা হটাৎ তার মুখ বেঁকে যায়। মুখ দিয়ে লালা ঝড়তে থাকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিনি অজ্ঞান হয়ে পরে যান। পরে তার ডান হাত ও পা অবশ হয়ে যায়।
২. ভালো মানুষটা রাতে ঘুমালেন, সকালে উঠে দেখি এক পাশের হাত-পা নাড়াতে পারছেন না।
স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগী সম্পর্কে তাদের পরিচিতজনের বর্ণনা সাধারণত এরকমই হয়ে থাকে।
পৃথিবীতে প্রতি ছয় সেকেন্ডে একজন স্ট্রোকে মারা যায়। স্ট্রোকের ফলে মানুষ হারাচ্ছে কার্যক্ষমতা এবং ব্যয় হচ্ছে প্রচুর অর্থ। শুধুমাত্র ভুল চিকিৎসার কারণে স্ট্রোক আক্রান্ত রোগী হয়ে যাচ্ছে শারীরিক, মানসিক ও কর্মক্ষেত্রে অক্ষম।
আমাদের দেশে প্রচলিত একটি ধারণা আছে, হার্ট বা হৃদপিণ্ডে স্ট্রোক হয়। আসলে এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। স্ট্রোক একটি মস্তিস্কের রক্তনালীর জটিলতা জনিত রোগ। আসুন এবার জেনে নেয়া যাক স্ট্রোক কি, কেন হয় এবং স্ট্রোক রোগীর ক্ষেত্রে ফিজিওথেরাপির প্রয়োজনীয়তা।
স্ট্রোক কী
কোনো কারণে মস্তিস্কের নিজস্ব রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হওয়ার ফলে স্নায়ুকোষ নষ্ট হয়ে যাওয়াকে স্ট্রোক বলে। স্ট্রোককে চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় ‘সেরিব্রো ভাসকুলার অ্যাকসিডেন্ট’ বলা হয়। যা বাংলা করলে দাঁড়ায়, মস্তিস্কের রক্তনালী দূর্ঘটনা।
মস্তিস্কের বিভিন্ন অংশ শরীরের বিভিন্ন কাজের জন্য নির্দিষ্ট থাকে। তাই মস্তিষ্কের কোথায়, কতটুকু আক্রান্ত হয়েছে তার উপর নির্ভর করে স্ট্রোকের ভয়াবহতা।
স্ট্রোকের কারণ
সাধারণত দুটি কারণে স্ট্রোক হয়ে থাকে
১. মস্তিস্কের রক্তনালীতে কোনো কিছু জমাট বাধলে। যার ফলে রক্তের নালী বন্ধ হয়ে যায় এবং মস্তিস্কের আক্রান্ত স্মায়ুকোষগুলো অক্সিজেনের অভাবে মারা যায়।
২. মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ ঘটলে। উচ্চ রক্তচাপ এই স্ট্রোকের অন্যতম কারণ। যেখানে ছোট ছোট রক্তনালী ছিঁড়ে রক্তক্ষরণ হয়। ফলে মস্তিস্কের মধ্যে চাপ বেড়ে যায় এবং অক্সিজেনের অভাবে মস্তিস্কের স্মায়ুকোষগুলো মারা যায়।
স্ট্রোক এর প্রাথমিক উপসর্গ
স্ট্রোকের প্রাথমিক ৫টি উপসর্গ দেখা যায়:
১. হঠাৎ অতিরিক্ত মাথা ব্যাথা।
২. হঠাৎ মুখ, হাত ও পা অবশ হয়ে যাওয়া (সাধারণত শরীরের যে কোনো এক পাশ)। অনেক সময় মুখের মাংসপেশি অবশ হয়ে যায়, ফলে লালা ঝড়তে থাকে।
৩. হঠাৎ কথা বলতে এবং বুঝতে সমস্যা হওয়া।
৪. হঠাৎ এক চোখে অথবা দুই চোখে দেখতে সমস্যা হওয়া।
৫. হঠাৎ ব্যালান্স বা সোজা হয়ে বসা ও দাঁড়াতে সমস্যা হওয়া, মাথা ঘুরানো এবং হাঁটতে সমস্যা হওয়া।
স্ট্রোক পরবর্তী সমস্যা
শরীরের এক পাশ অথবা অনেক সময় দুই পাশ অবশ হয়ে যায়। মাংসপেশীর টান প্রাথমিক পর্যায়ে কমে যায় এবং পরে আস্তে আস্তে টান বাড়তে থাকে। হাত ও পায়ে ব্যাথা থাকতে পারে। সেই সঙ্গে নড়াচড়া সম্পূর্ণ অথবা আংশিকভাবে কমে যেতে পারে। মাংসপেশী শুকিয়ে অথবা শক্ত হয়ে যেতে পারে, হাঁটাচলা, ওঠাবসা, বিছানায় নড়াচড়া, ইত্যাদি কমে যেতে পারে।
