মহামারীর সময়ে জীবনযাত্রা পরিবর্তনের সুফল

করোনাভাইরাস মহামারী মোকাবেলা করতে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে জোরদার করাও গুরুত্বপূর্ণ।

লাইফস্টাইল ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 May 2021, 06:12 AM
Updated : 19 May 2021, 06:13 AM

আর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করতে সার্বিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন করতে হবে যা স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা গড়ে তোলার মাধ্যমেই সম্ভব।

পুষ্টি-পরামর্শক ড. কুমকুম ইয়াসমিন অন্তত তাই মনে করেন। 

কাজের সূত্রে রাজশাহীতে থাকা এই পুষ্টিবিদ বলেন, “মহামারীর সময়ে ভালো থাকতে চাই জীবনযাত্রায় পরিবর্তন। দৈনিক খাদ্যতালিকা থেকে প্রযোজনীয় পুষ্টির চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করতে হবে।”

তিনি জানিয়েছেন, স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা গড়ে তোলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু কর্তব্য সম্পর্কে।

আপনার চাহিদা কতটুকু?

দেশে লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকেই মানুষের মাঝে যেকোনো কিছু বেশি করে কেনার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সামর্থ থাকলে মানুষ দৈনিক চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি পুরো মাসের চাহিদার সমান যোগান একবারে কিনে রাখতে চান। ভয়, পাছে যদি আর না পাই।

নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ার পেছনে এই প্রবণতাও কিছুটা দায়ী। আর চাহিদার বেশি যোগান যার আছে, তার ব্যবহারও চাহিদার বেশি হয়ে যাওয়া খুবই সহজ। আর অপচয় তো হচ্ছে অবশ্যই।

শুধু নিজের প্রয়োজনের যোগান নিয়ে নয়, অন্য মানুষের প্রয়োজনের যোগান নিয়েও ভাবতে হবে এই সময়ে। খাবারের ক্ষেত্রে তাই নিজের যতটুকু দরকার ততটুকুই কেনা উচিত।

এতে আপনার খাওয়া যেমন নিয়ন্ত্রণে থাকবে, অপচয় কমবে, তেমনি অন্যরাও তাদের চাহিদা মেটানোর যোগান পাবে। 

তাজা খাবারে জোর দেওয়া

মহামারীর কাল বলে নয়, যেকোনো সময়ই সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে যেকোনো খাবার টাটকা খাওয়া হল প্রথম শর্ত। বিশেষত, ফল আর সবজি যতটা প্রাকৃতিক এবং সতেজ খাওয়া হবে, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা জোরদার করতে ততটাই কাজে আসবে।

প্রক্রিয়াজাত-শষ্যজাতীয় খাবার বাদ দিয়ে যথাসম্ভব ‘হোল গ্রেইন’ খাবার বেছে নিতে হবে। কৌটাজাত খাবার, অতিরিক্ত লবণ, চিনি ও কৃত্রিম চিনি এড়াতে হবে।

রোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী, “গাঢ় সবুজ পত্রল শাকসবজি, ‘সিট্রাস’ ঘরানার ফল- লেবু, কমলা, টমেটোতে প্রচুর ভিটামিন, খনিজ ও আঁশ মেলে। তাই যেকোনো প্রক্রিয়াজাত ‘জাঙ্ক ফুড’য়ের চাইতে এগুলো বহুগুণ উপকারী।

খাবার তৈরিতে সতর্কতা

আগুনে রান্না করলেই যে যেকেনো খাবার নিরাপদ হবে তা ঠিক নয়। তাই রান্না করে হোক কিংবা কাঁচা খাওয়া হোক, মুখে তুলে নেওয়ার আগে তা পরিষ্কার ও জীবাণুমু্ক্ত করা সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ

আর এমন মহামারীকালে তা আরও বেশি জরুরি। স্বাস্থ্যকর উপায়ে তৈরি করা খাবারই নিশ্চিত করতে পারে যেকোনে খাদ্যবাহী রোগ থেকে সুরক্ষা।

লবণ কম খাওয়া

মাত্রাতিরিক্ত লবণ হৃদযন্ত্র ও রক্তনালীতে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। সকল সমস্যা মূল হোতা হল লবণের মূল উপাদান সোডিয়াম।

