ঐতিহাসিক মুজিবনগর

১৭ এপ্রিল, ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস। দিনটিতে স্বাধীনতা অর্জনের পথে আরও একটি মাইল ফলক অতিক্রম করে বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের এই দিনে তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ গ্রহণ করে।

মুস্তাফিজ মামুনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 April 2014, 02:55 AM
Updated : 17 April 2014, 08:49 AM

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামকে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা হয়।

ওইদিন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এইচএম কামরুজ্জামান শপথ গ্রহণ করেন। কর্নেল এমএজি ওসমানীকে সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়। এ অনুষ্ঠানে ১০ এপ্রিল গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রও পাঠ করা হয়। এরপর বৈদ্যনাথতলার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় মুজিবনগর।

মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের নানান তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে জায়গাটিতে গড়ে তোলা হয়েছে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ কমপ্লেক্স। প্রায় ৮০ একর জায়গাজুড়ে রয়েছে স্মৃতিসৌধ, মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিকেন্দ্র, মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টরের যুদ্ধকালীন ঘটনাবলির মানচিত্র।

ভাস্কর্যের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ, পাকহানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ, পাকবাহিনীর সহায়তায় নিরীহ বাঙালিদের উপর রাজাকারদের নির্যাতন, খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ইত্যাদি।

মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ

মুজিবনগর কমপ্লেক্সের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থাপনা এটি। ১৯৭১-এর অস্থায়ী সরকারের শপথসহ মুক্তিযুদ্ধের নানান ঘটনাকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে ১৯৮৭ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে উদ্বোধন করা হয় এ স্মৃতিসৌধ। নকশা করেন স্থপতি তানভীর করিম।

সৌধটির স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য হল, ১৬০ ফুট ব্যাসের গোলাকার স্তম্ভের উপর মূল বেদিকে কেন্দ্র করে ২০ ইঞ্চি পুরু ২৩টি দেয়াল, যা উদীয়মান সূর্যের প্রতীক। সৌধের ২৩টি স্তম্ভ ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ২৩ বছরের সংগ্রামের প্রতীক। ৩০ লাখ শহীদের স্মৃতিকে স্মরণ করে রাখতে সৌধে বসানো হয়েছে ৩০ লাখ পাথর। ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক স্মৃতিসৌধের বেদিতে আরোহণের ৯টি ধাপ।

মুজিবনগর আম্রকানন। ছবি: মুস্তাফিজ মামুন / বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।

 

মুজিবনগর আমবাগান

মুজিবনগর স্মৃতিসৌধের সামনেই ঐতিহাসিক এ আম্রকানন। প্রায় চল্লিশ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত এ বাগানে সহস্রাধিক আমগাছ রয়েছে। ঐতিহাসিক এ বাগানেই হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকারের শপথ অনুষ্ঠান। বাগানটি এখনও পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম। ছায়াঢাকা পুরো বাগান পাখপাখালির কলকাকলিতে মুখর থাকে সবসময়।

মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাজধানীর ঐতিহাসিক গুরুত্বকে স্মরণীয় করে রাখতে এখানে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স। অস্থায়ী সরকারের শপথ গ্রহণের জায়গায় নির্মাণ করা হয়েছে একটি স্মৃতিসৌধ। স্মৃতি কমপ্লেক্সের ভেতরে বাংলাদেশের মানচিত্রের মাঝে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ১১ নম্বর সেক্টরের বিভিন্ন ঘটনাচিত্র।

ঐতিহাসিক ৬ দফার রূপক হিসেবে তৈরি করা হয়েছে ৬ ধাপের গোলাপ বাগান। মুক্তিযুদ্ধকালীন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে ভাস্কর্যের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে এখানে। কমপ্লেক্সের বাইরে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ, মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ, রাজাকার-আলবদরদের সহায়তায় মুক্তিকামী বাঙালির উপর পাকিস্তানি হানাদারদের নির্যাতন, ঐতিহাসিক তেলিয়াপাড়া সম্মেলন, খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ভাস্কর্যসহ বিভিন্ন ঘটনা স্থাপত্যকলার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের নানান বইপত্র নিয়ে একটি গ্রন্থাগারও রয়েছে।

মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্সে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চ ভাষণের ভাস্কর্য।

মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্সে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসম্পণের ভাস্কর্য।

 

যেভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে সড়কপথে সরাসরি মুজিবনগর যাওয়া যায়। এছাড়া বাসে মেহেরপুর জেলা সদর, সেখান থেকে সহজেই যাওয়া যায় মুজিবনগর। মেহেরপুর সদর থেকে মুজিবনগরের দূরত্ব প্রায় ১৪ কিলোমিটার।

ঢাকার কল্যাণপুর ও গাবতলী থেকে জে আর পরিবহন, মেহেরপুর ডিলাক্স, চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্স এবং শ্যামলী পরিবহনের বাস সরাসরি যায় মেহেরপুর ও মুজিবনগর। ভাড়া ৩৫০-৫০০ টাকা।

নিজস্ব বাহন নিয়ে গেলে পাটুরিয়ার ফেরি পারাপারের ঝক্কি এড়িয়ে বঙ্গবন্ধু সেতু পার হয়ে সিরাজগঞ্জ, নাটোর, পাবনা অতিক্রম করে লালনশাহ সেতু (পাকশী সেতু) পেরিয়ে মেহেরপুর যাওয়া যায়।

যেখানে থাকবেন

মুজিবনগরে থাকার জন্য বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের মোটেল ‘মুজিবনগর’ নির্মাণ করা হলেও সেখানে নেই পানি ও বিদ্যুত। তবে মুজিবনগরে আছে মেহেরপুর জেলা পরিষদের ডাকবাংলো 'সূর্যোদয়'। কক্ষ খালি থাকলে এখানে থাকা যায়। মেহেরপুর জেলা সদরেও সাধারণ মানের কিছু হোটেল আছে।

বাস স্টেশনের কাছে আছে ফিন টাওয়ার হোটেল, নাইট বিলাস হোটেল এবং শাহজাদী আবাসিক হোটেল। বড় বাজারের কাছে আছে হোটেল মিতা, হোটেল অবকাশ, হোটেল অনাবিল ইত্যাদি। এসব হোটেলে ১শ’ থেকে ১ হাজার টাকায় কক্ষ পাওয়া যাবে।