দামতুয়া ঝরনা

দৈর্ঘ্যে, প্রস্থে কিংবা দেখতে সুন্দর  ও বড় ঝরনাগুলোর মধ্যে ‘দামতুয়া’ প্রথম সারিতেই থাকবে।

আহমেদ সাফিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Nov 2020, 06:53 AM
Updated : 6 Nov 2020, 07:13 AM

থাকা-খাওয়ার পরিকল্পনা ছাড়াই যেসব রোমাঞ্চপ্রিয়রা ভ্রমণে বের হয়ে যান এই লেখাটা কিংবা এই দামতুয়া ভ্রমণটা তাদের জন্যই।

করোনাভাইরাস মহামারীর পরিস্থিতি কিছুটা নমনীয় হওয়াতে যাওয়ার সুযোগ আসল। তাই সীমিত পরিসরে ভ্রমণ রুটগুলোতেও যাওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়াতে প্রথমেই মাথায় আসলো আলিকদমের এই ‘দামতুয়া’র কথা।

যাওয়ার পথে ওয়াংপা ঝর্ণার উপরের ঝিরি

যদিও অনেক আগ থেকেই এই পথে একটা ঢুঁ মারার ইচ্ছা পুষে রেখেছিলাম।

মাসখানেক ধরেই টুকটাক বড় ছোট মিলিয়ে একটা টিম হয়ে গেলো (এর মধ্যে একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের সদস্যরাও ছিল।

ঢাকা থেকে বান্দরবানের আলীকদমগামী সরাসরি বাসের টিকেট করে রাত সাড়ে ১১টার বাসে রওনা দিয়ে পৌঁছলাম সকাল প্রায় ৮টায়। আলীকদম বাজারে বাস থেকে নেমেই নাস্তা সেরে নিয়ে জিপ নিয়ে রওনা দিলাম আদু পাড়ার (মুরং পাড়া) উদ্দেশ্যে।

পামিয়া পাড়া

আদুপাড়া থেকেই দামতুয়ার পথে শুরু হয়ে যাবে জীবনের রোমাঞ্চের আরেক অধ্যায়।

এই আদুপাড়া জায়গাটা ১৭ কিলো নামেও যথেষ্ট পরিচিত। আর এখান থেকেই দামতুয়া ঝরনার দূরত্ব সাকূল্যে ৮ থেকে ১০ কিলো হবে। তবে পাহাড়ি উঁচু-নিচু আর ছোট ছোট ঝিরি পথ ধরে এগুতে এই পথ যেমন রোমাঞ্চকর তেমনই কষ্টসাধ্য। তাই কিলোমিটারের হিসেবে এটুক পথের যাত্রা মোটেই হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই।

উল্লেখ্য যে আলীকদম বাজার পৌঁছার আগে এবং আদু পাড়া পর্যন্ত মোট তিনবার সেনাবাহিনী চেকপোস্টে প্রত্যেকের ন্যাশনাল আইডি কার্ড কিংবা জন্মনিবন্ধন সনদের ফটোকপি জমাসহ বিস্তারিত তথ্য দিয়ে অনুমোদন নিয়ে নিতে হবে।

আদুপাড়া।

আদুপাড়া নেমে একজন গাইড নিতে হবে অবশ্য। এটা নিয়ে চিন্তার তেমন কিছুই নেই, গাইড সমিতির টংঘরের সামনেই জিপ কিংবা ভাড়া করা মোটরসাইকেল আপনাকে নামিয়ে দেবে। মোটামুটি একটা নির্ধারিত মূল্যেই আপনি গাইড ঠিক করে নিতে পারবেন, ১ হাজার টাকার মধ্যে।

তারপর একটু চা-নাস্তা করে কিছু শুকনা খাবার আর সবার সঙ্গে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি নিয়ে রওনা দিন। আর নিজেকে আবিষ্কার করুন অপরিচিত রূপে।

আদুপাড়ায় তেমন কিছু না পাওয়ার সম্ভাবনা থাকায় আলীকদম বাজার কিংবা তারপরের পান বাজার থেকেই কেনাকাটা সেরে নেওয়া ভালো হবে।

ঝর্ণার উপরিভাগ

তো অবশেষে স্থানীয় গাইড ইংরিং’কে নিয়েই শুরু হল হাঁটাপথ। আমাদের অবশ্য একটু দেরি হয়ে যায় তার খেসারত এবং ভালো ফলও পেয়েছি সেটা একটু পরেই বলছি।

পার্বত্যাঞ্চলের অন্য আট-দশটা পথের মতোই অতিরিক্ত মায়াময় এই পথ। কোথাও একেবারে খাড়া, আবার এই উঁচুটুক উঠেই পরের কদমেই নেমে যাচ্ছে ৮০ ডিগ্রি ঢালু পাহাড়ের শরীর। এইভাবেই যাচ্ছি। আর গাইড কে কিছুক্ষণ পর পর জিজ্ঞেস করছি আর কতক্ষণ?

