নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ, শেখাচ্ছেন রান্না

অভিজিৎ বন্দোপাধ্যায় জীবনে প্রথম যখন রান্না করেন, তার বয়স তখন ১৫ বছর।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Nov 2021, 03:49 AM
Updated : 20 Nov 2021, 03:49 AM

নামটা চেনা লাগছে? যদি সত্যিই তাকে চিনে ফেলে থাকেন, তাহলে আপনি এটাও জানেন যে কৈশোরের ওই রান্নার অভিজ্ঞতা অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিখ্যাত কোনো পাচকে পরিণত করেনি।  

তার বদলে তিনি খ্যাতি পেয়েছেন অর্থনীতিবিদ হিসেবে, ২০১৯ সালে জিতেছেন নোবেল।

অভিজিতের নিজের ভাষায়, ১৫ বছর বয়সের ওই রান্না ছিল গত চার দশকে তার হাজারো রান্নার প্রথম অভিজ্ঞতা।

রসুঁইঘরে তার এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফল হয়েছে বিস্ময়কর। বাঙালি এই অর্থনীতিবিদ লিখে ফেলেছেন একখানা রান্নার বই!

বইটির প্রকাশক চিকি সরকার বলেন, “এটা নিয়ে একটা কৌতুক আছে। সেটা হল, অভিজিৎ যত ভালো অর্থনীতিবিদ, পাচক হিসেবে তার চেয়েও বেশি ভালো।”

‘কুকিং টু সেইভ ইউর লাইফ’ নামের বইটি বাজারে এসেছে এ সপ্তাহেই। বিবিসি লিখেছে, রাস্পবেরি সেভিশে কীভাবে ঘুঁটতে হয় কিংবা প্রশান্তি এনে দেওয়া এক বাটি ডাল কীভাবে রাঁধতে হয়, শুধু সে কথাই সুখপাঠ্য এ বই বলবে না, কখন কোন খাবারটা দরকার সে কথাও পাঠককে জানিয়ে দিয়েছেন এর লেখক।  

“যদি সুক্ষ্ম রসনা রুচির পরিচয় দিয়ে অন্যকে আকৃষ্ট করতে চান, তাহলে বানান ওই রাস্পবেরি সেভিশে। যখন যদি শীতের দিনে জড়িয়ে থাকা চাদরের ওম চান, তখন দরকার ওই ডাল।”

অভিজিৎ প্রথমে তার প্রিয় কিছু খাবারের রেসিপি নিয়ে একটি সঙ্কলন করার কথা ভেবেছিলেন, যেটা তিনি বড়দিনে তার শ্যালককে উপহার হিসেবে দেবেন। কিন্তু সেই গ্রন্থনার কাজটি যখন শুরু করলেন, তার মনে হল, পাচক হিসেবে সহজাত গুণ আর গভীর বোধের চেয়েও বেশি কিছু হয়ত তার ভেতরে আছে।

“রান্না হল একটা সামাজিক কাজ। নানাভাবেই কথাটা সত্যি। কখনও আপনার রান্না করা খাবার হতে পারে আপনার পরিবারের জন্য উপহার। ভালোমন্দ রান্না করে খাইয়ে কাউকে আপনি পটাতেও পারেন। আবার কখনও কখন রান্না হল নিজেকে প্রকাশ করার উপায়।”

রান্নায় মশগুল অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

এরকম আরও অনেক মুহূর্তের জন্য জরুরি খাবারটি কীভাবে রাঁধতে হবে, সেই কৌশল এ বইয়ে শিখিয়ে দিচ্ছেন ফরাসি অর্থনীতিবিদ এস্তার ডুফলোর বাঙালি স্বামী অভিজিৎ।    

তিনি বলছেন, স্প্যানিশ ঘরানায় মটর ডালের স্যুপ তৈরির যে রেসিপি তিনি দিয়েছেন, সেটা শেষ পর্যন্ত কাউকে বিয়ের প্রস্তাবের দিকেও নিয়ে যেতে পারে। বাঙালি রন্ধনশৈলীতে খুব সহজে বানানো ‘অতি উপাদেয়’ মাছের ঝোল আপনার কেতাদুরস্ত বন্ধুটিকেও দিশেহারা করে দিতে পারে। শ্বশুরবাড়ির লোকজনের ‘আলাপের কেন্দ্র’ হয়ে উঠতে পারে বিশেষ কৌশলে রান্না করা মরোক্কান সালাদ। রাতে জম্পেশ সুরাপানের পর মসলাদার বিরিয়ানি হয়ে উঠতে পারে উপশম।

নানা পদের খাবারের গতানুগতিক চকচকে ছবির বদলে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এ রান্নার বই জ্যামিতিক নানা অলঙ্করণে ভরপুর, যা এঁকেছেন অভিজিতের পরিবারের রান্না ও গৃহস্থালীর কাজের সহায়ক শায়ান ওলিভার।

ওলিভার বলেন, “খাবারটি দেখতে কেমন হয়, তার বদলে স্বাদের বিষয়ে মানুষকে মনোযোগী করে তুলতে চেয়েছি আমরা।”

