এ যুগের মা

মা শব্দটি ছোট হলেও, ব্যাপ্তি অনেক। একসময় মেয়েরা সংসার আর বাচ্চা সামলাত। আর এখন এসবের পাশাপাশি চাকরিও করছেন। ফলে তাদের কাজের পরিধি যেমন বেড়েছে, তেমনি আগের আমলের মায়েদের থেকে বেড়েছে দায়িত্ব। তাই অনেক মা মনে করেন সন্তানদের তারা ঠিকমতো সময় দিতে পারছেন না।

ওমর শরীফবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 May 2013, 10:46 AM
Updated : 11 May 2013, 11:02 PM

এ রকমই একজন শাওন আজিম। কনসার্ন ওয়ার্ল্ড ওয়াইড-এ কর্মরত এই প্রকল্প-সমন্বয়কারী মনে করেন, তিনি মা হিসেবে অতটা সফল নন। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “আমার ছেলেমেয়েদের যতটুকু সময় দেওয়া উচিত বলে মনে হয়, চাকরির কারণে সেটা হয়ে ওঠে না।”

এই মায়ের দুই সন্তান শরণ্য শিখরের বয়স ৫ আর শ্রেয়া শময়িতার বয়স ১০। মা হিসেবে শাওন মনে করেন ছোটবেলায় তার মা যে পরিমাণ সময় দিতেন, সেই পরিমাণ সময় তিনি বাচ্চাদের দিচ্ছেন না।  তাই তিনি বাচ্চাদের সঙ্গে যতক্ষণ থাকেন ততক্ষণ তাদের ভালো একটা সময় দিতে চেষ্টা করেন।

তাদের সঙ্গে ভালো ছবি দেখা, না হলে গল্পের বই পড়ে শোনান। তবে তিনি এটাও স্বীকার করেন, সবসময় তার মাকে যেভাবে পেতেন, নিজের ছেলেমেয়েরা তো আর চাইলেই সেই রকমভাবে পাচ্ছে না তাকে। যেমন শরণ্য চায় মা তাকে স্কুল থেকে নিয়ে আসুক। কিন্তু চাকরির কারণে সেটা করা হয়ে ওঠে না বলে মাঝেমধ্যে আত্মগ্লানিতে ভোগেন তিনি।

একই রকম ভাবেন ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা সুমনা শারমিন। চাকরির বাইরে পুরো সময়টুকুই দিয়ে দেন দুই সন্তান-- সময় ও সায়ানের জন্য। সুমনার মা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। সন্তানদের সময় দেওয়ার জন্য চাকরি ছেড়েছিলেন।  তবে সংসারের খরচ আর বাচ্চাদের সুন্দর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সুমনা সেটা পারেন না। তা নাহলে সন্তানের বাবার উপর চাপ পড়ে যায় বেশি।

তবে এখন বাচ্চারা তার মাকে বন্ধু হিসেবেই দেখতে পছন্দ করে বেশি। এ রকমই জানালেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুজীব বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক শামসুন নাহার। তার মেয়ে তাসনিয়া তাবাস্‌সুমের বয়স এখন ৫, যে কোনো কাজেই চাই মায়ের সঙ্গ। নাহার বলেন, “কাজের বাইরে যতটুকু সময় থাকে তার পুরোটাই মেয়েকে দিতে ভালোবাসি। একটা পাতা পড়া দেখলেও আমি মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে দেখি।”

তবে নাহার চেয়েছিলেন মেয়ে যাতে মায়ের চাকরি করার গুরুত্বটা বোঝে। সে কারণে আরও ছোট থাকতেই  মেয়েকে তিনি চাকরির বিষয়ে যতটা সম্ভব বোঝাতে চেষ্টা করতেন। আর এ কারণেই মেয়ে আজ মায়ের চাকরির কারণে বাইরে থাকার বিষয়টা খুব ভালোভাবেই মেনে নিয়েছে।

অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ-এ কর্মরত কাশফিয়া ফিরোজও মনে করেন ছেলেকে শাসন না করে বুঝিয়ে বললেই কাজ হয় বেশি। তার কথায়, “আমাদের সময়ে তো মায়ের মুখের উপর কোনো কথাই বলতে পারতাম না। আর আমার ৫ বছরের ছেলে আয়ানকে কোনো কিছু করতে নিষেধ করলে তাকে সেটার কারণসহ ব্যাখ্যাও দিতে হয়। না দিলে নিষেধটা মানার কোনো যুক্তি খুঁজে পায় না। বন্ধুর মতো তার সঙ্গে ব্যবহার করতে হয়। আর সেটা না করে উপায়ও নেই। কারণ যুগটাই এ রকম।”