ইংরিং জানালো ঘণ্টা খানেক লাগবে। আমরাও বাংলা সিনেমার সুখের সংসারের মতো করে আমাদের ভ্রমণসংসার এগিয়ে নিতে থাকলাম। তবে সিনেমার মতোই বেশিক্ষণ রইল না আমাদের সুখ।

দামতুয়া ঝরনা।

একদিকে ক্লান্ত শরীর আরেকদিকে বিশাল বিশাল খাড়া পাহাড় মাড়িয়ে পাথুরে খাঁদের কিনারা বেয়ে যাচ্ছি। আমাদের এক ঘণ্টা আর শেষ হয় না। অনেক পরে বুঝলাম আমাদের ঘণ্টা আর গাইডের ঘণ্টায় বিস্তর ফারাক ছিল। তবুও একটা স্বর্গীয় মায়ায় বাঁধা পড়েছে সমস্ত কিছু। চোখ ভেঙে যায় সবুজ শান্তিতে।

দূরের বিশালদেহি পাহাড়গুলো যেন হাতছানি দেয় আরেকটু এগিয়ে যাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা যোগায় চক্রবৃদ্ধির সূত্রে। পথের মাঝেই পাহাড় বেয়ে নেমে যাওয়া ঝিরির সঙ্গে দেখা হয় একটু পর পর! কি মমতা, কি শীতল আপ্যায়নে বিছায়েছে চাদর...।

ক্লান্ত শরীর ভিজিয়ে আবার শুরু হয় পথ। অনেক দূরে জুম ঘর আর কয়েকটি মাচাং যেন মেঘের সঙ্গে গল্পে মেতেছে। অদ্ভুত সুন্দর এই প্রকৃতি কতটা নিবিড় যত্নে গড়া স্রষ্টার এই নকশীকাঁথার মাঠ। আরও কিছুটা পথ পেরুতেই হঠাৎ কানে আসল শো শো শব্দ। সেই কলিজা জুড়ানো সেই বহুল আকাঙ্ক্ষিত সুর। মনের আনন্দটুকু বেঁধে রাখা গেলো না।

গাইড কে জিজ্ঞেস করলাম এসে পড়েছি কিনা? গাইড বললো, “এইতো আর কিছুক্ষণ..। আর এখন আছি কাখৈপাড়াতে।”

এ পাড়া থেকেই পাহাড়ি মিষ্টি পেঁপে খেয়ে দারুণ এক শক্তি নিয়ে আবার শুরু করলাম। অনেক খাড়া একটা পথ নেমে ঝিরিপথ ধরে এগিয়ে আরেকটা পাহাড় থেকে নামলেই সেই দামতুয়া।

তো দাঁতে লাগিয়ে দাঁত.. এটুকু পথেরও হল শেষ। পাথুরে প্রায় ৯০ ডিগ্রি ঢালু বেয়ে নেমে পড়লাম আর কয়েক মুহূর্তের জন্য এক কথায় জগতের বাইরেই চলে গেলাম।

দামতুয়া ঝরনা যাওয়ার পথে।

আমাদের দলের বাকি সদস্যরা একেবারে ছোট বাচ্চাদের মতো করেই আনন্দের প্রকাশ করতে থাকল। বিশাল প্রসারিত দেহ নিয়ে ওপর থেকে অক্লান্ত ভাবে অবিরত প্রতিটি মুহূর্ত ঝাঁপিয়েই পড়ছে কি তার রূপ! আহা!!

আসলে এই আনন্দ, এই যে কষ্ট-ক্লান্ত পথ আর পাহাড়ি মায়া এতসব কোনো লেখা, ছবি কিংবা হালের ভিডিও ভ্লগ দিয়েও বোঝানো সম্ভব নয়। নিজের চোখে দেখার বিকল্প বোধহয় স্রষ্টা আমাদের দেননি।

যা হোক আমরা খুব বেশি সময় ঝরনায় অবস্থান করতে পারিনি। কারণ প্রথমেই বলেছি আমাদের রওনা দিতেই অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। তাই এখন ফিরে যেতে নিশ্চিত ভাবেই সন্ধ্যা নেমে আসবে। আর সেটা যাতে বেশি রাত না হয়ে যায় সেজন্যই তাড়াতাড়ি ফেরার তাগিত দিল গাইড।

পার্বত্যাঞ্চলের অন্যান্য রুটগুলোর মতো এখানটায় স্থানীয় পাড়ায় থাকার আনুষ্ঠানিক কোনো অনুমতি না থাকায় কেউই অবশ্যই এই জঙ্গলের পাড়ায় থাকার পরিকল্পনা রাখে না।

