একেক রকম খাবারে রয়েছে একেক রকম উপাদান। শরীরের বিভিন্ন পুষ্টি সঠিকভাবে পূরণ হলেই মানুষ থাকে সুস্থ আর কর্মক্ষম। খাবারের বিভিন্ন ভাগ আর পুষ্টিবিষয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন জনস্বাস্থ্য পুষ্টিবিদ- আসফিয়া আজিম।
Published : 13 Aug 2013, 08:29 AM
চিকিৎসক বা পথ্যবিদের ব্যবস্থাপত্রে খাবারের পরিমাণসংক্রান্ত নির্দেশাবলির ক্ষেত্রে প্রায়ই লেখা থাকে ‘এক পরিবেশন’ বা ‘দুই পরিবেশন’ পরিমাণ খাবার খাওয়ার কথা।
ইন্টারনেট বা ডায়েট চার্টের বিভিন্ন সাইটে ঢুঁ মারলেও চোখে পড়ে সবজি ‘টু সার্ভিং’ বা ‘ওয়ান সার্ভিং’। ডায়াবেটিস বা ক্রনিক রোগে আক্রান্ত রোগীদের খাবারের তালিকাতেও প্রায়ই দেখা যায় ‘ফুড এক্সচেঞ্জ’, ‘পরিবেশন’ বা ‘সার্ভিং’ সংক্রান্ত নির্দেশনা।
এ ধরনের শব্দাবলি বা পরিমাণের উল্লেখ অনেক ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষের জন্য কিছুটা বিভ্রান্তিকর হয়ে ওঠে। বিশেষ করে যারা ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইট থেকে ডায়েট চার্ট সংগ্রহ করে তা অনুসরণের চেষ্টা করেন। তাদের জন্য ‘ফুড এক্সচেঞ্জ’ বা ‘সার্ভিং’ এর অর্থ অনেক সময়ই অজানা বা অধরা থেকে যায়।
পুষ্টিবিজ্ঞানে ‘ফুড এক্সচেঞ্জ’-এর সহজ অর্থ হল ‘খাবারের বদল’ বা ‘বদলি খাবার’।
খাদ্যতালিকার যে কোনো একটি খাবার থেকে যে পরিমাণ ক্যালোরি, ফ্যাট, প্রোটিন ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান পাওয়া যায়, তার কাছাকাছি বা সমপরিমাণের পুষ্টিগুণ অন্য যে খাবার থেকে পাওয়া যায়, সেই বদলি খাবারকেই বলা হয়ে থাকে ‘ফুড এক্সচেঞ্জ’।
সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে হলে প্রতিটি মানুষেরই প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের খাবার একটি নির্দিষ্ট পরিমাপে বা পরিমাণে খাওয়া প্রয়োজন। খাবারের পরিমাপ বা পরিমাণ কমবেশি হলেই শরীরে ক্যালোরি ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের অভাব বা আধিক্য দেখা দেয়। ফলে দেখা দেয় অপুষ্টি বা ওজনাধিক্য।
পুষ্টিবিজ্ঞানে খাবারকে মূলত কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি ভাগ থেকে প্রতিদিন একজন মানুষের কী পরিমাণ খাবারের প্রয়োজন, তারও হিসাব করা আছে।
সে হিসেবে প্রতিটি খাবারের ভাগ বা ধরন থেকে আন্তর্জাতিকভাবে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ খাবার গ্রহণের নির্দেশনা তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটি খাবারের ধরনের জন্য নির্ধারণ করা পরিমাপকেই বলা হয়ে থাকে ‘সার্ভিং’ বা পরিবেশন।
যেমন এক ‘সার্ভিং’ ভাত বলতে বোঝায় আধা কাপ ভাত। আধাকাপ ভাতের সমপরিমাণ পুষ্টিগুণ পাওয়া যায় এক স্লাইস পাউরুটিতে।
ধরুন, কোনো চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রে দুপুরের খাবারে মাছ বা মাংসের পরিমাণ লেখা রয়েছে এক ‘সার্ভিং’, তবে সহজ ভাষায় তার মানে দাঁড়াবে, দুপুরের খাবারে ৫০-৬০ গ্রাম পরিমাণ মাছ বা মাংস খেতে হবে। অথবা এর বদলে খাওয়া যেতে পারে দুটি ডিম, প্রোটিন হিসেবে যার পুষ্টিমূল্য তার কাছাকাছি।
খাবারকে মূলত তিন ভাগে ভাগ করা হয়। কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ও ফ্যাট। তবে পুষ্টি উপাদানের উপর ভিত্তি করে মূল এই তিন ধরনের খাবারকে আরও ছোট ছোট নয়টি ভাগে ভাগ করা হয়।
পুষ্টিবিজ্ঞানে বলা হয়ে থাকে, সুস্থ ও কর্মক্ষম থাকতে হলে প্রতিদিন প্রত্যেক মানুষেরই উচিত এই নয় ভাগ খাবারের ধরন থেকে খাদ্য গ্রহণ করা।
খাবারের ভাগ ও পুষ্টি উপাদান
১. শষ্যজাতীয় খাবার