শাওন আজিমও তাই বলেন, “এই বিশ্বায়ণের যুগে ছেলেমেয়েদের জানার পরিধি বেড়েছে। আমাদের মায়েরা বংশপরম্পরায়  যেভাবে দেখে এসেছে সেইভাবেই আমাদের মানুষ করেছে। তবে এখন তো ব্যাপারটা তা নয়। এক মাউসের ক্লিকেই বিশ্বের সবকিছু বাচ্চার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। বাচ্চা বলেই যে সে কম জানবে তা নয়।  তবে কোন্টা ভালো আর কোন্টা খারাপ সেটা তাকে সঠিকভাবে বোঝাতে হবে। শাসন করে, বকা দিয়ে কোনো বিষয় থেকে দূরে রাখলে পরে সেটা সে গোপনে যে দেখবে না বা করবে না সেটার তো নিশ্চয়তা নেই।”

সুমনা মনে করেন, তথ্য প্রযুক্তির প্রসারের কারণেই জীবনধারা পাল্টেছে। তাই তো বকা দিয়ে সন্তানদের মানুষ করার দিন শেষ। কী কারণে কোন্ কাজ করতে নিষেধ করা হচ্ছে তা সুন্দর করে বুঝিয়ে বললে তারা শোনে বেশি।

নাহারের কথায়, “ছোটবেলায় আমি যেসব বিষয় থেকে বঞ্চিত হয়েছি, চেষ্টা থাকে, আমার মেয়ের জীবনে যেন সে রকম কিছু না হয়। তাই খেলনা কিনে দেওয়ার চাইতে তার গান শেখার ব্যবস্থা করেছি। সাইকেল কিনে দিয়েছি। তবে তার পছন্দ যেটা হবে সেটাই সে করবে। একমাত্র পড়াশোনার বিষয় ছাড়া আর কোনো বিষয়ে বকা দেই না। আমি চাই না বকা খেয়ে কোনো বিষয় আমার কাছ থেকে সে গোপন করুক। ছোটবেলায় মায়ের বকা খাওয়ার একটা ভয় কাজ করত। সেই ভয়টা যাতে আমার মেয়ের মধ্যে না থাকে।”

“যত জানবে ততই সে নিজেকে নিরাপদ রাখতে পারবে। এটাই আমি বিশ্বাস করি।” বললেন কাশফিয়া।

শুধু চাকরিজীবীরাই নয়, যেসব মায়েরা সন্তান মানুষ করার জন্য বাসায় থিতু হয়েছেন, তাদের চিন্তাধারাও প্রায় একই রকম।

শারমিন রাহি তেমনি একজন। তার দুই সন্তান সাফওয়ান হাবিব (৯) ও রাহিনা হাবিবের (৫) জন্য জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই খরচ করে যাচ্ছেন। তারপরেও মনে করেন তার মা যেভাবে সময় দিত, সেভাবে সময় দিতে পারেন না তিনি। তবে অকপটে স্বীকার করে বলেন, “আমার ধৈর্য্য কম। তাই অনেক সময়ই বকাঝকা করি। হয়তো চাকরি করলে সেটা করতাম না। বেশিরভাগ সময় ওদের সঙ্গে থাকি বলে, মাঝেমধ্যে বকা না দিলে কাজ হয় না। তবে যতটুকু সময় পাই ওদের সঙ্গেই থাকি।”

একই কথা জানালেন আরেক গৃহিণী মা সুমাইয়া খান আশা। ঘরে বসেও তার কাছে মনে হয় ২০ মাস বয়সী জায়ীমের জন্য খুব কম সময়ই ব্যয় করেন তিনি। এর কারণ হিসেবে বলেন, “আমার মায়ের কাছ থেকেই বেশি আদর পেয়েছি। তখন তো আর ফেইসবুক, ডিশলাইন ছিল না। ফলে সংসারের কাজ বাদে বাকি সময়টা মাকে পেতাম।  আর এখন তো বাচ্চাকে দেখাশোনার পাশাপাশি ফেইসবুকে স্ট্যাটাস না দিলে পেট ভরে না। যদিও সেই স্ট্যাটাসগুলো থাকে বাচ্চাটাকে নিয়েই।”

