মাতৃত্বকালীন সেবা

একেক দেশে একেক সময়ে মা দিবস পালন করা হয়। মায়ের প্রতি আলাদা করে সম্মান জানানোর জন্য এই উৎসব। অথচ মা হওয়ার সময়টাই যে কোনো মেয়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সন্তান ধারণের জন্য মানসিক থেকে শারীরিক— সবরকম প্রস্তুতি নিতে হয় মাকেই।

প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 May 2014, 02:43 AM
Updated : 11 May 2014, 10:54 AM

আর তাই এ সময়েই একজন মায়ের সবচেয়ে বেশি যত্নের প্রয়োজন।

এ ব্যাপারে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. মো. কামরুল হাসান বলেন, “সন্তান নিতে হলে প্রথমেই মা-বাবাকে মানসিক প্রস্তুতি নিতে হয়। দুজনের বোঝাপড়ার পাশাপাশি পারিবারিকভাবেও সম্মতির দিকটা ভেবে দেখতে হয়।”

হরমোন রোগে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেওয়া মোহনা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের এই ডাক্তার আরও বলেন, “মা অথবা বাবার কারো মধ্যে যদি সন্তান নেওয়ার ইচ্ছা না থাকে, কিংবা পারিবারিকভাবে চাচ্ছে তবে স্বামী-স্ত্রীর ইচ্ছা নেই— এরকম অবস্থায় শরীরের হরমোন ঠিকমতো কাজ করে না। ফলে প্রেগনেনসিও হয় না।”

“তাই ভবিষ্যতের সুস্থ প্রজন্মের জন্য গর্ভধারণের আগে থেকেই মায়ের যত্ন প্রয়োজন। আর এ জন্য স্বামীর পাশাপাশি পারিবারিকভাবেও সাপোর্টের দরকার হয়।” বললেন ডা. কামরুল।

তিনি আরও বলেন, “সাধারণ ১৮ বছরের পরেই একজন মেয়ে, মা হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। তবে আমরা বলি ২০ এর পর অর্থাৎ ২৫ বছর বয়স থেকে সন্তান ধারণ করা উচিত। ওদিকে মেনোপজ হওয়ার আগ পর্যন্ত মা হওয়া সম্ভব। তবে ত্রিশের উপর যত বেশি বয়স হবে ততই মা হওয়ার বিষয়টা জটিল হতে থাকে।”

ত্রিশোর্ধ মহিলাদের গর্ভধারণের আগে ব্লাড প্রেসার, ডায়াবিটিস, থাইরয়েড সমস্যা, স্থূলতা ইত্যাদি বিষয়ে আগাম পরীক্ষা করে নেওয়া উচিত।

মাতৃত্বকালীন সময়ে কি ধরনের যত্নের প্রয়োজন সেই বিষয়েও বিস্তারিত জানালেন এই চিকিৎসক।

গর্ভধারণের আগে প্রাথমিকভাবে কিছু পরীক্ষা করা হয়। যেমন রক্তশূণ্যতা আছে কিনা, যৌনবাহিত কোনও রোগ আছে কিনা, হেপাটাইটিস ইত্যাদি।

যদি আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে হয় তবে সন্তানের থ্যালাসিমিয়া বা রক্তরোগ এবং জন্মত্রুটি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সুস্থ সন্তানের জন্য তখন বিশেষ চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করার দরকার পরতে পারে।

মাতৃত্বকালীন যত্ন

সন্তান ধারণের পর তিনটি ধাপে চিকিৎসা পদ্ধতি চলে। প্রথম ধাপ, সন্তান ধারণের সময় থেকে ১২ সপ্তাহ। দ্বিতীয় ধাপ, ১২ সপ্তাহ থেকে ২৪ সপ্তাহ। তৃতীয় ধাপ ২৪ সপ্তাহ থেকে ৩৬ সপ্তাহ।

প্রথম ধাপ: রুটির পরীক্ষা চলে। রক্ত প্রবাহ পরীক্ষা, মায়ের ব্লাড গ্রুপ নির্ণয়, হেপাটাইটিস, এসটিডি, যৌনবাহিত রোগ (মায়ের না থাকলেও বাবার মাধ্যমে হতে পারে), ব্লাড সুগার পরীক্ষা ইত্যাদি।

এই সময়টা ‘রিস্ক পিরিয়ড’। তাই সতর্কতার সঙ্গে চলাফেরা করার পরামর্শ দেওয়া হয়। পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার পাশাপাশি ভিটামিন, মিনারেলের ঘাটতি থাকলে সেগুলো আলাদাভাবে, যেমন: ভিটামিন ট্যাবলেট, ফলিক এসিড ইত্যাদির মাধ্যমে পূরণ করার পরামর্শ দেওয়া হয়।

এই সময় থেকেই সন্তানের মা যেন স্বাভাবিক খাবারের চাইতে অতিরিক্ত খাবার খায়। দুধ ডিম খাওয়া উচিত। গর্ভধারণের প্রাথমিক অবস্থায় বমি হওয়াটা স্বাভাবিক। কারণ শরীরে হরমোনাল চেইঞ্জ চলতে থাকে। তবে বেশি বমি হলে প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

মাতৃত্বকালীন সময়ে কোনো মতেই এক্সরে করানো যাবে না। একান্তই যদি প্রয়োজন হয়, তবে ডাক্তারের পরামর্শে করতে হবে। সাধারণত ১৪ সপ্তাহ পর আল্ট্রাসনো করা হলে গর্ভে সন্তানের অবস্থা সম্পর্কে জানা যায়।

