ফাগুনে রঙিন মন

ইটকাঠের জঞ্জালেও হয় আপনহারা প্রাণ, বাঁধন-ছেঁড়া প্রাণ।

তৃপ্তি গমেজবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Feb 2022, 05:13 AM
Updated : 13 Feb 2022, 05:13 AM

ঋতুরাজ বসন্তের জন্য এখন আর প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় না, ক্যালেন্ডারের তারিখ গুনে শুরু হয় ফাল্গুনের যাত্রা।

তারপরও অলক্ষ্য রং লাগে কারণে অকারণে। রাজধানীবাসী একবার হলেও ঢুঁ দেয় শাহবাগ টিএসসির প্রাঙ্গণে।

ফাগুনের রং নিজের করে নিতে অথবা সঙ্গীর মন রাঙাতে ফুল আদান-প্রদানের প্রথা আজকের নয়। একে অপরের কাছে ভালোবাসা প্রকাশের জন্য অথবা সঙ্গীর মনটা খুশিতে ভরিয়ে দিতে ফুলমালা, ফুলের তোড়া ইত্যাদির প্রচলন রয়েছে।

আর কয়েক বছর ধরে মাথায় উঠেছে ফুলের চাকতির ব্যবহার।

শাহবাগের ফুলের দোকানে দেখা গেছে বাহারি রঙের ফুল, ফুলের তোড়া ও মালা। কেবল ভালোবাসা দিবসের অপেক্ষায় বসে নেই এই আয়োজন। মাসের শুরু থেকেই চলছে হরদম বেচাকেনা।

ফুল কিনতে এসেছেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সারা বছর সঙ্গীকে ফুল দেওয়া আর বসন্তের ফুলের মাঝে ভিন্ন একটা আমেজ খুঁজে পান তারা।

মিরপুর থেকে এসেছেন ফুল কিনতে সেলিম শেখ।

তিনি বলেন, “পহেলা ফাল্গুন আর ভালোবাসা দিবস একই দিনে উদযাপিত হচ্ছে। কাজের মধ্যে হয়ত সারাদিন উদযাপন করতে পারব না। অপেক্ষা করতে হবে সন্ধ্যা পর্যন্ত। অফিস শেষ করে তারপর দেখা করবো তার সঙ্গে। তাই আগেই তাকে ফুল কিনে দিচ্ছি। ফাল্গুনের এই সময়টা প্রায়ই তাকে ফুল দেই, সেও বেশ খুশি হয়।”

আরেক ক্রেতা মনির বলেন, “এমনি মন চাইলো তাই ফুল নিয়ে যাব। কেবল ১৪ তারিখেই ফুল দিয়ে ভালোবাসা জানাতে হবে এমন না। আমি মাঝে মধ্যেই তাকে ফুল দেই। তবে ফাল্গুনের এই সময়টা একটু ভিন্ন রকম আবেদন রাখে।” 

শাহবাগের ফুল বিক্রেতা রুবেল বলেন, “ফেব্রুয়ারি মাসে ফুলের চাহিদা বরাবরই বেশি আর ১৩ ও ১৪ তারিখে চাপ খুব বেশি পড়ে। তবে সারা মাসই দেখা যায় ফুলের বেশ চাহিদা থাকে। আর এখন সবকিছুর তুলনায় মাথার ফুলের চাকতির চাহিদাটা বেশি।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট্ট ফুল বিক্রেতা ইয়াসিন (১১) জানান তারা শাহবাগ থেকে ফুল সংগ্রহ করেন এবং নিজেরাই তোড়া তৈরি করে বিক্রি করেন। ক্যাম্পাসে যারা বেড়াতে আসে তারাই এগুলো বেশি কেনে।

বসন্ত আর ভ্যালেন্টাইন’স দিবসের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। এই দিনগুলোতে ফুলের তোড়া আর মাথা চাকরি বানিয়ে বিক্রি করবে বলে জানান, এই ফুল বিক্রেতা।

ভালোবাসা দিবসে আনুষ্ঠানিকভাবে ফুল চকলেট উপহার দেওয়ার ব্যাপারটি আগে প্রচলিত ছিল না। ভালোবাসা প্রকাশের জন্য নির্দিষ্ট কোনো দিন সম্পর্কেও বাঙালির খুব একটা ধারণা ছিল না। তাহলে তখন ভালোবাসার প্রকাশ হত কীভাবে?

এমনটা জানতে চাইলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে পুরান ঢাকার পঞ্চাশোর্ধ এক দম্পত্তি, আনিসুল হক ও জোবেদা খাতুন জানান, তাদের সময় ভ্যালেন্টাইন্স ডে বলে আলাদা কিছু ছিল না।

জোবেদা বলেন, “আমরা এমনিতেই নিজেদের মতো করে ভালোবাসার বছরপূর্তি পালন করতাম। ফুল দেওয়া, ছোট খাট কোনো উপহার দেওয়া এইসব আরকি। এখন তো দেখি এই দিন নিয়ে বেশ ঘটা করে আয়োজন করা হয়। ছেলেমেয়েরা অনেক আয়োজন করে। আবার হোটেলগুলোতেও নানান রকমের অফার থাকে। এসব দেখে আমাদের পুরানো স্মৃতি মনে পড়ে, ভালোই লাগে ভাবতে।”

