কোরবানির পশু: হাটে নাকি অনলাইনে?

অনলাইনে কোরবানির পশু কেনা মহামারীর সময়ে নিরাপদ।

মামুনুর রশীদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 July 2021, 02:49 PM
Updated : 18 July 2021, 02:49 PM

করোনাভাইরাসের প্রকোপে কর্মক্ষেত্র, পড়ালেখা, কেনাকাটা, কাঁচাবাজার ইত্যাদি অনেক কিছুই আজ ঘরে বসে করা যাচ্ছে। আর অনলাইনে কোরবানির পশু কেনার সঙ্গে মহামারীর আগ থেকেই পরিচিত।

করোনাভাইরাসের তাণ্ডবের মধ্যে আবারও দেশে কোরবানীর ঈদ এসে গেল।

বাবা, দাদুর হাত ঘরে শিশুদের হাটে গিয়ে হইহুল্লোড় করে কোরবানি পশু কেনা, বাহারি রংয়ের মালা পরিয়ে হাঁটিয়ে বাসায় আনা, ফেরার পথে শ’খানেক মানুষের ‘কত পড়লো ভাই?’ এমন প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ইত্যাদি ঘটনার ঘাটতি কিছুটা পড়েই যায় এখন।

১৫ জুলাই থেকে লকডাউন শিথিল হয়েছে, মানুষ কমবেশি হাটে যাচ্ছেন। তবে ঈদের আমেজটা নেই। আর বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই আমেজটাকেও ঘরে আটকে রাখা ছাড়া উপায় নেই।

মিরপুরের আবরার হোসেন করোনা প্রকোপের আগে ছিলেন একটি ট্রাভেল এজেন্সির মালিক। অফিস বন্ধ করে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হয়েছে গত বছরই।

আক্ষেপ করে তিনি বলেন, “২০১৯’য়ের ঈদেও গ্রামের বাড়িতে লাখ টাকার ওপর ব্যয় করে গরু কিনে পরিবারের সবাই মিলে কোরবানী করেছিলাম। করোনায় বাবাকে হারিয়ে এবছর গ্রামে যাওয়া ইচ্ছেটাই যেন হারিয়ে গেছে।”

“এবার অনলাইন থেকে ছোট একটা গরু কিনেছি। আর্থিক টানাপোড়ন মুখ্য না হলেও ঢাকায় আমাদের ছোট পরিবারের জন্য এটাই যথেষ্ট। আমাদের এলাকারই একজন ফেইসবুক পেইজের মাধ্যমে অনলাইনে গরু বিক্রি করেন। তার কাছ থেকেই নিয়েছে। বিশ্বস্ত মানুষ হওয়ায় তার ঘাড়েই ছেড়ে দিয়েছিলাম সবকিছু। আমি শুধু কয়েকটা ছবি দেখে রং পছন্দ করে টাকা দিয়ে দিয়েছি।”

কীভাবে কিনলেন সে বিষয়ে জানতে চাইলে আবরার হোসেন বলেন, “ফেইসবুকে অ্যাড দেখে কয়েকটি পেইজের সঙ্গে আলাপ হয়। কেউ জ্যান্ত গরু ঈদের আগেরদিন রাতে কিংবা ঈদের সকালে গরু দিয়ে যাবে, মাংস করে নেওয়া সুযোগ। কেউ আবার মাংস করেই দেবে, জ্যান্ত দেবে না।”

“খামারটা ঢাকার বছিলা এলাকায় নদীর ওপাড়ে, জবাই হবে সেখানেই। আমার গরুটা কখন জবাই হবে সেটা ঈদের আগের দিন রাতে ফোন করে জানাবে বলেছে। তবে তাদের সকালে ১০টার মধ্যেই সব পশুই জবাই করা হয়ে যাবে। আর দুপুরের মধ্যে মাংসের কাজ। আমি জবাই থেকে মাংস ওজন করা পর্যন্ত পুরো সময়টা ওখানেই থাকব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

