শরীরের বিভিন্ন কার্যাবলীর সঠিক সম্পাদনের দারভার থাকে অন্ত্রের ওপর। যার মধ্যে হজম তো আছেই, সঙ্গে আছে মস্তিষ্কও।
‘পিএমসি’ সাময়িকীতে ‘ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অফ বিহেভিয়োরাল নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড সাইকোলজি’য়ের করা গবেষণায় দেখা গেছে, হতাশা ও মানসিক অস্বস্তি দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সুস্থ অন্ত্র।
অন্ত্রের সঙ্গে মস্তিষ্কের কীভাবে সম্পর্ক থাকতে পারে তা ভেবে হয়ত অনেকেই অবাক হবেন।
অন্ত্রের পরিচিতি
অন্ত্র, ‘গাট’, ‘গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টাইনাল ট্র্যাক্ট’ ইত্যাদি নানান নাম আছে এই শরীরের এই অংশের।
অস্ট্রেলিয়ার সনদস্বীকৃত পুষ্টিবিদ চেলসিয়া ম্যাককলাম ‘হ্যালো গিগিলস ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলেন, “মুখগহ্বর, খাদ্যনালী, ক্ষুদ্রান্ত্র, বৃহদান্ত্র, যকৃত, অগ্ন্যাশয়, গলব্লাডার আর পায়ুপথ- এই সবকিছু মিলে হয় অন্ত্র। এর কাজ হল খাবার বিভিন্নভাবে ভাঙা, তা থেকে পুষ্টি উপাদান শোষণ করা এবং বর্জ্য অপসারন করা।”
নিউ ইয়র্ক’য়ের সনদস্বীকৃত পুষ্টিবিদ লরেন কেলি বলেন, “মানুষ সাধারণত যখন অন্ত্র নিয়ে কথা বলে তখন মূলত আলাপ হয় ক্ষুদ্রান্ত্র নিয়ে যেখানে থাকে অসংখ্য উপকারী ও অপকারী ব্যাক্টেরিয়া। আর বিশেষজ্ঞরা এই অংশ নিয়ে আলাপ করা সময় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আলোচনার বিষয়বস্তু হয় ‘গাট মাইক্রোবায়োম’ বা সকল ব্যাক্টেরিয়ার সমষ্টি নিয়ে যা ওই ক্ষুদান্ত্রে বাস করে।”
‘নিউট্রিশনাল সায়কায়াট্রিস্ট ডা. উমা নাইডু তার বই ‘ইস দিস ইউর ব্রেইন অন ফুড’য়ে লিখেছেন, “অন্ত্রে উপকারী আর অপকারী ব্যাক্টেরিয়ার স্বাস্থ্যকর মিশ্রণ বিদ্যমান থাকে স্বাভাবিক অবস্থায়। তবে মানসিক চাপ আর খাদ্যাভ্যাসের ভুলের কারণে সেই স্বাস্থ্যকর মিশ্রণ নষ্ট হয়। আর সেই থেকেই মস্তিষ্কের ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি হয়।”
অন্ত্র আর মস্তিষ্কের সম্পর্ক
মস্তিষ্ক আর অন্ত্র শরীরে দুই প্রান্তের দুটি অঙ্গ হওয়ার কারণে স্বভাবতই মনে হতে পারে এদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। প্রকৃতপক্ষে এই দুই অংশের মধ্যে যোগাযোগ আছে ‘ভেগাস’ নামক স্নায়ুর মাধ্যমে।
এই স্নায়ু শরীরের বিভিন্ন কার্যাবলী নিয়ন্ত্রণ করে। যেমন- মানসিক অবস্থা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, হৃদস্পন্দন এবং হজম।
এর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল মস্তিষ্ক আর অন্ত্রের মধ্যকার তথ্যগুলো স্নায়ুর মাধ্যমে কার্যকরভাবে আদান প্রদান হচ্ছে কি-না তা নিশ্চিত করা।
নাইডু তার বইতে আরও লিখেছেন, “মস্তিষ্ক আর অন্ত্রের মধ্যকার সম্পর্ক বোঝার সহজ উপায় হল কীভাবে মুখ দিয়ে ওষুধ খেলে মাথায় ব্যথা সেরে যায় সেইটা নিয়ে চিন্তা করা।”
“একজন মানুষ যখন মাথাব্যথার ওষুধ খায় তখন তা মাথায় তো যায় না, বরং অন্ত্রের বিভিন্ন অংশ দিয়ে যায় এবং ভাঙতে থাকে। এক সময় ওই ওষুধ থেকে যে রাসায়নিক উপাদান নিঃসৃত হয় তা অন্ত্রে শোষিত হয় এবং সেখান থেকে পৌঁছায় মস্তিষ্কে এবং মাথাব্যথা ভালো হয়। একই ভাবে অন্ত্রের ব্যাক্টেরিয়া যে রাসায়নিক উপাদান তৈরি করে সেটাও মস্তিষ্কে পৌঁছায়। আবার মস্তিষ্ক থেকেও রাসায়নিক উপাদান আসে অন্ত্রে।”
নিউ ইয়র্কের ‘নিউরোসাইকোলজিস্ট’ ডা. সানাম হাফিজ বলেন, “মস্তিষ্কে আর অন্ত্রে যে রাসায়নিক উপাদানগুলো তৈরি হয় সেগুলো বেশিরভাগই মন মেজাজ নিয়ন্ত্রক ‘নিউরোট্রান্সমিটার’। যেমন- ‘ডোপামিন’ ‘সেরোটনিন’ এখানেই তৈরি হয় এবং এগুলো নিয়ন্ত্রণ করে যথাক্রমে মেজাজ ও ঘুম। এমনকি প্রায় ৯০ শতাংশ ‘সেরোটনিন রিসেপ্টর’ও থাকে ওই অন্ত্রেই।”
নাইডু’র বই থেকে আরও জানা যায়, “মস্তিষ্কের অনেকগুলো রাসায়নিক উপাদান তৈরি হয় অন্ত্রে, আর সেকারণেই মস্তিষ্ক আর অন্ত্রের সম্পর্কটা এত গভীর। অন্ত্রের ব্যাক্টেরিয়ার ভারসাম্য নষ্ট হলে ওই রাসায়নিক উপাদানের উৎপাদনও নষ্ট হয়। যেমন- ‘ডোপামিন’ ও ‘সেরোটনিন’য়ের অভাব দেখা দিয়ে মস্তিষ্কের ওপর তার সরাসরি প্রভাব পড়বে।”
কোন খাবার এক্ষেত্রে উপকারী?
