একেক মাসে একেক আমের বাহারি নাম

নামে কি আসে যায়, তবে আমের ক্ষেত্রে সেটা সত্যি নয়।

লাইফস্টাইল ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 June 2021, 01:08 PM
Updated : 10 June 2021, 01:08 PM

আমের মৌসুমে এমন একজনও কি পাওয়া যাবে যিনি আম খান না? পেলে তাকে নিয়ে রীতিমতো গবেষণা হতে পারে!

তবে বিভিন্ন জাতের আম আলাদা করতে পারেন এমন জনের সন্ধান পাওয়াও দুষ্কর।

আমের যেমন রয়েছে বাহারি নাম তেমনি রয়েছে বিভিন্ন সব স্বাদ-বর্ণ-ঘ্রাণের জাত।

মধুমাস জ্যৈষ্ঠ মূলত মে মাসের মধ্য ভাগ থেকে জুন মাসের মধ্য ভাগ পর্যন্ত। তবে এর আগে পরেও পাওয়া যায় নানান জাতের আম।

রাজশাহী বিভাগের আমের রাজধানী হিসেবে খ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জের স্থানীয় বাসিন্দা শাহীনুর রহমান হিমেল। এই অঞ্চলের অধিকাংশ বাসিন্দার মতো তিনিও সাত বছর ধরে আমের মৌসুমে দেশের অন্যান্য জেলার মানুষের কাছে সুলভ মুল্যে আম পৌঁছে দিচ্ছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুক পেইজের বরাত দিয়ে।

সম্প্রতি ওয়েবসাইটও চালু করেছেন, নাম ‘দ্য চাঁপাই ম্যাঙ্গো’। আমের পুরো মৌসুম আর বিভিন্ন জাতের আমের পরিচিত পাওয়া গেল হিমেলের কাছ থেকে।

গোপালভোগ

মৌসুমের শুরুতেই মধুমাসের বার্তা নিয়ে আসে গোপালভোগ। জুন মাসের শুরু থেকে বাজারে সহজলভ্য হয় এই আম।

লোকমুখে প্রচলিত আছে, ‘হাসির রাজা গোপাল ভাঁড় আর রসের রাজা গোপালভোগ’।

এই আমের আকার গোলাকার এবং ১ কেজিতে ৪ থেকে ৭টা আম ধরে। আম চেনার সহজ উপায় হল গায়ে গুটি গুটি দাগ থাকে। অতুলনীয় মিষ্টি-স্বাদ-গন্ধযুক্ত এই আমের খোসা একটু মোটা হয় এবং আঁটি হয় পাতলা।

রানিপছন্দ

গোপালভোগের সব্যসাচী আম রানিপছন্দ।

বয়বৃদ্ধ আম চাষীদের মুখে শোনা যায়, ‘কাশিমবাজারের রানীর পছন্দে এই আম উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল বলে এই আমের নাম রাখা হয় রানিপছন্দ।’

আকারে ছোট ও গোলাকার এবং কেজিতে ৬ থেকে ৭টা হয়।

আমটি সহজে চেনার উপায় হচ্ছে, এর সম্মুখের কাঁধ অনেক বেশি স্ফীত। ফলটির বোঁটা শক্ত, খোসা পাতলা, আঁশ নেই, ত্বক মসৃণ।

আধা পাকা আমকে চাঁপাইনবানগঞ্জের স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ‘ডাক্কর’। সেই সময়ে রানিপছন্দ আমের রং হয় হালকা সবুজ। আর পাকলে হলুদ রং ধারণ করে।

চাহিদার তুলনায় এই আমের উৎপাদন বাংলাদেশে কম।

খিরসাপাত

বাংলাদেশের একমাত্র ‘জি আই’ সনদপ্রাপ্ত আম চাঁপাইনবাবগঞ্জের খিরসাপাত আম।

এই আম বাজারে হিমসাগর নামে চালানো হয়। যদিও হিমসাগর মূলত ভারতেই বেশি হয়। বাংলাদেশে উৎপাদিত মোট আমের ৩ ভাগের ১ ভাগ আমই হচ্ছে এই খিরসাপাত আম।

জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে বাজারে নামে। ৩ থেকে ৫টি আমে ১ কেজি হয়।

বোঁটা বেশ মোটা এবং শক্ত। ত্বক মসৃণ, পাকলে বোঁটার আশপাশে হলুদ রং ধারণ করে।

ফলটি সুগন্ধযুক্ত, রসালো ও অত্যন্ত মিষ্টি স্বাদের। মিষ্টি সুগন্ধ ও স্বাদের জন্য জনপ্রিয়তার দিক থেকে এ আমের স্থান শীর্ষে।

বোম্বাই

নামে বোম্বাই হলেও এটা বোম্বাই এর আম নয়। এটি মূলত ভারতের বিহারের আম। মধ্য জুন থেকে এই আম পাওয়া যায়।

৩টা আমেই ১ কেজি হয়ে যায়। খোসা মোটা আর আঁটি পাতলা। সামান্য আঁশ আছে।

ল্যাংড়া

বাংলাদেশের সেরা তিন আমের একটি এই ল্যাংড়া আম। এর ভারতীয় নাম বানারসী আম।

কথিত আছে, এক খোঁড়া ফকিরের আশপাশে এই আমের গাছের দেখা পাওয়া গেছিল বলে এই ফলের নাম এমন।

ল্যাংড়া আম

এটিও বোম্বাইয়ের মতো জুনের মধ্যভাগ থেকে পাওয়া যায়। ৪ থেকে ৫টাতেই ১ কেজি হয়ে যায়।

আম চেনা খুবই সহজ। এর একটা নাক হয়। বোঁটা চিকন আর আঁটি পাতলা। চোকলাও পাতলা হয়। আর পরিণত আমের গায়ে পাউডারের মতো গুঁড়া থাকে।

লক্ষণভোগ

লখনা আম নামেও পরিচিত। জুন মাসের শেষ দিকে পরিপক্ব হয়।

আম দেখতে অনেক আকর্ষণীয় এবং বর্ণীল। সহজেই চেনা যায়। তবে মিষ্টতা কম বলে এই আমকে অনেকে ‘ডায়াবেটিস আম’ বলে থাকেন।

১ কেজিতে গড়ে ৪টা আম পাওয়া যায়। খোসা কিছুটা মোটা হলেও আঁটি পাতলা।

হাড়িভাঙা

এটি লক্ষণভোগের সমসাময়িক আম এবং জুনের শেষ সপ্তাহেই বাজারে আসে।

রংপুর, দিনাজপুরে ব্যাপকভাবে এই আম চাষ হয়। আমের নামকরণে পেছনেও আছে লোকজ গল্প।

নফল উদ্দীন নামে এক বৃক্ষপ্রেমিক মাটির হাঁড়ি ব্যবহার করে গাছে পানি দিতেন। একদিন কে বা কারা হাঁড়িটি ভেঙে ফেলায় ওই গাছের নাম হয়ে যায় হাঁড়িভাঙা আমের গাছ।

আমের উপরদিক চওড়া আর নিচের দিক চিকন। ৩টা আমেই ১ কেজি হয়ে যায়। শাস অনেক কম, আঁশ নেই।

ফজলি

আরেক নাম ফকিরভোগ!

ফজলি বিবি নামে এক বৃদ্ধার বাড়ির আঙ্গিনা থেকে এই আম সংগৃহীত হয় এবং এর নামকরণ তিনি নিজেই করেন- আম নিয়ে চাষীদের মাঝে এমন গল্পই প্রচলিত।

বাংলাদেশে সাধারণত দুই ধরনের ফজলি দেখা যায়। নাক ফজলি আর সুরমা ফজলি।

ফজলি আম

জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে চলে আসে ফজলি আম। এই আমগুলা আকারে বেশ বড় হয়, তাই দেখেই চেনা যায়। দুটাতেও ১ কেজি হয়ে যায়।