প্রযুক্তির ছোঁয়া নিয়ে অনেক আধুনিক মা সন্তান লালন করে যাচ্ছেন। এ রকমই একজন হচ্ছেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী বিচারক উম্মে শরাবন তহুরা। বর্তমানে তিনি উচ্চ শিক্ষার্থে অস্ট্রেলিয়াতে আছেন। ৫ বছরের একমাত্র ছেলে ওয়সি ইব্রাহিম রাইদের সঙ্গে তার যোগাযোগ ঘটে স্কাইপের মাধ্যমে।

তহুরা বলেন, “আমরা ভাইবোন ছিলাম ৪ জন। এ কারণে মায়ের চাইতে বোনের হাতেই মানুষ হয়েছি বেশি।  আমার একটাই বাচ্চা, তাই তার দিকে নজরটাও বেশি। আবার চাকরি করি বলে তাকে কোয়ালিটি টাইম দেওয়ার চেষ্টা করি। এখন বিদেশের মাটিতে বসে ছেলেকে খুব মিস করি। প্রতিদিনই দুই থেকে তিন ঘন্টা ওর সঙ্গে স্কাইপে সময় কাটাই।”

বিদেশে পড়তে গিয়ে মা হিসেবে দায়িত্ব পালন করা আর প্রবাসী হয়ে মায়ের দায়িত্ব পালন করার মধ্যে বেশ পার্থক্য রয়েছে।  যেমন সিমিলিয়া আফরোজ। স্বামীর সঙ্গে লন্ডন থাকছেন প্রায় সাত বছর হতে চলল। একমাত্র ছেলে ঈশান শেখের জন্ম সেখানেই। মনস্তত্ত্ববিষয়ক কর্মরর্তা হিসেবে কর্মরত এই মা ছেলের মানসিক বিকাশের জন্য সপ্তাহে একবার লাইব্রেরিতে নিয়ে যান। সেখানে বাচ্চাদের জন্য রয়েছে আলাদা বিভাগ। তাছাড়া চিড়িয়াখানা বা পার্কেও বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হয়।

সিমিলিয়া বলেন, “মা হিসিবে বিদেশে সন্তান মানুষ করার যেমন সুবিধা আছে। তেমনি অসুবিধাও অনেক। এ দেশে হিন্দি-ইংরেজি মিশ্রণে যে সংস্কৃতি চলছে সেটা থেকে দূরে রাখতে আমাকে অনেক সাবধান থাকতে হয়। আমি ছিলাম হিন্দি সিরিয়ালের পোকা। এখন ছেলের দিকে তাকিয়ে সেগুলো দেখা বাদ দিয়েছি। বাঙালি আর বিদেশি সংস্কৃতির মিশ্রধারায় বড় করলেও ছেলেকে বাংলা ভাষা শেখানোর জন্য বাসায় তার সঙ্গে বাংলায় কথা বলি।”

শুধু বিদেশের মাটিতেই নয় দেশের অনেক মা-ই বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে টিভিতে সিরিয়াল দেখা বন্ধ করেছেন। নাহার বলেন, “আগেও দেখতাম না, আর এখন বাসায় হিন্দি বা বাংলা সিরিয়াল দেখার চাইতে মেয়েকে সঙ্গ দেওয়া আমার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। টিভি দেখলেও স্টার মুভিজ, এইচবিও, অ্যানিমেল প্ল্যানেট এগুলো দেখানোয় অভ্যস্ত করেছি মেয়েকে।”

সুমনা তো বাসায় টিভিই রাখেননি। তার কথায়, “টিভির দেখার অভ্যেসই করাইনি ছেলেদের। তবে ছোটছেলে অ্যানিমেশন মুভি দেখতে পছন্দ করে। বিশেষ করে জন্তু-জানোয়ারের মুভিগুলো। সেগুলো দেখানোর জন্য তাকে ডিভিডি কিনে দেই। তাই তো এই বয়সেই সে অনেক জন্তুর নাম জানে।”

এইভাবেই শাওন, কাশফিয়া, সুমনা, নাহার, শারমিন, তহুরা, সিমিলিয়া, আশারমত আধুনিক মায়েরা ঘরে-- বাইরে সমানভাবে তাদের স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা বিলিয়ে যাচ্ছেন অকৃপণভাবে। আর এই কারণেই এখনও শুধু একটি দিন নয়, প্রতিটি দিনই সন্তানদের জন্য হয় মা দিবস।