তবে ওই যে লেখার শুরুতেই বললাম দেরিতে রওনা দেওয়াও ভালো ছিল।

আমাদের ফিরতে রাত হয়ে যাওয়ায় গাইডকে বলে স্থানীয় একটি পাড়ায় (পামিয়া পাড়া) থাকার ব্যবস্থা করা হল। আর আমাদের পরিকল্পনায় রাতে থাকার কোনো ব্যবস্থা ছিল না তাই সারাদিন এক প্রকার না খাওয়া থেকেই রাতের খাওয়া নিশ্চিত করতে পাড়া থেকেই জুম চাষের চাল, ডাল, মরিচ আর মিষ্টি কুমড়া সংগ্রহ করে নিজেরাই রান্না করলাম।

যে ঘরে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে তাদের থেকেই রান্নার টুকিটাকি জিনিসপত্র পেলাম।

এছাড়া এ পাড়াতে পাহাড়ি মিষ্টি জাম্বুরা দিয়ে আমাদের উষ্ণ অভ্যর্থণাটুকু আমৃত্যু বাঁধিয়ে রাখার মতো এক ভালোবাসা।

ঝিরি পথ।

রাতের খাওয়া শেষে ঘরের সামনের মাচাংয়ে এসে গল্প জুড়ে বসলাম সবাই। সঙ্গে ছিল পাহাড়, তারা আর ঝিরির সুর। এক জীবনে এমন সময়গুলোর জন্যই বেঁচে থাকি প্রতিটাদিন। আরও কয়েকটাদিন থাকার প্রবল ইচ্ছেটুকু সঙ্গে করেই ফিরতে হল পরদিন ভোরে। একদিন আগের পরিচিত সেই পরিচিত পথে।

অনেকেই ভরা বর্ষায় ঝরনা-পাহাড়ের পূর্ণ রূপ দেখার জন্য গিয়ে থাকেন। তবে বৃষ্টির জন্য ঝরনা আর ঝিরির পানি থাকে ঘোলাটে। এক্ষেত্রে আমার মতামত, অক্টোবরের শেষে আর নভেম্বরের মাঝামাঝি অব্দি যাওয়া ভালো। কেননা এই সময়ে পানি থাকে একেবারেই স্বচ্ছ আর তুলনামূলক কম বৃষ্টি হয়।

খেয়াল রাখা জরুরি

যতটা সম্ভব ব্যাগ ছোট রাখা আর মশার জন্য ওডোমস সঙ্গে নেওয়া। অবশ্যই হাঁটাচলার সময় নিজের চারপাশে খেয়াল রেখে চলা। এসব পথে জোঁকের ব্যাপারটা আসলে খুব স্বাভাবিকভাবে নিতে হবে। আর পরিবেশ প্রকৃতির ক্ষতি কোনোভাবেই করা যাবেনা। যতটা সম্ভব প্লাস্টিক প্যাকেটজাত কোনো কিছু পাহাড়ে না নেওয়া কিংবা প্রয়োজন শেষে প্লাস্টিক বর্জ্য সঙ্গে করে নিয়ে এসে নির্ধারিত স্থানে ফেলা।

পাহাড়ি খাঁদের ওপর গাছের গুঁড়ি দিয়ে রাস্তা

যাতায়াত

ঢাকা থেকেই এখন সরাসরি আলীকদম পর্যন্ত বাস আছে। ভাড়া ৮৫০ টাকা। আলীকদম বাজার কিংবা সামনের পান বাজার থেকে মোটরসাইকেল অথবা জিপ গাড়ি ভাড়া করে চলে যেতে হবে ১৭ কিলো বা আদুপাড়া পর্যন্ত। ভাড়া মোটর সাইকেল ৮শ’ টাকা যাওয়া-আসা দুই জনের জন্য। আর জিপ গাড়ি নিবে ৩ হাজার বা ৩ হাজার ২শ’ টাকার মতো।

দামতুয়া ঝরনা যাওয়ার পথে।

খরচ

যাতায়াত খরচ আর গাইড খরচ তো উল্লেখ আছেই। তাছাড়া পাড়াতে আমাদের জনপ্রতি থাকার জন্য ১শ’ টাকা দিয়েছি। আর টুকিটাকি বাজার খরচ। যেহেতু আমরা রাতে পাড়ায় ছিলাম। না থাকলে এই খরচটা দরকার হবে না।। এমনিতে আলীকদম বাজার কিংবা পান বাজারে সকালের নাস্তা আর দুপুরের খাওয়া জনপ্রতি ৬০ থেকে ১২০ টাকায় ভালোভাবেই হয়ে যাবে। এক-দুই টাকাতে পাহাড়ি কলা খেতে ভুল করবেন না।

প্রয়োজনীয় ফোন: নম্বর আবুল কালাম ০১৮৬৫৯২৫৯৫০ (জিপ)। ইংরিং- ০১৮৮৮০৮৫৬৯৩ (গাইড)।