প্রক্রিয়াজাত মাংস খেতেই মজা, উপকারী নয়

সসেজ, মিটবল বেশি খেয়েছেন তো মরেছেন।

লাইফস্টাইল ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 May 2021, 11:25 AM
Updated : 12 May 2021, 11:25 AM

যুক্তরাষ্ট্রের নিবন্ধিত পুষ্টিবিদ এবং সিনসিনাটি’তে অবস্থিত ‘সাউন্ড বাইটস নিউট্রিশন’য়ের প্রতিষ্ঠাতা লিসা অ্যান্ড্রিউস বলেন, “প্রক্রিয়াজাত মাংস আর সাধারণ মাংসের মধ্যে তফাৎ হল- তা জীবাণুমুক্ত করা হয়েছে, মেশানো হয়েছে লবণ, বাষ্প প্রয়োগ করা হয়েছে এবং তাতে দীর্ঘদিন খাওয়ার যোগ্য রাখার উদ্দেশ্যে  ‘প্রিজারভেটিভ’ মিশিয়ে কৌটায় পুরে দেওয়া হয়েছে।”

দিহেলদি ডটকমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এই পুষ্টিবিদের বরাত দিয়ে জানানো হয়, হট ডগ, সসেজ, কিমা, সালামি, স্টেক, পেপেরনি, বেইকন ইত্যাদি সবই প্রক্রিয়াজাত মাংসের বিভিন্ন রূপ।

সুপারশপগুলোতে পরিপাটি করে যে মাংস প্যাকেট করে রাখা হয় সেটাও প্রক্রিয়াজাতকরণের মধ্য দিয়ে যায়।

তবে আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ বাজারে কসাইয়ের দোকানের ঝুলিয়ে রাখা মাংস কিনতেই অভ্যস্ত। যেগুলো প্রক্রিয়াজাত মাংসের মধ্যে পড়ে না।

ওয়াশিংটন ডি.সি’তে অবস্থিত ‘কালটিভেট হেলদি’র কর্ণধার ও পুষ্টিবিদ অ্যান্ড্রেয়া জর্জেন বলেন, “যে মাংসকে তার স্বাভাবিক অবস্থা থেকে পরিবর্তীত করা হয়নি এবং তার স্থায়িত্ব বাড়ানো জন্য কোনো রাসায়নিক উপাদান প্রয়োগ করা হয়নি সেগুলোকে অপ্রক্রিয়াজাত মাংস বলা যায়।”

অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের আরেক পুষ্টিবিদের লেসি ডান’য়ের মতে, বার্গারের প্যাটিকে প্রক্রিয়াজাত মাংস মনে হলেও সবসময় তা হয়না।

‘দ্য উইমেন্স গাইড টু হরমোনাল হারমোনি’ বইয়ের এই লেখিকার কথায়, “এটা ঠিক যে প্যাটি তৈরির সময় মাংসের স্বাভাবিক আকৃতি ও অবস্থাতে পরিবর্তন আনা হয়েছে, তবে তাতে সচরাচর কোনো ‘প্রিজারভেটিভ’ কিংবা ‘নাইট্রেইট’ যোগ করা হয় না।” 

যেভাবে মাংস প্রক্রিয়াজাত হয়

মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে তৈরি হওয়া আমাদের প্রিয় খাবারগুলোর প্রস্তুতপ্রণালি অত্যন্ত জঘন্য।

‘ইউ.এস. ডিপার্টমেন্ট অফ এগ্রিকালচার’য়ের তথ্যানুসারে, সসেজ তৈরি হয় মাংসের একপ্রকার মণ্ড থেকে। হাড়ে লেগে থাকা যে মাংসগুলো খাওয়ার যোগ্য হলেও তা হাড় থেকে সহজে খুলে আনা যায় না, সেগুলোই মূলত এই সসেজ’য়ের মাংস। ধারালো ও শক্ত ছাকনির ভেতর দিয়ে প্রচণ্ড চাপ প্রয়োগ করে এই মাংসগুলো হাড় থেকে তুলে আনা হয়। আর সেই ছিলে আনা মাংসতে লবণ ও পানি মিশিয়ে তৈরি হয় সসেজে থাকা মাংসের মণ্ড। আর তাতে বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান তো থাকেই।