অতিরিক্ত সোডিয়ামের কারণে অন্ত্র ও বৃক্ক দুটোই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এই দুটি অঙ্গের দুর্বলাবস্থা থাকলে কখনই সম্ভব নয়।

শরীরে সোডিয়ামের আধিক্য থাকলে সংক্রমণ সৃষ্টিকারী জীবাণু সেখানে যেমন সক্রিয় হয় তেমনি সেই জীবাণুকে ধ্বংসকারী জিন দমে যায়।

খাদ্যাভ্যাসে লবণ কম থাকার সুবাদে হৃদযন্ত্রের সুস্থ থাকা ও সংক্রমণ থেকে সুরক্ষিত রাখতেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। বিশেষত, করোনাভাইরাস যা শ্বাসতন্ত্রকে আক্রান্ত করে সেখানে সুস্থ সবল হৃদযন্ত্র বাড়তি সুফল বয়ে আনে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দিনে সর্বোচ্চ পাঁচ গ্রাম লবণ খাওয়ার পরামর্শ দেয়, যা প্রায় এক চা-চামচ পরিমাণ।

খাদ্যাভ্যাসের অন্যান্য খাবারের তুলনায় আচার খাওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্ক থাকা উচিত। কারণ 

চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণ

ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, হাঁপানি ইত্যাদি দূরারোগ্য ব্যধি যাদের আছে এবং বৃদ্ধদের করোনাভাইরাস সংক্রমণে সংকাপন্ন পরিস্থিতির শিকার হওয়া আশঙ্কা বেশি। বিশেষত, ডায়বেটিসে আক্রান্ত রোগীদের রক্তে শর্করার মাত্রায় তারতম্যের কারণে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অত্যন্ত দুর্বল হয়।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপর চিনির রয়েছে গুরুতর ক্ষতিকর প্রভাব। অতিরিক্ত মিষ্টি খাবার খাওয়া কারণে শরীরের কিছু কোষ সাময়িকভাবে কাজ করা বন্ধ করে দেয়।

এই পরিস্থিতি প্রায় পাঁচ ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে, আর সেসময় সেই কোষগুলো নিজেকে ভাইরাস থেকে সুরক্ষিত রাখতে পারে না।

রক্তের শ্বেত কণিকার ভাইরাস ও অন্যান্য জীবানু দমন করার ক্ষমতাও দমিয়ে দেয় অতিরিক্ত চিনি।

তাই দিনে সর্বোচ্চ ৭৫ গ্রাম চিনি খাওয়া যাবে। মিষ্টি কিছু খেতে মন চাইলে প্রথম পছন্দ হওয়া উচিত মিষ্টি কোনো ফল।

পর্যাপ্ত পানি পান

শরীরের বিভিন্ন অংশে শর্করা, অন্যান্য পুষ্টি উপাদান, অক্সিজেন পৌঁছে দেওয়া থেকে শুরু করে শরীর থেকে বর্জ্য অপসারণ পর্যন্ত প্রতিটি কাজেই পানির ভূমিকা মূখ্য।

হাড়ের জোড় ও চোখ ভেজা ও পিচ্ছিল রাখে পানি। হজমতন্ত্রের কাজগুলো সঠিকভাবে সম্পাদন হওয়া জন্য পানির গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক দেড় থেকে দুই লিটার পানি অবশ্যই পান করতে হবে।

শুধু সাদা পানিই নয়- চা, কফি, শরবত, কোমল পানীয় সবকিছুই দৈনিক তরলে চাহিদা পূরণ করতে পারে।

তবে পানিই একমাত্র তরল যা পরিমাণে বেশি পান করলেও ক্ষতি নেই।

পরিমিত চর্বি ও তেল

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী, প্রতিদিন যতটুকু ‘এনার্জি’ বা শক্তি গ্রহণ করবেন তার ৩০ শতাংশেরও কম হতে হবে চর্বি। এর মধ্য থেকে ১০ শতাংশ চর্বির উৎস হতে হবে ‘স্যাচুরেইটেড ফ্যাট’।