অন্ত্রের স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে যদি মানসিক স্বাস্থ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে তো অন্ত্রের যত্ন নিতেই হবে। আর শুরুটা হবে খাদ্যাভ্যাস থেকেই।
ম্যাককলাম বলেন, “ফল, সবজি, শষ্যজাতীয় খাবার, বীজ, লতাগুল্ম, মসলা সবকিছুরই অন্ত্রের স্বাস্থ্য ভালো রাখায় ভূমিকা আছে। ফল ও সবজি খাদ্যাভ্যাসে যত বেশি থাকবে মানসিকভাবে একজন মানুষ ততই প্রফুল্ল থাকবে। জীবন নিয়ে তাদের সন্তুষ্টি থাকবে বেশি। এর পেছনে ভূমিকা রাখবে ওই ফল আর সবজির সরবরাহ করা ভিটামিন এবং খনিজ উপাদান।
নাইডু তার বইতে জানিয়েছেন, “প্রোবায়োটিক’ আর ‘প্রিবায়োটিক’ ধরনের খাবার অন্ত্রের সুস্বাস্থ্যের জন্য অনন্য। এমনকি অন্ত্রের স্বাস্থ্যহানি থেকে হওয়া হতাশা দূর করতেও তা কার্যকর। যেমন- টক দইতে পাওয়া যায় এমন একটি অন্ত্রের ব্যাক্টেরিয়া ‘ল্যাকটোব্যাসিলাস’ যা মানুষের হতাশা কমায়, এমনটা দেখা গেছে গবেষণায়।”
কেলি বলছেন, “‘প্রোবায়োটিক’ ও ‘প্রিবায়োটিক’ আছে এমন খাবার হল বিভিন্ন ধরনের ‘ফার্মেন্টেইড’ বা গাঁজানো পদ্ধতিতে তৈরি করা খাবার। যেমন- দই, টক দই, আচার, ‘খিমচি’, ‘মিসো’, ‘কেফির’ ইত্যাদি।”
কেলি আরও বলেন, “মানসিক সুস্বাস্থ্যের জন্য ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড গুরুত্বপূর্ণ। ভোজ্য উৎস থেকে শরীরে পর্যাপ্ত ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড যদি না আসে তবে দেখা দিতে পারে মানসিক অসুস্থতা, হতাশা, অস্বস্তি, ‘বাইপোলার ডিজওর্ডার’, ‘সিজোফ্রেনিয়া’, ‘ডিমেনশা’ এবং ‘অটিজম’।”
ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডের যোগান মিলবে স্যামন, সার্ডিনস, হেরিং, ম্যাকারেল ইত্যাদি সামুদ্রিক মাছ থেকে।
“পলিফেনল’ পাওয়া যায় এমন খাবার যেমন- ‘গ্রিন ট্রি’, ডালিম ইত্যাদিও অন্ত্রের স্বাস্থ্যকর ব্যাক্টেরিয়াকে সমৃদ্ধি আনে। গ্রিন টি বাড়ায় অন্ত্রের ব্যাক্টেরিয়া ‘বিফিডোব্যাক্টেরিয়া’। এই ব্যাক্টেরিয়া হজমে সাহায্য করে, কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।
যে খাবারগুলো পরিমাণ বুঝে খেতে হবে তার মধ্যে আছে চিনিযুক্ত খাবার, ভোজ্য আঁশ কম এমন ‘কার্বোহাইড্রেইট’ ‘স্যাচুরেইটেড ফ্যাট’ এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার।
তবে ওষুধ ও থেরাপি যে প্রয়োজন নেই তা কিন্তু নয়। খাবার দিয়েই সকল মানসিক সমস্যার সমাধান হবে না। তাই সমস্যা মনে হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে।
আরও পড়ুন