নাইট্রেইট’য়ের ব্যবহার স্বাস্থ্যের জন্য ভালো না

মাংসের স্থায়িত্ব বাড়াতে যে ‘প্রিজারভেটিভ’ ব্যবহার করা হয় সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হল নাইট্রেইটস এবং নাইট্রাইটস।

নাইট্রেইটস আবার মাংসে প্রাকৃতিকভাবেও তৈরি হয়।

লিসা অ্যান্ড্রিউস বলেন, “পালংশাক, কটি, সেলেরি, কেইল ইত্যাদি সবজিতে প্রাকৃতিকভাবে নাইট্রেইটস পাওয়া যায়। খাবার যখন শরীরের হজমতন্ত্র দিয়ে পার হয় তখন নাইট্রেইটস পরিণত হয় নাইট্রাইটস’য়ে। প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হওয়া নাইট্রেইটস শরীরে জন্য ক্ষতিকর নয়। তবে প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য লাল মাংসে যে রাসায়নিক নাইট্রেইটস ও নাইট্রাইটস যোগ করা হয় বাণিজ্যিক মাত্রায়, সেটা অত্যন্ত ক্ষতিকর।”

জর্জেন জানান, “নাইট্রাইটস ভিত্তিক ‘প্রিজারভেটিভ’ শরীরে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদান তৈরি করে। বিশেষ করে ‘কলোরেক্টাল’ বা মলাশয়ের ক্যান্সার।

কতটুকু প্রক্রিয়াজাত মাংস খাওয়া নিরাপদ

প্রথমত, প্রক্রিয়াজাত মাংস যদি জীবন থেকে একেবারে সরিয়ে দিতে পারেন তবে সবচাইতে ভালো। প্রক্রিয়াজাত না হলেও লাল মাংস পরিমাণে কম খাওয়াই সার্বিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।

আমেরিকান ক্যান্সার রিসার্চ সোসাইটি, স্বাভাবিক লাল মাংসই সপ্তাহের ১২ থেকে ১৮ আউন্সের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার পরামর্শ দেয়।

অ্যান্ড্রিউস বলেন, “প্রক্রিয়াজাত মাংসে যে নাইট্রেইটস পাওয়া যায় তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে খাদ্যনালী, পাকস্থলি, অগ্নাশয় ও অন্ত্রের ক্যান্সারের ঝুঁকি। আর প্রক্রিয়াজাত হোক বা না হোক, লাল মাংস যত বেশি খাওয়া হবে, স্বাস্থ্য ঝুঁকি ততই বাড়বে।”

বৃটিশ জার্নাল অফ নিউট্রিশন’য়ে প্রকাশিত এক ‘মেটা-অ্যানালাইসিস’য়ে বলা হয়, যারা অতিরিক্ত প্রক্রিয়াজাত মাংস খায় তাদের যেকোনো রোগে মৃত্যুর আশঙ্কা বেড়ে যায় ২২ শতাংশ পর্যন্ত। শুধু হৃদরোগে মৃত্যুবরণের আশঙ্কাই বাড়ে ১৮ শতাংশ। প্রক্রিয়াজাত নয় এমন লাল মাংস অতিরিক্ত খাওয়ার সঙ্গে হৃদরোগে মারা যাওয়ার বর্ধিত ঝুঁকি ১৬ শতাংশ।”

“তবে সাদা মাংস যেমন মুরগির মাংস খাওয়ার সঙ্গে এমন কোনো ঝুঁকির সম্পর্ক নেই।”

প্রক্রিয়াজাত মাংসের অন্যান্য ক্ষতিকর দিক

‘প্রিজারভেটিভ’য়ের পাশাপাশি মাংস প্রক্রিয়াজাত করতে লবণ ব্যবহার হয় প্রায় সবসময়ই। ফলে এতে সোডিয়াম থাকে অস্বাভাবিক মাত্রায় বেশি।