“আমার সঙ্গে অন্যান্য যারা ভাগ দিয়েছেন তারাও কয়েকজন থাকবেন। গল্পও হবে, কাজটাও তদারকি করা হবে। আমার গরুর দাম পড়েছে প্রায় ৮০ হাজার, মাংস কেটে বাড়িতে দিয়ে যেতে ১৪ হাজার টাকা নিচ্ছে। পুরো মাংটা আমার বাড়িতেই নিচ্ছি। অন্যান্য ভাগিদাররা আমার বাড়ি থেকেই নিয়ে যাবেন। একজন ভাগিদারের বাড়ি উত্তরায়। তিনি আলাদাভাবে প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকেই ডেলিভারি নেবেন এই গরু থেকেই।” 

তবে অনলাইন হোক আর হাটে গিয়ে, কোরবানির পশু কিনতে গিয়ে ঠকেছেন এমন মনে করা মানুষ বরাবরই থাকবেন, আর ক্রেতার থেকে অতিরিক্ত লাভ ইচ্ছে  বিক্রেতারও থাকবে। তার ব্যতিক্রম এবারও নেই।

কোথায় কিনবেন

অনলাইনে গরু কেনার বিজ্ঞাপন এখন ফেইসবুক খুললেই চোখে পড়বে। শুধু পুরুষ নয়, নারীরাও এই উদ্যোগে অংশ নিচ্ছেন। মহামারীর মাঝে হাটে গিয়ে গরু কেনার স্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়ানোর ‍সুযোগ করে দেওয়ার দেশের গবাদিপশু খামারিদের ব্যবসাতেও প্রসার বয়ে আনছে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের এই উদ্যোগগুলো।

অনলাইনে গবাদি পশু কেনাবেচার পদ্ধতি নিয়ে অনেকেরই ধারণার অভাবটা এখনও রয়ে গেছে।

দেশি গরুর পাশাপাশি ফ্রিজিয়ান, নেপালি, শাহিওয়াল, ব্রাম্মী, শংকর, ভুট্টি ইত্যাদি বিভিন্ন জাতের গরু পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন খামার ও অনলাইন পেইজে।

চাহিদার দিক থেকে দেশি গরুর চাহিদা বরাবরই বেশি। এরপরেই স্থান পেয়েছে শাহীওয়াল ও ব্রাম্মী গরু।

ফেইসবুকের বিভিন্ন পেইজ খেতে খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, জ্যান্ত গরুর ওজনের ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ ওজনের মাংস মেলে। সেই হিসেবে ২০০ কেজি ওজনের গরু থেকে পাওয়া যাবে প্রায় ১০০ থেকে ১২০ কেজি মাংস এমনটা দাবি করেন খামারিরা।

ছোট গরুর দাম ৭০ হাজার থেকে এক লাখ টাকার মধ্যে। মাঝারি গরু কিনতে গুনতে হবে এক লাখ থেকে আড়াই লাখ টাকা।

বড় গরুর জন্য খরচ হবে তিন লাখের বেশি। ছোট গরুর চাহিদা খুব বেশি। এমনকি বড় গরু কেনার মত সামর্থবান ক্রেতারাও চাচ্ছেন দুটি ছোট গরু কিনতে।

যেভাবে বিক্রি করা হয়

ফেইসবুকের মাধ্যমে গরু বিক্রি করছে এমন একটি প্রতিষ্ঠান ‘মিট বাজার ডটকম’।

তাদের কল সেন্টারে ফোন করলে সেখানকার আরিফুল ইসলাম জানান, “ক্রেতাকে গরুর ছবি ও ভিডিও দেওয়া হবে আলোচনার প্রাথমিক পর্যায়েই। চাইলে ক্রেতা স্বপরিবারে খামারে এসে গরু দেখে যেতে পারেন। সঙ্গে জীবন্ত গরুর ওজনও নিতে পারবেন। পছন্দ হলে সেখানেই বুকিং দিয়ে রেখে ঈদের আগের দিন ডেলিভারি নিতে পারেন, ওই কয়েকদিনের খরচটা পশুর দামের মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত থাকবে।”

“গরু মাংস করা হবে ঈদের দিন কুড়িল এলাকায়। বিক্রির সময়ই ক্রেতাকে তার গরুর সিরিয়াল নম্বর দিয়ে দেওয়া হবে। ক্রেতা চাইলে নিজেকে উপস্থিত থেকে মাংস করার কাজ তদারকি করতে পারেন। অথবা আমরাই কাটাকুটি আর ওজন করে মাংস তার ঠিকানায় পৌঁছে দেবো।”