রান্নাকে কেবল অন্যকে খাওয়ানোর আনন্দ উদযাপনের উপলক্ষ হিসেবে দেখেন না অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। নানা কারণেই যে রান্নার ইচ্ছা জাগতে পারে, কখনও ইর্ষায়, কখনও অহঙ্কারে, কখনও আবার চাপে পড়েও যে মানুষকে হেঁসেলে যেতে হয়, সেসব প্রেক্ষাপটও বিশ্লেষণ করা হয়েছে তার বইয়ে।

একটি বিষয় তিনি স্পষ্ট করেছেন- অভিজ্ঞ রাঁধুনী হয়ত এ বই থেকে তার রান্নায় খুব বেশি উপকার পাবেন না। তবে এ বই তাকে এমন কিছু দিতে পারে, যা ওই রেসিপিতে নেই।

পেশাগত জীবনের বড় অংশই অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় অর্থনীতির চশমা দিয়ে বুঝতে চেয়েছেন, গরিব মানুষ কীভাবে বেঁচে থাকে। দারিদ্র্যে যখন হাত-পা বাঁধা, জীবনের সিদ্ধান্তগুলো সে কীভাবে নেয়। সেই কাজই তাকে এবং তার সঙ্গীকে নোবেল পুরস্কার এনে দিয়েছে।

একটি বিষয় অভিজিৎ বেশ স্পষ্টই বুঝতে পেরেছেন, যেটা অনেকের সাধারণ ধারণার সঙ্গে মিলবে না। সেটা হল: উপাদেয় খাবার খাওয়ার যে আনন্দ, সেটা পুষ্টির চেয়েও বেশি কিছু। ধনী কিংবা গরিব- সবার জন্যই সেটা সত্য।

আর ঠিক সেই ধারণার প্রয়োগই তিনি ঘটিয়েছেন তার রান্নার বইয়ে। পুরনো অনেক রেসিপিও তিনি অত্যন্ত কৌশলে এবং সচেতনভাবে নির্বাচন করেছেন, খুব বেশি উপকরণ ব্যবহার না করেই যা রান্না করা যায়।

অভিজিৎ বলছেন, হাতে যদি বেশি উপকরণ কিংবা অনেক বেশি সময় নাও থাকে, তারপরও কীভাবে ‘যথাযথ’ খাবারটি তৈরি করা যায়, সে বিষয়ে সহায়তা করিই ছিল তার মূল ভাবনা।       

ধরা যাক,বেশি বেশি সবজি দিয়ে একটা পদ রান্না করতে হবে, যেখানে মাংস থাকবে নামমাত্র। সেটা কীভাবে উপাদেয়ভাবে তৈরি করা যায়? কিংবা যাদের প্রথম পছন্দ রেড মিট (গরু, ভেড়া বা খাসির মাংস), সবজির মতো মুরগি রান্না করে কীভাবে তাদের তুষ্ট করা সম্ভব? কিংবা ধরুন ঘরে চিনি নেই, তারপরও কী করে ১৫ মিনিটে এক পাত্র ডেজার্ট নিয়ে হাজির হওয়া যায়? এসব প্রশ্নের উত্তর দেবে অভিজিতের বই।  

অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এ বই কোনো নির্দিষ্ট এলাকার রন্ধন প্রণালী নিয়ে রচিত হয়নি। নেপাল থেকে শুরু করে সিসিলির রেসিপিও সেখানে ঠাঁই পেয়েছে। তবে স্বাভাবিকভাবেই নিজের দেশ ভারতের রান্না, বিশেষ করে বাঙালি রন্ধনশৈলীর অনেক কিছুই সেখানে এসেছে।

নারকেল দুধের চিংড়ি থেকে শুরু করে বাঙালি কায়দার খিচুড়ির (চাল, ডাল এবং সবজি মিশিয়ে রান্না করা খিচুড়ি, যেটা অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজেরও খুব পছন্দের) মতো বাঙালির অনেক খাবারের রেসিপিই পাঠকের সামনে এনেছেন তিনি। 

ফরাসি ভাষা থেকে নেওয়া ‘হর ডাভরা’ নামে একটি অধ্যায়ে এসছে ভারতীয় স্ট্রিট ফুডের কথা। অভিজিৎ সেখানে দিয়েছেন মাসালা বাদাম আর আলুর দমের রেসিপি। আম মাখানির রেসিপিতে তিনি ব্যবহার করেছেন ভারতের জনপ্রিয় বেগুনফুলি আম।

ডালের তিনটি আলাদা রেসিপি দিয়েছেন অভিজিৎ। এই রান্নাকে তিনি “মানব সভ্যতার ইতিহাসে ভারতের সবচেয়ে বড় অবদান” হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ডালের আরও  ২০ ধরনের রান্নার কথা মনে করতে পারেন এই বাঙালি গবেষক, তবে তার ভাষায়, বইয়ের ওই তিন পদই যথেষ্ট ।