অল্প আঁশ থাকলেও অত্যন্ত রসালো এই আম মিষ্টি। তবে সুরমা ফজলি আকারে ছোট হয়।

সুরমা ফজলির বোঁটার দিকে একটা শিরা দেখা যায় যা আমটিকে এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য দান করে। সুরমা ফজলি পাওয়া যায় না বললেই চলে।

আম্রপালি

জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহেই আম্রপালি সহজলভ্য হয়ে ওঠে।

১৯৭১ সালে এই হাইব্রিড জাতটি উদ্ভাবন করা হয়। ভারতীয় কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী ড. পিযুষ কান্তি মজুমদার 'দশেরী' এবং 'নিলম' জাতের দুটি আমের সঙ্করায়নের মাধ্যমে নতুন এ জাত উদ্ভাবন করেন।

আর তা বাংলাদেশে আসে ১৯৮৪ সালে।

প্রাচীন ভারতের বৈশালীর বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী ও নগরবধূ আম্রপালীর নামানুসারে এই আমের নামকরণ করেন এর উদ্ভাবকরা।

আকারে ছোট হলেও মিষ্টতায় সবার সেরা এই আম্রপালি। ৬ থেকে ৮টায় ১ কেজি হয়। খোসা মসৃণ বা তেলতেলে। এই আম কড়া মিষ্টি।

বারি-৪

শেষ সময়ে বেশ চড়া দামে বাজারে হাজির হয় এই সোনালি আম। জুলাইয়ের শেষ দিকে আসে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষকদের গবেষণার ফসল এই আম। সোনালি বা হলুদ রংয়ের এই আম যে কেউ এক দেখাতেই চিনে ফেলতে পারবে এর রংয়ের জন্য।

২টি বা অনেক সময় একটাতেও ১ কেজি হয়। কাঁচা থাকলে সবুজ, পাকলে হলুদ এই আম আঁশহীন। আঁটিও ছোট আর পাতলা।

আশ্বিনা

আমের মৌসুম শেষ হয় এই আম দিয়ে। একেবারে শেষ সময়ে আসা এই আমের চাহিদা থাকে তুঙ্গে।

নিচের দিক সরু আকৃতির। মজার ব্যাপার হল আমটি পাকা আবস্থায় কাঁচার মতো দেখা যায়।

ফজলির মতো এই আমও আকৃতিতে বড় হয় এবং ২ থেকে ৪টাতে ১ কেজি হয়।

আশ্বিনা আমের খোসা মাঝারি মোটা এবং শাঁস সাধারণত হলুদ ও হলুদাভাব কমলা। এই আম অগাস্ট মাস পর্যন্ত পাওয়া যায়।

আরও যত আম

মজার নামের আরও কিছু আম হল- বৌ ভুলানী, জামাই পছন্দ, চোষা, বৃন্দাবনি, গোলাপবাস, টিক্কাফারাশ, মতিচুর, দুধিয়া, দাদভোগ, গোড়ভোগ, ফুনিয়া, দিলশাদ, কাঞ্চন খোসাল, সিন্দুরি, খুদি খিরসাপাত, গোলাপ খাস, দুধিয়া, দেওভোগ, দুধস্বর ইত্যাদি।

এমন প্রায় আটশ প্রজাতির আম থাকলেও অনেক আমই প্রায় বিলুপ্তির পথে। এর মধ্যে আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জেই সাড়ে তিনশ প্রজাতি বিভিন্ন জাতের আম হয়।

কয়েক পুরুষ ধরে আমের বাগান করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমচাষী বাবু মোড়ল।

তিনি বলেন, “চাঁপাইনবাবগঞ্জে এক সময় বৃন্দাবনি, গোলাপবাস, দাদভোগসহ শত শত প্রজাতির আম পাওয়া যেত। বর্তমানে সেগুলো তেমন একটা দেখা যায় না।”

তাই তিনি মনে করেন, যথাযথ কর্তৃপক্ষের উচিত জাতগুলোকে টিকিয়ে রাখতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

আরও পড়ুন