যেকোনো বিষয়ে ভুল ধারণা দূর করার প্রধান হাতিয়ার হল সঠিক তথ্য এবং সংশ্লিষ্ট-বিষয়ক পরিসংখ্যানগুলো জানা।
করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ নিয়ে প্রচলিত ভুল ধারণা দূর করার লক্ষ্যে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত কিছু তথ্য তুলে ধরা হলো জনস্বাস্থ্য-বিষয়ক সংস্থা ‘গ্যাভি, গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিন্স অ্যান্ড ইমিউনাইজেইশন’য়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদন অবলম্বনে।
‘কোভিড-১৯’ কি ‘ফ্লু’য়ের চাইতেও খারাপ?
সব বয়সের মানুষের জন্যই ‘ইনফ্লুয়েঞ্জা’ বা ‘ফ্লু’য়ের তুলনায় ‘কোভিড-১৯’ কয়েকগুন বেশি ভয়ঙ্কর।
‘জন হপকিনস ব্লুমবার্গ স্কুল অফ পাবলিক হেলথ’য়ের প্রতিবেদন বলে, “শুধু যুক্তরাষ্ট্রে ‘কোভিড-১৯’ এখন পর্যন্ত যতগুলো প্রাণ কেড়ে নিয়েছে তা গত পাঁচ বছরে ‘ফ্লু’য়ে প্রাণহানির তুলনায় বেশি। যুক্তরাজ্যে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে অগাস্ট মাসের মধ্যে কোভিড-১৯’য়ে মৃতের সংখ্যা ‘ফ্লু’ ও ‘নিউমোনিয়া’তে মোট প্রাণহানির তুলনায় ৩.৪ শতাংশ বেশি।”
যুক্তরাষ্ট্রের ‘সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভনশন (সিডিসি)’ তথ্যানুসারে, “যুক্তরাষ্ট্রে ২০১০ সাল থেকে হিসাব করলে প্রতিবছর ‘ফ্লু’ কেড়ে নিয়েছে ১২ হাজার থেকে ৬১ হাজার প্রাণ। আর ‘কোভিড-১৯’য়ে ঝরে গেছে তিন লাখ চার হাজারেরও বেশি জীবন।”
জনস্বাস্থ্যের অন্যান্য হুমকির সঙ্গে তুলনায় কোভিড-১৯’য়ের স্থান কোথায়?
এই বিষয়টা নির্ভর করে মানুষ কোথায় থাকে, তার বয়স কেমন- এসবের ওপর।
কিছু দেশে কোভিড-১৯’য়ের ধাক্কা প্রলয়ঙ্কারী, কোথাও আবার মৃদু।
কিছু বয়সের মানুষের জন্য কোভিড-১৯ প্রাণঘাতি, কিছু বয়সের মানুষের জন্য শুধুই শারীরিক অসুস্থতা।
শুধু করোনাভাইরাস-ই যে এর জন্য দায়ী সেটাও কিছু দেশের জন্য পুরোপুরি সত্য নয়।
একটি দেশের চিকিৎসা সেবার নিম্নমান, টিকার দুষ্প্রাপ্যতা, জনসাধারণের অসচেনতা ও চিকিৎসা নিতে অনিহা ইত্যাদির কারণেও লাখো মানুষ ঝুঁকির মুখে পড়ে।
প্রাপ্তবয়স্কদের সঙ্গে তুলনা করলে করোনাভাইরাস শিশুদেরকে আঘাত হেনেছে সামান্যই, তবে শিশুদের ওপর এই মহামারীর পরোক্ষ প্রভাব সামান্য হবে না।
নিউ ইয়র্কের স্বাস্থ্য ও গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান ‘গুটমাকার ইন্সটিটিউট’য়ের হিসেবে অনুযায়ী, “গর্ভবতী মা ও নবজাতক শিশুর চিকিৎসা ব্যবস্থার মান মাত্র ১০ শতাংশ নিচে নামার কারণে প্রায় এক লাখ ৬৮ হাজার নবজাতক ও ২৮ হাজার মায়ের প্রসবকালীন জটিলতা থেকে মৃত্যু হওয়া সম্ভব। শুধু তাই নয়, প্রায় সাড়ে ২০ লাখ শিশুর গুরুতর দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে একই কারণে।”
“ইউরোপে ‘কোভিড-১৯’ রোগীর সংখ্যা যখন সর্বোচ্চ তখন এই রোগে ওই দেশে মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যা সাধারণ সময়ে ক্যান্সারের মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যার প্রায় দ্বিগুন ছিল।”
মাস্ক ব্যবহার কতটা জরুরি? আর তা দিয়ে নাক ঢাকাও কি দরকার?
