চাপ যখন রক্তচাপ

ব্লাড প্রেশারের কারণে ঘাড়ে ব্যথা কিংবা মাথা ঘুরায়— এই ধারণা সবসময় ঠিক নয়। তবে কোনো কোনো সময়ে এসব উপসর্গ হিসেবে দেখা দিতে পারে। উচ্চ বা নিম্ন রক্তচাপ নিয়ে পরামর্শ দিয়েছেন মোহনা ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড ডক্টরস চেম্বারের চিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ কামরুল হাসান এমবিবিএস, এফসিপিএস (মেডিসিন)।

ফজলে আজিমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Oct 2013, 02:45 AM
Updated : 24 Oct 2013, 02:45 AM

ব্লাড প্রেশার বা রক্তচাপ জনিত অসুস্থতা দুই রকমের। নিম্ন রক্তচাপ ও উচ্চ রক্তচাপ। এর মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ বা হাই ব্লাড প্রেশার সমস্যা বেশি দেখা যায়। এর কারণ হচ্ছে রক্তনালীর সংকোচন। এতে শরীরের বিভিন্ন প্রান্তে রক্তচলাচলে সমস্যা হয়। চিকন রক্তনালী দিয়ে রক্তচাপ বাড়ে। তখন রক্ত জমাট বেঁধে বিভিন্ন রকম সমস্যা হতে পারে।

একজন প্রাপ্ত বয়ষ্ক মানুষের রক্তচাপ সংকোচন (সিস্টোলিক) ১১০ থেকে ১৪০ ও প্রসারণ (ডায়াস্টোলিক) ৬০ থেকে ৯০ হলে রক্তচাপ স্বাভাবিক বলে ধরা হয়। এর চেয়ে কম হলে নিম্ন  রক্তচাপ আর বেশি হলে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা রয়েছে। তবে একবার পরীক্ষা করেই বলা যাবে না, উচ্চ নাকি নিম্ন রক্তচাপ। কারণ ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। এজন্য হাইপার টেনশন এবং উচ্চ রক্তচাপকে বলা হয় সাইলেন্ট কিলার।

যাদের উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বেশি

জন্মগতভাবে যাদের হার্ট বা হৃদপিণ্ডে ছিদ্র আছে, কিডনিতে সমস্যা, ভাল্ভের সমস্যা আছে তাদের উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বেশি। এছাড়া অন্যদের ক্ষেত্রে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই সমস্যা দেখা যেতে পারে।

যাদের বাবা-মায়ের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে তাদেরকে আগে থেকেই সচেতন হতে হবে। এছাড়া স্ট্রোক, রক্তে কোলেস্টরেলের মাত্রাধিক্য, কিডনি সমস্যা, ধূমপায়ী, মাত্রাতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন, মহিলাদের অতিমাত্রায় পিল সেবন, স্থুলতা, হাঁটাচলা কম হয়— তাদের দেহে রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

এছাড়া অধূমপায়ীর চেয়ে ধূমপায়ীর উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি ২৫ থেকে ৩০ ভাগ বেশি। মহিলাদের চেয়ে পুরুষদের উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বেশি।

আক্রমণস্থল

রক্তচাপের কারণে শরীরের ৪টি জায়গা আক্রান্ত হয়।

মস্তিষ্ক : উচ্চ রক্তচাপের কারণে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হতে পারে। একে বলে ব্রেইন স্ট্রোক। এতে শরীরের একদিক বা যেকোনো অঙ্গ অবশ হয়ে যেতে পারে।

হার্ট : হার্টে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে। এতে রক্ত চলাচলে সমস্যা হয়। হার্ট অ্যাটাক বা হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

চোখ : ঝাপসা দেখে। চোখে রক্তক্ষরণের ফলে চোখ অন্ধ হয়ে যেতে পারে।

রক্তনালী : দেহের রক্তনালী চিকন হয়ে গেলে রক্তচলাচলে সমস্যা হয়। তাছাড়া পায়ে ঘা হওয়া এমন কি কালো দাগ ও ঘা হলে শুকাতে অনেক দিন সময় লাগে।

রক্তচাপ বেশি হলে

উচ্চ রক্তচাপ থাকলে কিছু সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। নিয়মিত হাঁটাচলার অভ্যাস যাপিত জীবনের এ ঝুঁকি কমাবে। হার্ট ও কিডনিতে সমস্যা না থাকলে যোগ ব্যায়াম বা ইয়োগা করতে পারেন। এতে দেহ ও মন দুটোরই ব্যায়াম হবে। যা কিছু আপনাকে বাদ দিতে হবে:

১. ধূমপান। ২. মাত্রাতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন। ৩. ভাতের সঙ্গে কাঁচা লবণ খাওয়া। ৪. অতিরিক্ত ভাজাপোড়া ও তৈলাক্ত খাবার খাওয়া। ৫. মাত্রাতিরিক্ত মহিষ ও খাসীর মাংস বিশেষ করে মগজ ও পায়া খাওয়া।

