কালাইয়ের রুটি চাঁপাইনবাবগঞ্জের একটি ঐতিহ্যবাহী ও জনপ্রিয় খাবার। পুষ্টিকর ও মুখরোচকও বটে।
একসময় মাসকলাইয়ের ডালের সহজলভ্যতার কারণে এই অঞ্চলে কালাই রুটির ব্যাপক প্রচলন হয়। মাঠে কাজ করা শ্রমজীবী মানুষের জন্য এই রুটি ছিল প্রতিদিনের খাবার।
আকারের দিক থেকে কালাইয়ের রুটি সাধারণ রুটির প্রায় দ্বিগুন, সেটা ব্যাসার্ধ আর পুরুত্ব দুই হিসেবেই।
রুটির তৈরির প্রক্রিয়া জানতে যাওয়া হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ মাস্টার পাড়ার গেরস্ত বাড়ি মাস্টার মঞ্জিলে।
এই বাড়ির গৃহিনী আমেনা খাতুন বলেন, “দুটি কালাইয়ের রুটি তৈরি করতে মাসকলাইয়ের আটা লাগবে প্রায় ২৫০ গ্রাম। সঙ্গে মেশানো হয় ১০০ গ্রাম চালের আটা, সেটা আতপ চালের হলে ভালো। আর লবণ পরিমাণ মতো।”
“আটার মিশ্রণের ওপর নির্ভর করে রুটির রং কেমন হবে। কালাইয়ের আটা বেশি থাকলে রুটি শক্ত হবে, আর চালের আটা বেশি দিলে রুটি হবে নরম। তবে সাধারণ রুটি, পরোটার তুলনায় কালাইয়ের রুটিকে শক্তই বলতে হবে।”
সব উপকরণ একসঙ্গে পরিমাণ মতো মিশিয়ে পানি দিয়ে মণ্ড তৈরি করা হল। সেই মণ্ড থেকে একটি টেনিস বলের আকারের সমান মণ্ড তুলে একটি রুটি বানানোর কাজ শুরু হয়।
রুটি সেঁকা হয় বিশেষ আকৃতির মাটির পাত্র বা খোলায়। চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাইরে অন্যান্য জেলায় যারা বাস করেন তারা শুধু এই রুটি বানানোর জন্য এলাকা থেকে এই মাটির খোলা কিনে নিয়ে যান, বলে জানান আমেনা খাতুন।
রুটি সেঁকার এক পর্যায়ে তা ফুলে উঠে অন্যান্য রুটি, পরোটার মতো করেই। তবে এখানেই রুটি দুটি অংশে ভাগ হয়ে যায়।
আটার রুটি, পরোটা আগাগোড়াই নরম। তবে কালাইয়ের রুটির নিচের অংশটা নরম আর ওপরের অংশ কুড়মুড়ে চিপসের মতো। স্থানীয় ভাষায় একে বলে ‘বুকলা’।
কালাইয়ের রুটির প্রকৃত স্বাদ পেতে হলে তা গরম অবস্থায় খেতে হবে। এই রুটি মূলত সকালের নাস্তার পদ হলেও অনেকে রাতেও খান আজকাল।
রুটি বানাতে বানাতে নিজের শৈশবে ফিরে যান আমেনা খাতুন।
বলেন, “চাঁপাইনবাবগঞ্জের স্থানীয় ভাষায় সকালের নাস্তাকে বলা হয় ‘লাহারি’। গেরস্ত বাড়ির মানুষগুলো খুব ভোরে বাড়িতে চুলা জ্বালার আগেই বেরিয়ে যেতেন মাঠে কাজ করতে। পরে ঘরের বউ লাহারি বানাতে বসতেন।”
“এই রুটি খেতে হয় ‘নুন’ আর ‘বাগুনের সানা’ দিয়ে। পেঁয়াজ ও মরিচ কুচি, শুকনো মরিচ বাটা দিয়ে বানানো লবণ আর সরিষার তেলের মিশ্রণ। স্থানীয় ভাষার এই মিশ্রন ‘নুন’ নামে পরিচিত। অনেক সময় তাতে যোগ করা হয় ধনেপাতা-বাটা চাটনি।”
মাটির চুলার কিনারার ওপর দিয়ে আসা গুনা তারের শেষ প্রান্তটা চেপের রাখা হত রুটি বানানো খোলা দিয়েই। রুটি খোলায় দেওয়ার আগে তা গরম করতে হয়। আর সেই সময়টাতেই পুড়িয়ে নেওয়া হয় বেগুন।
পোড়ানো হয়ে গেলে ওপরের পোড়া খোসা তুলে নিয়ে ভেতরের শাষের সঙ্গে আবার বাটা লবণ, পেয়াঁজ ও মরিচ কুঁচি মিশিয়ে তৈরি হয় ভর্তা।
এবার ‘লাহারী’ পাঠানোর পালা। রুটির বুকলার ওপর নুন আর বেগুন ভর্তা মাখিয়ে গামছা দিয়ে বেঁধে পরিবারের ছোটদের হাতে দিয়ে মাঠে বাবার কাছে পৌঁছে দেওয়ার গুরুদায়িত্ব দেওয়া হত।