সংক্রমণ ঠেকাতে মাস্ক কার্যকর উপায়। মাস্ক কতটুকু সুরক্ষা দেবে তা নির্ভর করে এর গুনগত মান, পরার ধরন এবং কতটা সময় ভালোভাবে পরে থাকছে এবং ওই ব্যক্তির আশপাশে থাকা তরলকণার বিচরণের ধরনের ওপর।
শুধু মাস্ক পুরোপুরি ভাইরাস থেকে সুরক্ষা দিতে পারে না ঠিক। তবে সুরক্ষা কবচ হিসেবে মাস্কের ভূমিকাটাই বেশি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মাস্ক পরার উদ্দেশ্য নিজেকে সুরক্ষিত রাখা নয়, আশপাশের মানুষকে সুরক্ষিত রাখা। এরসঙ্গে সামাজিক দূরত্ব আর ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা যুক্ত হলে তবেই একটি শক্তিশালী সুরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি হয়।
এখন মাস্ক দিয়ে শুধু মুখ ঢেকে আর নাক অনাবৃত রাখলে সুরক্ষার মাত্রা অর্ধেকটাই কমে গেল, ফলে মাস্ক পরাটাই অনেকাংশে পণ্ডশ্রমে পরিণত হলো।
মুখ মাস্কে ঢাকা থাকলেও নাক দিয়ে নিঃশ্বাসের সঙ্গে ভাইরাসযুক্ত তরলকণা প্রবেশ করতেই পারে বিনা বাধায়। একইভাবে চোখ সুরক্ষিত রাখাও জরুরি। বিশেষত, যেসব পরিস্থিতিতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা অসম্ভব।
অন্যদেশকে টিকা পেতে সাহায্য করায় সরকারে লাভ কী?
শুধু দান কিংবা বিবেকের তাড়না থেকে নয়, একটি দুস্থ রাষ্ট্রকে টিকা সরবরাহের মাধ্যমে সরবরাহকারী রাষ্ট্রেরও সুবিধা নিহিত।
চীনের উহান থেকে শুরু হওয়া মহামারী মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে বিশ্বের ১৮০টি দেশে আঘাত হানে।
এর মানে হল বিশ্বের একটি দেশেও যদি ভাইরাসের অস্তিত্ব থেকে যায় তবে পুরো পৃথিবীরই ঝুঁকি থেকে যায়। তাই পৃথিবীর সবগুলো দেশে পর্যাপ্ত টিকা পৌঁছানো এবং সিংহভাগ জনগোষ্ঠীর টিকা গ্রহণ নিশ্চিত করার মাধ্যমে মৃত্যু ও অসুস্থতার তীব্রতা কমাতে না পারলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, পর্যটন কোনো কিছুই স্বাভাবিক হওয়া সম্ভব নয়।
২০০৯ সালের ‘এইচওয়ানএনওয়ান সোয়াইন ফ্লু’ মহামারীর সময় কিছু দেশ টিকা মজুদ করে। একই ঘটনা পুনরায় যদি ঘটে তবে বর্তমান মহামারী আরও অনেক দীর্ঘায়িত হবে।
বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোতে টিকা দান করা লাভ-ক্ষতির হিসাব বলে, প্রতি এক মার্কিন ডলার খরচ করার সুবাদে পরবর্তী সময়ে ধনী দেশগুলো ভবিষ্যত লোকসান কমাতে পারবে প্রায় ৪.৮০ মার্কিন ডলার পরিমাণ।
টিকা ছাড়া কি ‘হার্ড ইমিউনিটি’ পাওয়া সম্ভব?
‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জন করার সবচাইতে কার্যকর উপায় যে গনহারে টিকাদান তার স্বপক্ষে সাক্ষ্য দেয় ইতিহাস।
এর বিকল্প হল প্রায় ৬০ শতাংশ জনগোষ্ঠী সংক্রমিত থেকে যাওয়া, অর্থাৎ সংক্রমণের লাগাম ছেড়ে দেওয়া।
এভাবে সংক্রমণের শিকার হওয়ার মাধ্যমে প্রাকৃতিকভাবে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জনের চেষ্টা করলে মৃত্যুর হার হবে আরও অনেক বেশি বর্বর।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘স্ক্রিপস রিসার্চ ইনস্টিটিউট’য়ের রোগ-প্রতিষোধক বিশেষজ্ঞ ক্রিস্টিন অ্যান্ডারসেন’য়ের মতে, “করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক ‘ইমিউনিটি’ টিকে থাকে সর্বোচ্চ কয়েক বছর। তাই প্রাকৃতিকভাবে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জন করতে চাওয়া ডেকে আনবে অপ্রয়োজনীয় এবং অবর্নণীয় মাত্রার মৃত্যু।”
অল্প সময়ে তৈরি হওয়া টিকা কী ভরসাযোগ্য?