যা করা উচিত

১. নিয়মিত হাঁটুন। অন্তত ৩০ মিনিট করে সপ্তাহে ৩ দিন হাঁটার অভ্যাস করুন। হেঁটে ঘামের মাধ্যমে শরীর থেকে অতিরিক্ত লবণ ঝেড়ে ফেলুন। ২.     জিম বা ব্যায়ামাগারে যাওয়ার চেয়ে সাঁতার, সাইকেল চালানো, যোগ ব্যায়াম বেশি ভালো। ৩. ব্যস্ততার মাঝে অন্তত কিছু সময় বিরতি দিতে চেষ্টা করুন। ঘুম যেন পর্যাপ্ত হয় সেদিকে খেয়াল রাখুন। ৪. সারাদিন অফিসে বসে থাকতে হলে আসার পথ কিংবা যাওয়ার সময় কিছু পথ হাঁটার অভ্যাস করুন।

ব্লাড প্রেশার কম হলে

নিজের প্রতি আরও যত্নশীল হতে হবে। উচ্চ রক্তচাপ থাকলে কাঁচা লবণ খাওয়া বাদ দিতে হয়। তাই বলে ব্লাড প্রেশার কম থাকলে যে কাঁচা লবন খেতে হবে এমন নয়। শরীরের দুর্বলতা কাটাতে পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার ও বিশ্রাম নিন।

খাবার তালিকায় আপনাকে যোগ করতে হবে

১. খাবার স্যালাইন (ঘর থেকে বের হওয়ার সময় সঙ্গে খাবার পানি ও স্যালাইন রাখুন)।

২. ডাবের পানি পান ও রসালো ফল খান। বাড়তি শারীরিক পরিশ্রম আপাতত কমিয়ে দিন।

৩. পর্যাপ্ত পানি পান করুন।

৪. খাবার ও বিশ্রাম এ দুটোকে গুরুত্ব দিন।

৫. বমি, ডায়রিয়া ও ঘামের মাধ্যমে শরীর থেকে ফ্লুইড বা তরল পদার্থ বের হয়ে গেলে দুর্বল অনুভব হতে পারে। দেহে সোডিয়াম বা লবণের ঘাটতি পূরণে স্যালাইন পান করুন। 

ডাক্তারের কাছে কখন যাবেন

হাইপার টেনশনের সুনির্দিষ্ট কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে খুঁজে বের করা যায় না। এটা অনেক রোগের উপসর্গ হিসেবে দেখা যায়। তাই এই নিয়ে বাড়তি চিন্তা করে সমস্যা বাড়ানোর কোনো মানে হয় না। যাদের ডায়াবেটিস, কিডনি জটিলতা ও হৃদরোগ রয়েছে তাদের দরকার বাড়তি সচেতনতা।

একজন সুস্থ মানুষকে ও অন্তত বছরে একবার ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত। যাদের বয়স ৪৫-এর বেশি তাদের প্রতি ৬ মাসে একবার ডাক্তারের কাছে গিয়ে চেকআপ করা প্রয়োজন।

অনেকের ধারণা বমিবমি ভাব ও মাথাঘোরার সমস্যা হলে মনে করেন উচ্চ রক্তচাপ হয়েছে। এ ধারণা সবসময় ঠিক না। তবে বারবার বমি হওয়া সেই সঙ্গে সমস্যাটি বেশি দিনের হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। বমি অনেকসময় বিভিন্ন রোগের উপসর্গ হিসেবে দেখা যায়।

সুস্থ জীবনের জন্য

১. নিয়মিত হাঁটুন। ব্যায়াম করুন।

২. রুটিন অনুসারে দিনের কাজ করুন। এতে স্ট্রেস কমবে।

৩. খাওয়া, ঘুম ও বিশ্রাম এগুলোর প্রতি মনোযোগি হোন।

৪. পর্যাপ্ত পানি পান করুন। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় ব্যাগে পানির বোতল রাখুন।

৫. ধূমপান ও অ্যালকোহল বর্জন করুন।

৬. বাড়তি ওজন (মেদ) অনেক রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই আগেই সচেতন হোন।

৭. শারীরিক সমস্যার কারণে নিজে নিজে ব্যায়াম করবেন না। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নির্ধারিত ব্যায়াম নিয়মিত চর্চা করুন।

৭. খেলাধুলা রোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

সুস্থ জীবনযাপন ও পরিমিতিবোধ রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখে। এছাড়া স্ট্রেস বা মানসিক চাপ মুক্ত জীবনের জন্য খেলাধুলা ও ব্যায়াম খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ছবি : সাকিব-উল-ইসলাম