আহসান মঞ্জিল

পুরান ঢাকার ইসলামপুরে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে রাঙা প্রাসাদ। একসময়ের বাগানবাড়ি, আহসান মঞ্জিল। এখন সেখানে দর্শনার্থীদের ভিড়। মুঘল আমলের একটু ছোঁয়া পেতে প্রাচীন এই প্রাসাদ থেকে ঘুরে আসতে পারেন।

মলয় গাঙ্গুলীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 July 2013, 05:48 AM
Updated : 7 July 2013, 05:48 AM

পাটুয়াটুলির রাস্তাটা বেশ প্রশস্ত। পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি অলিগলি পার হওয়ার ঝামেলা এখানে খুব একটা পোহাতে হয় না। বামে মোড় নিয়ে ওয়াইজঘাটের রাস্তা ধরে হাতের বামে বুলবুল ললিতকলা একাডেমী ফেলে সোজা তাকালে চোখে পড়বে একটি লাল রংয়ের প্রাসাদ। কাছে গিয়ে ৫ টাকায় টিকিট কেটে ঢুকলেই বিশাল উদ্যান। অনেক রকমের ফুলগাছ, পাতাবাহার, নারকেল আর সুপারিগাছে ভরা সবুজ অঙ্গন।

মন মাতানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। গাছগুলো বৃষ্টিতে ভিজে যেন নব যৌবন ফিরে পায়। বাতাসে ফুলের সুবাস, সামনে প্রাচীন প্রাসাদ-- মুহুর্তেই নিয়ে যায় কোনো এক কল্পনার রাজ্যে। প্রেয়সীর হাত ধরে মৃদু পায়ে হেঁটে চলা। এভাবেই সপ্তাহের ৬ দিনই প্রাণের স্পন্দন জাগে আহসান মঞ্জিলে।

প্রকৃতি ছেড়ে এবার প্রাসাদের দিকে যাওয়া যাক। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে তখনকার জামালপুর পরগনার (বর্তমান ফরিদপুর-বরিশাল) জমিদার শেখ ইনায়েতউল্লাহ রংমহল প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর জমিদারের ছেলে শেখ মতিউল্লাহ এটি ফরাসি বণিকদের কাছে বিক্রি করেন।

১৮৩৫ সালের দিকে বেগমবাজারে বসবাসকারী নবাব আবদুল গনির বাবা খাজা আলীমুল্লাহ এটা কিনে নিয়ে বসবাস করতে শুরু করেন। ১৮৭২ সালে নবাব আবদুল গনি নতুন করে নির্মাণ করে তার ছেলে খাজা আহসানউল্লাহর নামে ভবনের নামকরণ করেন আহসান মঞ্জিল।

এটি একটি দোতলা ভবন। বারান্দা ও মেঝে মার্বেল পাথরে তৈরি। প্রতিটি কক্ষের আকৃতি অষ্টকোণ। প্রাসাদের ভেতরটা দুভাগে বিভক্ত। পূর্বদিকে বড় খাবার ঘর। উত্তরদিকে লাইব্রেরি। পশ্চিমে জলসাঘর। পুরো ভবনের ছাদ কাঠের তৈরি। নিচতলায় খেলার ঘরে রয়েছে বিলিয়ার্ড খেলার জন্য আলাদা জায়গা। দরবার হলটি সাদা, সবুজ ও হলুদ পাথরের তৈরি। দোতলায় বৈঠকখানা, গ্রন্থাগার আর তিনটি মেহমান কক্ষ। পশ্চিম দিকে আছে নাচঘর আর কয়েকটি আবাসিক কক্ষ।

এই ভবনটি ১৮৮৮ সালে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে ও ১৮৯৭ সালে ভূমিকম্পে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।   

আহসান মঞ্জিলই ঢাকার প্রথম ইট-পাথরের তৈরি স্থাপত্য। যেখানে প্রথম বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবস্থা হয় নবাবদের হাতে। মঞ্জিলের স্থাপত্যশৈলী পশ্চিমাদের সবসময়ই আকৃষ্ট করত। লর্ড কার্জন ঢাকায় এলে এখানেই থাকতেন। বাংলাদেশ সরকার আহসান মনঞ্জিলকে জাদুঘর হিসেবে সংরক্ষণ করে। ১৯৯২ সালে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।

আহসান মঞ্জিল জাদুঘরে এখন পর্যন্ত সংগৃহীত নিদর্শন সংখ্যা ৪ হাজার ৭৭। এই রংমহলের ৩১টি কক্ষের মধ্যে ২৩টিতে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া ১৯০৪ সালের আলোকচিত্রশিল্পী ফ্রিৎজকাপের তোলা ছবি অনুযায়ী ৯টি কক্ষ সাজানো হয়েছে।

জাদুঘরের পরিচিতি

গ্যালারি ১ : এখানে আহসান মঞ্জিলের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, আলোকচিত্র ও চিত্রকর্মের সাহায্যে তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়াও আছে ভবনের একটি মডেল।

গ্যালারি ২ : বিভিন্ন সময়ে ভবনের যে বিবর্তণ হয়েছে তা আলোকচিত্রের সাহায্যে প্রদর্শন করা হয়েছে এখানে। এছাড়াও আছে কাটগ্লাস ও ঝাড়বাতির নমুনা।