‘কোভিড-১৯’ টিকা যে অল্প সময়ে তৈরি হয়েছে তা বিশ্বে নজিরবিহীন। এর পেছনে ছিল অভূতপূর্ব বৈশ্বিক আর্থিক ও মেধার বিনিয়োগ। এখন পর্যন্ত যতগুলো টিকা স্বীকৃতি পেয়েছে সবগুলোই বিশদ ‘ক্লিনিকাল ট্রায়াল’য়ের মধ্য দিয়ে গেছে, সঙ্গে ছিল শক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থাও।
‘কোভ্যাক্স’ টিকার উৎপাদন তদারকি হয় ‘গ্যাভি, দ্য কোয়ালিশন ফল এপিডেমিক প্রিপেয়ারডনেস ইনোভেইশন (সিইপিআই)’ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইডও)’র মিলিত উদ্যোগে।
প্রস্তুতকারকরা উৎপাদন শুরু করে টিকা অনুমোদন পাওয়ার আগে থেকেই। এমন উৎপাদন সিদ্ধান্ত ঝুঁকিপূর্ণ হলেও অনুমোদন পাওয়া সঙ্গে সঙ্গেই টিকা সরবরাহ করা সম্ভব এমন নিশ্চয়তা আসে সেই ঝুঁকি থেকেই।
আর এর বিকল্প হতে পারতো কয়েক বছরের বিলম্ব।
পুনরায় বা একাধিকবার সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি কেমন?
সাধারণ সর্দিজ্বরের পেছনেও দায়ী করোনাভাইরাসের-ই একটি ধরণ। সেগুলোর মতো ‘কোভিড-১৯’ রোগ সৃষ্টিকারী করোনাভাইরাসও একজন মানুষকে একাধিকবার সংক্রমিত করতে সক্ষম, আর এমন ঘটনার নজির দেখাও গেছে একাধিকবার।
পর্যালোচনামূলক মেডিকেল সাময়িকী ‘দ্য ল্যানসেট’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, “দ্বিতীয়বার সংক্রমিত হলে উপসর্গের দিক থেকে তা প্রথম সংক্রমণের তুলনায় আরও ভয়ানক হয়। এমনকি ‘অ্যান্টিবডি টেস্ট’ থেকে দেখা যায় যে, শরীরে ভাইরাসের বিরুদ্ধে ‘অ্যান্টিবডি’ তৈরি হয়েছে, তারপরও পুনরায় সংক্রমণ সম্ভব। তবে হ্যাঁ, সম্ভাবনা কম।”
একটি ভাইরাস সংক্রমণের শিকার হওয়ার পর শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার সেই ভাইরাসের বিরুদ্ধে নেওয়া বিশদ জটিল প্রতিক্রিয়ার একটি অংশ হল ‘অ্যান্টিবডি’।
তাই শুধু ‘অ্যান্টিবডি’ করোনাভাইরাসকে প্রতিহত করার জন্য যথেষ্ট নয়।
নিয়মিত সাবান দিয়ে ধোয়া কি করোনাভাইরাস থেকে বাঁচাতে যথেষ্ট?
মাস্ক ব্যবহারের মতো নিয়মিত সাবান দিয়ে হাত ধোয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে শুধু এটাই করোনাভাইরাস থেকে বাঁচাতে সর্বেসর্বা নয়। সকল স্বাস্থ্যবিধি একে অপরের পরিপূরক, সবকিছু সঠিকভাবে মেনে চলার মিলিত প্রয়াসেই সৃষ্টি হয় সুরক্ষা।
তাই হাত ধোয়া যেমন বন্ধ করা যাবে না তেমনি শুধু হাত ধুয়ে অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি না মানলে কাজ হবে না।
সুস্থ আর স্বাস্থ্যবান হলেই কি একজন মানুষ নিশ্চিন্ত থাকতে পারে?
স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা মেনে চলা অনেক খেলোয়াড়, ব্যায়ামবীরও করোনাভাইরাসের কাছে ধরাশায়ী হয়েছেন, এমনকি প্রাণও হারিয়েছেন অকালে।
২৫ থেকে ৪৪ বছর বয়সিদের ‘কোভিড-১৯’য়ে মৃত্যুর হার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক পরিসংখ্যান বলে, ২০২০ সালের জুলাই মাসে অন্যান্য মাসগুলোর তুলনার ‘কোভিড-১৯’য়ে প্রায় ১২ হাজারের বেশি ওই বয়সের মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
যার প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রে বিশের কোঠায় যাদের বয়স তাদের জন্য ২০২০ সালের জুলাই মাসটি ছিল সবচাইতে প্রাণঘাতি।
আবার এটাও ঠিক যে তাদের সবার মৃত্যুর কারণ সরাসরি করোনাভাইরাস ছিল না, তবে ছিল বড় ধরনের ভূমিকা।
আরও পড়ুন