অ্যান্ড্রিউস বলেন, “অতিরিক্ত সোডিয়াম বাড়ায় রক্তচাপ, যা মোড় নেয় হৃদরোগের দিকে। ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ানো পেছনেও প্রক্রিয়াজাত মাংসের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।”

২০১৯ সালের এক গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে জর্জেন আরও বলেন, “যাদের হৃদরোগ ও বৃক্কের সমস্যা আছে তাদের জন্য সোডিয়াম প্রচণ্ড ভয়ংকর। ধরা যাক, একটি তিন আউন্সে স্টেক’য়ে সোডিয়াম আছে ৪৮ মি.লি.গ্রাম। অন্যদিকে তিন টুকরো বেইকন’য়ে সোডিয়াম থাকে প্রায় ৪০০ মি.লি.গ্রাম।”

“একজন সুস্থ মানুষের দৈনিক সর্বোচ্চ সোডিয়ামের চাহিদা ২৩০০ মি.লি.গ্রাম। যার ১৭ শতাংশ বা ৪০০ মি.লি.গ্রাম আছে তিন টুকরো বেইকন’য়ে।”

আরেকটা ঝুঁকি

অ্যান্ড্রিউস তুলে ধরেন লাল মাংসের আরেকটি ক্ষতিকর দিক, আর তা হলো ‘ডিমেনশা’ বা স্মৃতিভ্রংশ রোগ।

‘দ্য আমেরিকার জার্নাল অফ ক্লিনিকাল নিউট্রিশন’য়ে প্রকাশিত ৪ লাখ ৯০ হাজার অংশগ্রহণকারীর ওপর করা এক গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে অ্যান্ড্রিউস জানান, “সপ্তাহে পাঁচবারের বেশি লাল মাংস খাওয়া ‘ডিমেনশা’র ঝুঁকি বাড়িয়েছে ৬৭ শতাংশ।”

ডান বলেন, “অন্যান্য ঝুঁকি বাদ দিলেও প্রক্রিয়াজাত মাংসে ক্যালরি, স্যাচুরেইটেড ফ্যাট, কোলেস্টেরল সবকিছুই থাকে বেশি। শরীরে চর্বির মাত্রা, রক্তচাপ, প্রদাহের মাত্রা সবকিছুর ওপরেই বিরাট প্রভাব ফেলবে এই প্রক্রিয়াজাত মাংস।”

স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমানো উপায়

জর্জেন বলেন, “একবেলা নিরামিষ খাওয়া থেকে শুরু করা যেতে পারে। ক্রমেই তা বাড়িয়ে পুরো একদিন পর্যন্ত গড়াতে পারলে অনেক উপকার পাবেন। মাছ, ডিম, মুরগি ইত্যাদি খেতে পারেন নিশ্চিন্তে।”

“প্রক্রিয়াজাত মাংস মুখরোচক খাবারগুলোর অনেকটাই দখল করে আছে। চাইলেও তা জীবন থেকে পুরোপুরি সরিয়ে ফেলা সম্ভব নয়। তাই পরিমাণের দিকে নজর রাখতে হবে। সেইসঙ্গে খাদ্যাভ্যাসের অন্যান্য উপাদানগুলো কতটুকু স্বাস্থ্যকর এবং আপনার জীবনযাত্রা কতটুকু স্বাস্থ্যকর সেটাও বড় ভূমিকা রাখবে।”

জর্জেনের কথায়, “আপনার গড়পড়তা খাদ্যাভ্যাস যদি স্বাস্থ্যকর হয়, শরীরচর্চা করেন নিয়মিত তবে সপ্তাহের দুয়েকবার প্রক্রিয়াজাত মাংস খাওয়াটা বড় কোনো সমস্যার কারণ হবে না।”

ছবি: রয়টার্স।

আরও পড়ুন