ভালোবাসাকে নির্দিষ্ট দিনে আটকে না ফেলে বরং সব সময়ই যদি তার প্রকাশ ঘটানো যায় তাহলে সম্পর্কে ভালো থাকে বলে মনে করেন, এই দম্পত্তি।

সঙ্গীকে ফুল দেওয়ার পাশাপাশি অনেকেই ঘরে ফুল ও ফুল গাছ রাখতে পছন্দ করেন। এমন মানুষদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে বড় নার্সারিগুলোর পাশাপাশি রাস্তার ফুটপাথেও গড়ে উঠেছে অনেক নার্সারি। 

ধানমণ্ডির নার্সারির একজন বিক্রেতা মাসুন বলেন, “শীতকাল আসলে মানুষজন বাসার জন্য ফুল, পাতাবাহারে কিনে থাকে। আর ফাগুন মাসে চাহিদাটা বাড়ে।”

“চাহিদা অনুযায়ী ছোট বড় নানান রকমের টব, প্লাস্টিক ও মাটির টবও বিক্রি করে থাকি আমরা।”

“ছোট বাসার জন্য এই ধরনের টব বিক্রি হয়। যাদের  বাসা বড়, বারান্দা অথবা ছাদ বাগান যাদের আছে তারা ফলের গাছ, কলম করা গাছ বা বড় গাছ ইত্যাদি কিনে থাকেন।” বলেন মাসুম।

ফাল্গুন মাস তার ওপর ভালোবাসার মাস- সাজসজ্জায় এর একটা ছাপ তো পড়বেই।

লাল, হলুদ কমলা রংয়ের শাড়ি, হাতে চুড়ি, ফুলের অলঙ্কার এই নিয়ে ফাল্গুন উদযাপন। তারই পসরা দেখা যায় নানা নশপিং মল, এমনকি রাস্তার দোকানগুলোতেও।

কাচের চুড়ি ছাড়া ফাল্গুনের সাজ যেন অপূর্ণ থেকে যায়। টিএসসির মোড়ের একজন চুড়ি বিক্রিতা মতিয়া আক্তার বলেন, “এখানে সারাবছরই আমরা চুড়ি বিক্রি করি। তবে এই বিশেষ অনুষ্ঠানগুলোতে বেচা-কেনা তুলনামূলক বেশি হয়। অনেকে ঘুরতে এসে চুরি কিনে নিয়ে যায়, অনেকে আবার বান্ধবীকে চুড়ি কিনে দেয়। মোটামুটি ভালোই চাহিদা থাকে।”

গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের ছাত্রী তৃষা এলিজা বলেন, “গত দুই বছর ফাগুন উদযাপন সেভাবে করা হয়নি। লকডাউনের জন্য অধিকাংশ সময়ই ঘরে থাকতে হয়েছে। বন্ধু বান্ধবও ঢাকার বাইরে ছিল। তবে এবার বিশ্ববিদ্যালয় খোলা থাকায় বন্ধুবান্ধব সবাই আছে। তাই উদযাপন একটু ভিন্ন রকম হবে। আমরা বান্ধবীরা সবাই মিলে এক রকমের গহনা ও শাড়ি কিনেছি। অনেক অনেক প্ল্যান করা হয়েছে এই দিনকে নিয়ে, আশা করছি ভালোই কাটবে দিনটা।”

অনেকেই চান ফাল্গুনের ছোঁয়া লাগুক ঘরের সাজে। এমন চাহিদা পূরণ করতে রাজধানীর দোয়েল চত্বরে দেখা মিলে কিছুটা ভিন্ন মাত্রার ও স্বাদের মাটির-বেতের জিনিসপত্র ও নানারকমের লাইট।

এইখানকার একজন বিক্রেতা, আনোয়ার হোসেন বলেন, “করোনার জন্য ব্যবসা বাণিজ্যের ঘাটতি দেখা গিয়েছিল। তাছাড়া এখানকার দোকান উঠিয়ে দেওয়ায় বেচাকেনাতেও এর একটা প্রভাব পড়ে। তবে এখন মোটামুটি অনেকেই জানে দোকানগুলো স্থায়ী হয়েছে তাই লোকের ভিড় বাড়ছে। বিকালের পর থেকেই এখানে লোকজন বেশি আসে এবং শুক্র আর শনিবারে বেচা কেনাও ভালো হয়।”

ক্রেতা নওরীন সুলতানা ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন এসব দোকানের জিনিসপত্র।

জিজ্ঞেস করতেই বললেন “এখানে কাঠের চুড়ি ও বাঁশের তৈরি গহনা কিনতে এসেছি। এছাড়া পছন্দ হলে ঘরের সাজ এর জন্য জিনিস কিনবো।”

ফাল্গুন মানেই রং আর সজীবতার ছোঁয়া। প্রকৃতি, মানুষের মন ও সাজগোজেও পড়ে এর ছাপ। ভালোবাসা দিবস ও বসন্ত বরণ সব মিলে যেন একাকার হয়ে যায় এ মাস।

ছবি: নয়ন কুমার।