গ্যালারি ৩ : নবাবদের আনুষ্ঠানিক ভোজন কক্ষ। এখানে প্রদর্শিত হয়েছে আলমারি, আয়না, কাচ ও চিনামাটির তৈজসপত্র। সবই আহসান মঞ্জিল থেকে প্রাপ্ত নির্দশন।

গ্যালারি ৪ : বড় কাঠের সিঁড়ি। হাতির মাথার কঙ্কাল, ঢাল-তলোয়ার। কাঠের বেড়ার মূল নির্দশন।

গ্যালারি ৫ : আসল ঢাল-তলোয়ারের অনুরূপে সাজানো।

গ্যালারি ৬ : আহসানুল্লাহ মেমোরিয়াল হাসপাতালের বেশকিছু ব্যবহৃত সরঞ্জমাদি ও খাতাপত্র এই কক্ষে প্রদর্শিত হয়েছে।

গ্যালারি ৭ : এই বড় কক্ষটি নবাবদের দরবার হল হিসেবে ব্যবহৃত হত। ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ গঠনের সময় শাহবাগের সম্মেলন আসা সর্বভারতীয় মুসলিম নেতাদের তৈলচিত্র এই গ্যালারিতে স্থান পেয়েছে। এছাড়াও আছে ঢাকার নবাবকে ইতালি থেকে দেওয়া একটি অষ্টকোণ টেবিল।

গ্যালারি ৮ : অ্যাডওয়ার্ড হাউজ থেকে সংগৃহীত জীবজন্তুর শিং। এছাড়া সেই সময়ে ঘরের বাইরে ও ভেতরে খেলার সরঞ্জাম সাজিয়ে রাখা হয়েছে।

গ্যালারি ৯ : বড় লোহার সিন্দুকসহ অন্যান্য সিন্দুক ও কাঠের আলমারিগুলো নবাবদের আমলের নিদর্শন।

গ্যালারি ১০ : এখানে আছে বড় বড় আলমারি, তৈজসপত্র যা নবাবের আমলের নিদর্শন।

গ্যালারি ১১, ১২ ও ১৩ : এই গ্যালারিগুলোতে যথাক্রমে বরেণ্য ব্যক্তিদের প্রতিকৃতি, স্যার সলিমুল্লাহ স্মরণে এবং নবাবদের সমসাময়িক মনীষীদের প্রতিকৃতি দিয়ে সাজানো হয়েছে।

গ্যালারি ১৪, ১৫, ১৬, ১৭ : যথাক্রমে হিন্দুস্থানি কক্ষ, প্রধান সিঁড়িঘর, লাইব্রেরি কক্ষ ও তাসখেলার ঘর।

গ্যালারি ১৮ ও ১৯ : ঢাকায় পানীয় জল সরবরাহবিষয়ক নিদর্শন যেসব আহসান মঞ্জিল ও অ্যাডওয়ার্ডস হাউজে পাওয়া গেছে। ঢাকা ওয়াটার ওয়ার্কের কয়েকটি দুষ্প্রাপ্য ছবি এখানে আছে।

গ্যালারি ২০ ও ২১ : ১৯০১ সালের আগে ঢাকায় বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ছিল না। নবাবের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা করার তথ্য, তৈজসপত্র ও ফুলদানি সবই নবাবের আমলের।

গ্যালারি ২২ : দোতলায় অবস্থিত এই গ্যালারিতে আহসান মঞ্জিলে থেকে পাওয়া অস্ত্র প্রদর্শিত হয়েছে। উঁচু গম্বুজটি এই ঘরের উপরেই অবস্থিত।

গ্যালারি ২৩ : এটি ছিল নাচঘর। ১৯০৪ সালে তোলা ছবি অনুযায়ি এটি সাজানো হয়েছে।

সবকটি গ্যালারি ঘুরে পাশেই নবাববাড়ির পুকুর দেখে আসা যাবে।

খোলা থাকার সময়

সাপ্তাহিক ছুটি বৃহস্পতিবার। এছাড়া অন্যান্য সরকারি ছুটির দিনেও বন্ধ থাকে।

এপ্রিল-সেপ্টেম্বর : সকাল ১০.৩০মি-বিকেল ৫.৩০মি (শনিবার-বুধবার)। বিকেল ৩টা-রাত ৮টা (শুক্রবার)।  

অক্টোবর-মার্চ : সকাল ৯.৩০মি- বিকেল ৪টা (শনিবার-বুধবার)। বিকেল ২.৩০মি-সন্ধ্যা ৭.৩০মি (শুক্রবার)।

যেভাবে যাবেন

ঢাকার যে কোনো স্থান থেকে গুলিস্তান এসে নর্থ সাউথ রোড ধরে কিছুদূর গেলেই পড়বে নয়াবাজার মোড়। এখান থেকে বাবুবাজার দিকে যেতে থাকবেন। বাবুবাজার ব্রিজের বামপাশে নিচ দিয়ে গেলে পড়বে আরেকটি মোড়। এর বামপাশে গেলেই ইসলামপুর। এখানে এসে যে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই বাতলে দেবে আহসান মঞ্জিল যাওয়ার রাস্তা।