আরেকহাতে একটা টুকরা রুটির ভেতর নুন আর বেগুন ভর্তা মাখিয়ে ভাঁজ করে দিয়ে বলা হয় খেতে খেতে যাও। বাচ্চাদের কাছে এর আদুরে নাম ‘পটি করা উটি’।
শহুরে মানুষ হয়ত এর সঙ্গে স্যান্ডউইচের মিল পাবেন।
এককালের গেরস্ত বাড়ির মানুষগুলোর এমন অসংখ্য স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই রুটির সঙ্গে। রুটিকে ঘিরে এই গল্পগুলো তাই কোনো নথিভুক্ত ইতিহাস নয়।
আগেকার গেরস্ত বাড়ির দাদি নানীদের জীবনের স্মৃতি আউড়ানো গল্প। গ্রামের যে বাসিন্দাদের বয়স আজ পঞ্চাশের কোঠায় তাদের কর্মজীবনটাও এমনই ছিল।
যাদের বয়স আজ ত্রিশ ছুঁই ছুঁই তারাও বাবাকে ‘লাহারী’ দিতে যাওয়ার স্মৃতি মনে করেন।
শুধু স্বাদ নয়, ওই স্মৃতিগুলো আবার মনে করার জন্য হলেও কৃষিকাজ ছেড়ে দিলেও কালাইয়ের আজও ক্ষেত থেতে ‘ডাইনিং টেবিল’ পর্যন্ত সবখানেই শোভা পায় সগৌরবে।
কালের বিবর্তনে সব অঞ্চলেই কৃষিজীবী গেরস্ত বাড়ি কমেছে, কালাইয়ের চাষ কমেছে। একসময় যে রুটি সব ঘরেই তৈরি হত, আজ তা চাঁপাইনবাবগঞ্জের অনেক ঘরে সৌখিন খাবারে পরিণত হয়েছে।
ঘরে কালাইয়ের রুটির সহজলভ্যতা কমলেও স্থান পেয়েছে দোকানে। বাস কিংবা রেলস্টেশনের আশপাশে এই রুটির দোকার সবচাইতে বেশি চোখে পড়বে। দোকান আর রুটির আকারভেদে দাম ১০ থেকে ২০ টাকা।
সঙ্গে ‘নুন’ আর ‘বাগুনের সানা’র পাশাপাশি থাকে গরু ও মুরগির মাংস, ভুঁড়ি বা বট, নেহেরি ইত্যাদি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের নিমতলা মোড়ে এমনই একটি দোকান আলম হোটেল। মালিকের নামও মো. আলম, লেখা আছে হোটেলের সাইনবোর্ডে।
তিনি বলেন, “রাতের বেলা বাড়ির মহিলারা কালাইয়ের রুটি বানানোর ঝামেলা নিতে চায় না। তাই মানুষ হোটেলে আসে। সন্ধ্যার পুরি, শিঙ্গাড়ার আয়োজন শেষ হওয়ার পর শুরু হয় কালাইয়ের রুটির আসর। চলে রাত ১১টা পর্যন্ত।
“তবে এখন লকডাউনে পুরোপুরি বন্ধ। শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জ না, রাজশাহী শহরেও গড়ে উঠেছে কালাইয়ের রুটির দোকান যেগুলো খুপরি বা ঝুপরি নামেই পরিচিত।”
“দুটো কালাইয়ের রুটি একবারে খাওয়া শুধু গায়ে গতরে খেটে খাওয়া মানুষের পক্ষেই সম্ভব। চাকরিজীবী মানুষগুলো সকালে অর্ধেক কিংবা খুব মজা হলে একটা রুটি খেয়েই দুপুর পযন্ত কাটিয়ে দিতে পারে।” বললেন মোখলেস মিয়া।
ভারি খাবার হওয়াতে এই রুটি শ্রমজীবী মানুষের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে ওঠার আরেকটি বাস্তবমুখী কারণ ছিল। তবে দোকানে যারা রাতে খেতে আসেন তাদের অনেকেই শখ করে আসেন। এজন্য আমরা ছোট করে রুটি বানাই। স্থানীয় ভাষায় এতে ‘টিকলি’ বলে অনেকসময়।”
“সঙ্গে পাওয়া যায় বট, গরুর ভাজা মাংস, পেঁয়াজ-মরিচ-ধনেপাতা চাটনি, গরু আর মুরগির ঝোল করে রান্না করা মাংস ইত্যাদি। শৌখিন ক্রেতারা গরুর মাংসের ঝোল দিয়ে খেতেই বেশি পছন্দ করেন।”
গরুর মাংস ১২০ টাকা, মুরগি ৯০ টাকা, বট ৬০ টাকা। আধা প্লেটও নিতে পারবেন। পেঁয়াজ-মরিচ-ধনেপাতা চাটনির দাম লাগে না।
অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের কাছে প্রথম দর্শনে ও স্বাদে এই রুটি এক বিস্ময়কর খাবার হিসেবেই হয়ত টিকে থাকবে।