যা পাওয়া যায় চর্বিযুক্ত মাংস, ননীযুক্ত দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, নারিকেল তেল, মাখন ইত্যাদি থেকে।

তবে অতিরিক্ত ‘স্যাচুরেইটেড ফ্যা ‘ অস্বাস্থ্যকর কোলেস্টেরল ‘এলডিএল’য়ের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। আর ‍তা হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।

রান্নায় স্বাস্থ্যকর চর্বি হিসেবে জলপাই, সয়া, সূর্যমুখী ও ভুট্টার তেল ব্যবহার করুন। ঘি, মাখন কম ব্যবহার করতে পারলে ভালো।

ডুবো তেলে ভাজা খাবার মুখের তুলে নেওয়ার আগে দুবার ভাবা উচিত। কারণ সেগুলোতে আছে বাণিজ্যিক মাত্রার ‘ট্রান্স ফ্যাট’।

চর্বিহীন মাংস ও মাছের প্রতি জোর দিন।

ভাইরাসরোধী উপাদান সমৃদ্ধ খাবার

এমন অনেক খাবার আছে যাতে থাকে ভাইরাসরোধী সক্রিয় উপাদান বা ‘নিউট্রাসিউটিকালস’। ‘নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ (এনসিডি)’ বিশেষত, প্রদাহ সৃষ্টিকারী ও ‘অক্সিডেটিভ ডিজিজ’ সামলাতে এই খাবারগুলো বেশ কার্যকর। ডায়বেটিস আর হৃদরোগ এমন রোগ।

তবে একই খাবার কোভিড-১৯’য়ের মতো সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়তেও কার্যকর।

এই খাবারগুলোর অধিকাংশই হল উদ্ভিজ্জ ফল ও শাকসবজি। যেমন- জলপাইয়ের তেল, বাদাম, চর্বিওয়ালা মাছ, বীজজাতীয় খাবার, চর্বি কম এমন দুগ্ধজাত খাবার, চা, টকদই ইতাদি।

এছাড়াও কোভিড-১৯’য়ের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উপকারী হবে- রসুন, গোলমরিচ, দারুচিনি, মাশরুম, টকদই, স্পিরুলিনা ইত্যাদি। কারণ এগুলোতে থাকা ভাইরাসরোধী উপাদান শ্বাসতন্ত্র আক্রমণকারী ভাইরাসের বিরুদ্ধে বিশেষ উপকারী।

শারীরিক পরিশ্রম

শরীরচর্চা দেহের প্রতিটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সমৃদ্ধ কোষকে সক্রিয় করে। করোনাভাইরাস মহামারীকালে ঘরবন্দি জীবনে শরীরচর্চার স্বাভাবিক রুটিন ধরে রাখা হয়ত কষ্টকর। তবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে সক্রিয় করার জন্য হালকা ব্যায়ামই যথেষ্ট।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, একজন প্রাপ্তবয়ষ্ক মানুষের সপ্তাহে মৃদু মাত্রায় আড়াই ঘণ্টা  ‘কার্ডিও’ ব্যায়াম করতে হবে। আর পুরো সপ্তাহে ৭৫ মিনিট ভারি ব্যায়াম করতে পারলে খুব ভালো।

ভিটামিন ডি’র প্রভাব

শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ থেকে সুরক্ষিত রাখতে ভিটামিন ডি’য়ের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

‘অ্যাকিউট রেসপিরাটরি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন’ বা শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের সম্ভাবনা কমায় ভিটামিন ডি।

শরীরে এই ভিটামিনের অভাব থাকলে সংক্রামক রোগ যেমন বেশি হয়।

তেমনি এর ঘাটতির সঙ্গে অসংক্রামক রোগ যেমন- ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ফুসফুসের দুর্বলতা ইত্যাদিরও সম্পর্ক পেয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

সরাসরি সূর্যালোকের সংস্পর্শে আসলে শরীরে ভিটামিন ডি তৈরি হয়। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে সূর্যের আলো গায়ে লাগানো জরুরি।

এই ভিটামিনের ভোজ্য উৎসের মধ্যে রয়েছে চর্বিযুক্ত মাছ, ডিমের কুসুম, মাশরুম, লাল মাংস ইত্যাদি।