দ্বিতীয় ধাপ: ১২ সপ্তাহ পর থেকেই মাকে নিয়মিত ‘ফলোআপে’ রাখতে হয়। এগুলো হল— আল্ট্রাসনো  করে শিশুর অবস্থা বোঝা, গর্ভের পানি সঠিক পরিমাণে আছে কিনা পরীক্ষা করা, ইত্যাদি।

এই সময়ে ভারী কাজ একদম বাদ। গর্ভকালীন সময়ে শিশুর মায়ের শরীরে পানি আসাটা স্বাভাবিক।

তৃতীয় ধাপ: এই সময়ের যত্নগুলোও প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের মতোই। তবে এই পর্যায়ে যে কোনো সময় শিশু জন্মানোর জন্য প্রস্তুত থাকতে বলা হয়। তাই দ্রুত হাসপাতালে আসার মতো ব্যবস্থা রাখা উচিত। মায়ের রক্তের গ্রুপের সঙ্গে মিলিয়ে অন্তত দুজন রক্তদাতাকে যেকোনো মুহূর্তের জন্য প্রস্তুত রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়।

গর্ভধারণের পর শিশুর মাকে প্রথম ধাপে দুই সপ্তাহ পরপর, দ্বিতীয় ধাপে এক মাস পরপর এবং তৃতীয় ধাপে প্রতি সপ্তাহে একবার ফলোআপ করানো উচিত।

সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পর মায়ের যত্ন

“প্রথম এবং প্রধান বিষয় হচ্ছে সদ্যভূমিষ্ট শিশুর মুখে চিনিপানি, মিসরির পানি বা মধু দেওয়া যাবে না। বরং প্রথম থেকেই ব্রেস্ট ফিডিং করাতে হবে।” বললেন ডা. কামরুল।

“অনেক সময় প্রথম দিকে বুকের দুধ আসতে চায় না। এর কারণ সন্তানকে বুকের কাছে ঠিকমতো না ধরা আর নিপল সাক করানোর বিষয়টা অভ্যস্ত না হওয়া। এই ব্যাপারটা আয়ত্ত করতে একটু সময় লাগে, তবে আয়ত্ত হয়ে গেলেই বুকে দুধ চলে আসে।” কথার ফাঁকে যুক্ত করলেন এই চিকিৎসক।

তিনি আরও জানান, প্রথম ৬ মাস এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিড টাইম। এই সময়ে অন্য কোনো খাবার শিশুর মুখে দেওয়া যাবে না।

শুধু যে শিশুর উপকার হয় তা নয়, বুকের দুধ খাওয়ানোতে মায়েরও সুবিধা আছে। এর ফলে মায়ের সঙ্গে শিশুর বন্ধন গাঢ় হয়। মায়ের মানসিক ভারসাম্য ঠিক থাকে। হরমোনাল ব্যালেন্স ঠিক হয়। সন্তান প্রসবের ৬ মাস পর মায়ের স্বাভাবিক ঋতুচক্র ফিরে আসতে সাহায্য করে।

মানসিক স্বাস্থ্য

সন্তান পৃথিবীতে আসার পর চার থেকে ছয় সপ্তাহ মায়ের মানসিক অবস্থা অনেক কোমল থাকে। এই পর্যায়কে বলা হয় পোস্টপার্টাম সাইকোসিস বা প্রসবের মনোব্যাধি। জানালেন ডা. কামরুল।

এর কারণে শিশুর মা অল্পতেই কান্না করে। সবার মনোযোগ চায়। সন্তান নিয়ে নানান রকম দুশ্চিন্তায় ভোগে।

তাই এই সময়ে স্বামীকে সবচেয়ে বেশি সহায়ক হতে হয়। সদ্য মা হওয়া স্ত্রীকে মানসিক শক্তি যোগাতে হয়। পাশাপাশি পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরও সহমর্মী হতে হবে।

স্বাভাবিক শরীর

“গর্ভধারণের ফলে পেটের চামড়ায় এক ধরনের দাগ হয়। যাকে বলে স্ট্রাই গ্রাভিডারম।” বললেন ডা. কামরুল। “সন্তান জন্মানোর পর এই দাগ এমনিতেই চলে যায়। ভালোমতো দাগ মিলিয়ে যাওয়ার জন্য নানান ধরনের ক্রিম ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়।”

তিনি আরও জানান, মা হওয়ার পর ওজন বৃদ্ধি স্বাভাবিক।

এছাড়া শিশু ভূমিষ্ট হওয়ার পর পেটফোলাভাব অর্ধেক তখনই কমে যায়। আর পুরোটা স্বাভাবিক হতে ছয় থেকে আট সপ্তাহ সময় লাগে। পেট সমান রাখতে ডাক্তারের পরামর্শে বেল্ট ব্যবহার করা যেতে পারে।

এছাড়া কোমরে ব্যথা হতে পারে। এরজন্য ক্যালশিয়াম ট্রিটমেন্ট চালানো হয়। তবে এসব সমস্যা ক্ষণস্থায়ী বলে জানান ডা. কামরুল।

এবং...

“সন্তানের পাশাপাশি নব্য মায়ের যত্ন নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। যা আমাদের দেশে বেশিরভাগ সময়েই করা হয় না।” বললেন ডা. কামরুল।

তাই নব্য মাকে পুষ্টিকর ও স্বাভাবিক খাবার, যেমন: সবুজ শাকসবজির পাশাপাশি মাছ, মাংস ও ডিম খাওয়ার পরামর্শ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রাক্তন চিকিৎসক।