ভাত, গম, যব, বার্লি, মুড়ি, চিড়া, ময়দা, আটা, ভুট্টা, খই ইত্যাদি মূলত শক্তি জোগায়। এছাড়া কিছু প্রোটিন, সামান্য ফ্যাট, ভিটামিন-বি১, বি২, ফলিক অ্যাসিড ও খাদ্যের আঁশ পাওয়া যায়।
২. ডাল ও বীজজাতীয় খাবার
মশুর, মটর, অড়হর, মাষকলাই, ছোলা, মুগ ইত্যাদি ডাল ও শিমের দানা, কুমড়ার দানা, রাজমা (কিডনি বিন) ইত্যাদি। উদ্ভিজ্জ প্রোটিনের ভালো উৎস। এর সঙ্গে ক্যালসিয়াম, আয়রন, ফলিক অ্যাসিড ও ভিটামিন বি পাওয়া যায়।
৩. শাকজাতীয় খাবার
পালং, পুঁই, কলমি, সজনে, লালশাক, মেথিজাতীয় দেশি শাকপাতা, ধনেপাতা, পুদিনাপাতা, লেটুস, বাঁধাকপি ইত্যাদি। পাওয়া যায়-- ক্যারোটিন, ভিটামিন বি২, ফলিক অ্যাসিড, ক্যালসিয়াম, রিবোফ্লাবিন, ভিটামিন সি, ভিটামিন ই ও ভিটামিন কে।
৪. অন্যান্য সবজি
গাজর, বেগুন, ঢেঁড়স, ক্যাপসিকাম, পটল, শালগম, মুলা, ফুলকপি, ব্রকলি, কুমড়া ইত্যাদি। পাওয়া যায়-- ভিটামিন এ, ভিটামিন ই ও ভিটামিন কে-এর উৎস। কয়েক ধরনের মিনারেলও পাওয়া যায়।
৫. ফল ও ফলজাতীয়
আম, জাম, পেয়ারা, পেঁপে, লেবু, কমলা, টমেটো, আমলকি, তরমুজ, বাঙ্গি, ফুটি, কাঁঠাল, জামরুল ইত্যাদি। এসবে আছে প্রায় সব ধরনের ভিটামিন ও মিনারেলের সমারোহ।
৬. দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার
দুধ, পনির, ছানা, দই, দুধের তৈরি খাবার যেমন পায়েশ, সেমাই ইত্যাদি। প্রোটিন, ফ্যাট, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি-এর উৎস।
৭. মুরগি, গরু, খাসি, ডিম, কলিজা, মিঠা পানির ও সমুদ্রের মাছ, পায়া ইত্যাদি।
প্রাণিজ প্রোটিনের সবচেয়ে ভালো উৎস। পাশাপাশি জিঙ্ক, ম্যাগনেশিয়াম এবং আয়রনও পাওয়া যায় প্রচুর পরিমাণে।
৮. ফ্যাটজাতীয়
মাখন, ঘি, বাটার অয়েল, সয়াবিন তেল, সর্ষের তেল, জলপাই তেল, তিলের তেল ইত্যাদি। শক্তিবর্ধক। ভিটামিন এ, ভিটামিন ই, ভিটামিন ডি ও ভিটামিন কে পাওয়া যায়।
৯. চিনি ও মধুজাতীয়
চিনি, মধু ও গুড় ইত্যাদি। মূলত শক্তি পাওয়া যায়। তবে গুড় ও মধু কিছু মিনারেলেরও উৎস।
উপরের এই খাবারের ভাগগুলো থেকে প্রতিদিন নির্দিষ্ট কিছু ‘সার্ভিং’ বা ‘পরিবেশন’ খাবার গ্রহণ করা উচিত আমাদের সবার।
১. যেমন শষ্যজাতীয় খাবার সারাদিনে ৬ থেকে ১০ সার্ভিংয়ের বেশি গ্রহণ করা ঠিক নয়। শষ্যজাতীয় খাবারের ক্ষেত্রে এক সার্ভিং ভাতের পরিমাণ বলতে আধাকাপ ভাত বোঝায়।
২. ডাল ও বীজজাতীয় খাবার দিনে অন্তত দুই সার্ভিং নেওয়া আবশ্যক। এক সার্ভিং পরিমাণ বলতে এক কাপ মাঝারি ঘন ডালকে বোঝায়।
৩. আধা কাপ রান্না করা শাক মানে এক সার্ভিং। প্রতিদিন একজন ব্যক্তির দুই সার্ভিং, অর্থাৎ এক কাপ রান্না করা শাক বা পাতাজাতীয় খাবার গ্রহণ করা জরুরি।
৪. সুস্থ ও কর্মক্ষম মানুষের জন্য অন্যান্য সবজিও দিনে অন্তত দুই সার্ভিং খাওয়ার নির্দেশনা রয়েছে।
৫. মাছ, মাংস, ফল, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবারের ভাগ থেকেও প্রতিদিন দুই সার্ভিং করে খাওয়ার নিয়ম রয়েছে। ৫০-৬০ গ্রাম ওজনের মাছ বা মাংস হল এক সার্ভিং। ছোট একটা আপেল বা কমলা বা অর্ধেকটা আম বলতে এক সার্ভিং বোঝায়। দুই সার্ভিং দুধ বা দুগ্ধজাত খাবারের চাহিদা পূরণ হয় দুই কাপ দুধ বা দই থেকে।
৬. ফ্যাট আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের একটি দরকারি পুষ্টি উপাদান। দিনে তিন থেকে চার সার্ভিংয়ের সমপরিমাণ ফ্যাট আমাদের প্রয়োজন। এক সার্ভিং ফ্যাটের চাহিদা ১৫ গ্রাম কাঠবাদাম বা দুই চা-চামচ পরিমাণ তেল থেকেই পূরণ করা সম্ভব।
৭. চিনি, গুড় বা মধু আলাদাভাবে খুব বেশি প্রয়োজন নেই। রান্না বা বিভিন্ন খাবারে ব্যবহূত পরিমাণ থেকেই তা পূরণ হয়ে যায়। মনে রাখা দরকার, সারা দিনে এক থেকে দেড় চামচ পরিমাণ চিনি বা গুড় আমাদের এক দিনের চাহিদা খুব ভালোভাবে পূরণ করতে পারে।