ফলে চাপজনিত ঘা দেখা দিতে পারে, শোল্ডার বা ঘাড়ের জয়েন্ট সরে যেতে পারে ইত্যাদি।
স্ট্রোক হওয়ার সম্ভবনা
বয়স সাধারণত পঞ্চাশের উপরে হলে, বংশে স্ট্রোক রোগী থাকলে, উচ্চ রক্তচাপ থাকলে, উচ্চ কোলস্টেরল লেভেল থাকলে, ধূমপায়ী হলে, ডায়াবেটিস থাকলে, আগে একবার স্ট্রোক করলে, অ্যালকোহলিক হলে, রক্তের নালীতে কোনো সমস্যা থাকলে।
স্ট্রোক প্রতিরোধের উপায়
উচ্চ রক্তচাপ সম্পর্কে জানা, রক্তনালীর কোনো ধরনের সমস্যা থাকলে তার চিকিৎসা করা, ধূমপান বন্ধ করা, কোলস্টেরল, সোডিয়াম এবং ফ্যাটের পরিমান নিয়ন্ত্রনে রাখা, চর্বি ও শর্করাজাতীয় খাবার (যেমনঃ ফাস্টফুড, মাখন, ঘি, মিষ্টি, পোলাও, গরু-খাশির মাংস, চিংড়ি, ডিমের কুসুম ইত্যাদি) কম খাওয়া, অ্যালকোহল সেবন থেকে বিরত থাকা, ডায়াবেটিস এর সঠিক চিকিৎসা করা, নিয়মিত ৪৫ মিনিট হাঁটা বা ব্যায়াম করা, অতিরিক্ত অষুধ সেবন না করা।
চিকিৎসা পদ্ধতি
তাই স্ট্রোক আক্রান্ত রোগীকে যত দ্রুত সম্ভব নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যাবেন এবং ২৪ ঘন্টার ভেতরে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা শুরু নিশ্চিত করবেন। মনে রাখবেন, স্ট্রোকের পর যত দ্রুত ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা শুরু করা যাবে, রোগীর কার্যক্ষমতা ফিরে আসার সম্ভাবনা তত বেশি থাকে।
ফিজিওথেরাপি দৈনিক ৩ থেকে ৪ বার করে দিতে হতে পারে। বাসায় একবার করে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা নিয়ে তেমন কোনো ফল আসে না। তাই রোগীকে ক্লিনিক বা হাসপাতালে ভর্তি রেখে ফিজিওথেরাপি চালিয়ে যাওয়াই ভালো।
শুরু থেকে ফিজিওথেরাপি চালু থাকলে ২ থেকে ৩ মাসে রোগী আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। বিশেষজ্ঞ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক রোগীর শারীরিক অবস্থা মূল্যায়ন করে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা দিয়ে থাকেন।
এ ক্ষেত্রে একিউট ও ক্রনিক স্টেইজ— এই ভাবে দুই রকম চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। প্রতি মুহূর্তেই রোগীর দৈহিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে হয়।
ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। যেমনঃ মবিলাইজেশন এক্সার সাইজ, পশ্চারাল চেনজেস, স্ট্রেচ রিফ্লেক্স, রেইনজ অফ মোশন এক্সার সাইজ, পশচারাল ইনহিবিশন এক্সার সাইজ, ইত্যাদি।
এসব বৈজ্ঞানিক পুনর্বাসন চিকিৎসার মাধ্যমে রোগী ধীরে ধীরে কর্মক্ষম ও সুস্থ হয়ে ওঠে। অনেক ক্ষেত্রে ইলেক্ট্রোথেরাপির প্রয়োজন হতে হবে। তাই ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা যেখানে সেখানে বা কোনো টেকনোলজিস্ট বা টেকনিশিয়ানের দিয়ে না নিয়ে ফিজিওথেরাপি বিশেষজ্ঞদের সম্পূর্ণ তত্ত্বাবধানে নিতে হবে।
তাহলে রোগী অবশ্যই ভুল চিকিৎসা থেকে বেঁচে যাবেন। আর একটি স্বাভাবিক কর্মক্ষম জীবন ফিরে পাবেন।
যারা দীর্ঘদিন প্যারালাইসিসে আক্রান্ত তাদের শারীরিক পুনর্বাসনের পাশাপাশি মানসিক পুনর্বাসনও দরকার হতে পারে। সে ক্ষেত্রে প্রয়োজনে একজন মানসিকরোগ বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেওয়া উচিত।