তিনি আরও বলেন, “যারা ভাগ কিনতে চান তাদের জন্য পদ্ধতি হল আমাদের ফোন করলেই আমরা জানাব কত নম্বর গরুতে ভাগের বুকিং চলছে, তার জ্যান্ত ওজন, সম্ভাব্য মাংসের পরিমাণ, কোন জাতের গরু এবং সেসব অনুযায়ী ভাগের দাম। ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজারের মধ্যেই আমাদের প্রতি ভাগের দাম। এক্ষেত্রেও ক্রেতা তার গরুর মাংস কাটা ও ওজন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তদারকি করতে পারবেন। গরুর অর্ডার নেওয়া হবে ২০ তারিখ পর্যন্ত।”

একই সেবা দিচ্ছে আরেক প্রতিষ্ঠান ‘বাংলা কাট’। তাদের কল সেন্টারে ফোন করে জানা যায়, ভাগ কেনার সুযোগ সেখানে নেই, আস্ত গরুই নিতে হবে এবং মাংস তাদের কাছ থেকেই কেটেকুটে নিতে হবে।

‘ডেলিভারি’য়ের খরচ গরুর দাম ভেদে ১৬ হাজার থেকে ২৩ হাজার টাকা। ১৮ তারিখ রাত ১০টার মধ্যেকল সেন্টার বন্ধ হয়ে যাবে। তবে তাদের ওয়েবসাইটে প্রতিটি গরুর সঙ্গে তার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তির ফোন নম্বর দেওয়া আছে, সেখানে যোগাযোগ করা যাবে।

পশু নয় কাটা মাংস ঘরে আসবে

টানা সাত বছর ধরে অনলাইন কোরবানির হাটে অংশগ্রহণ করছে বেঙ্গল মিট। এই কাজের জন্য তাদের স্বতন্ত্র ওয়েবসাইটে সংগ্রহে থাকা সবগুলো গরুরই ছবি আছে।

দাম, গরুর জাত, বয়স, লিঙ্গ, খাবারের ধরন ইত্যাদির ‘ফিল্টার’ করে গরু খোঁজা যায়।

এছাড়া নির্দিষ্ট একটি গরুর পাতায় গিয়ে তার রং, জাত, বয়স, ওজন, কতদিন ধরে খাওয়ানো হচ্ছে ও কী খাচ্ছে, উচ্চতা ইত্যাদি বিভিন্ন তথ্য জানতে পারবেন। বর্তমানে ৭৫ হাজার টাকা থেকে তিন লাখ ২০ হাজার টাকা দামের গরু আছে তাদের ওয়েবসাইটে।

অনলাইন পেমেন্ট সুবিধা থাকছে। ফলে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকেই অর্ডার করা যায়। ক্রেতারা চাইলে শুধু আস্ত গরু না নিয়ে একেবারে মাংস করে নিতে পারবেন, পৌঁছে যাবে ক্রেতার ঘরে।

ঢাকার কেউ এই সুবিধা নিয়ে ঈদের দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ দিন ডেলিভারি পাবেন, মাংস পৌঁছানো হবে ‘চিলড’ অবস্থায়। এরপরে ডেলিভারি নিলে মাংস পৌঁছানো হবে ‘ফ্রোজেন’ অবস্থায়।

এগুলো ছাড়াও সাদেক এগ্রো, সামুরাই ক্যাটেল ফার্ম, মেঘডুবি এগ্রো, গ্রাস ক্যাটেল ইত্যাদিসহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর মাধ্যমে অনলাইনে কোরবানির পশু বিক্রির দিকে ঝুঁকছেন।

দেশের পরিচিত ই-কমার্স সাইটগুলোও থেমে নেই। প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছেন তাদের মতো করে।

অনলাইনে কোরবানির পশু কেনার ক্ষেত্রে পশু যাচাই-বাছাই, দামের হেরফের ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিতর্ক থাকবেই। অনেকেই এত কিছুর ঝক্কিতে না গিয়ে প্রতি বছরের মতো হাটে যাওয়াকেই হয়ত বেছে নেবেন।

যে পথেই যান না কেনো করোনাভাইরাসের কথা ভুলে যাওয়া চলবে না। তাই সবরকম সুরক্ষা নিয়ে হাটে যাওয়া নিশ্চিত করতে হবে।