পথ কুকুরের দায়িত্ব নিতে যা জানতে হবে

নিজ উদ্যোগে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে চাইলে জেনে নিন কিছু বিষয়।

মামুনুর রশিদ শিশিরবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Oct 2020, 08:03 AM
Updated : 4 Oct 2020, 08:36 AM

রাজধানীর রাস্তা থেকে বেওয়ারিশ কুকুর সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্তের পক্ষে বিপক্ষে বহু মানুষ রয়েছেন। তবে এই অবলা প্রাণীদের যারা দীর্ঘদিন ধরে মনের কোনো জায়গা দিয়েছেন সেই মানুষগুলো স্থানান্তরের নামে দেখেন ভিন্ন ও ভয়াবহ এক চিত্র।

দেশে নেতৃস্থানীয় ১৫ জন সংস্কৃতিকর্মীরা যৌথ এক বিবৃতিতে জানান, “আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অবিবেচনা প্রসূত সিদ্ধান্তে নিষ্ঠুরভাবে কুকুর অপসারিত হচ্ছে। অপসারণকালে মাত্রাতিরক্ত সিডেটিভ শরীরে প্রবেশ করিয়ে অর্ধমৃত কুকুরগুলোকে মাতুয়াইল বর্জ্য নিক্ষেপ স্থলে ফেলে দিয়ে আসছে। এতে বিপুল সংখ্যক কুকুরের মৃত্যু হচ্ছে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার কুকুরসহ অন্যান্য প্রাণীদের খাবার ও চিকিৎসা সেবাসহ সার্বিক দেখাশুনা করে ‘অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার ক্লাব অব ঢাকা ইউনিভার্সিটি’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা।

সংস্থাটির সহ-প্রতিষ্ঠাতা সাবরিনা সাব্বির মঙ্গলবার বিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা গত পাঁচ বছর ধরে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে প্রাণীদের নিয়ে কাজ করছি। এই লকডাউনে গত ছয় মাস পুরো ইউনিভার্সিটিতে আমরা প্রাণীদের খাবার দিয়েছি। রীতিমতো পাঁচ দিন কুকুরগুলোকে খাবার দিই। গতকাল আমাদের ফিডিং ছিল না। আজকে আমরা এসে দেখি, টিএসসিতে কোনো কুকুর নাই। লোকজনের কাছে জানতে পারি, গতকাল (সোমবার) সিটি করপোরেশনের লোকজন গাড়ি নিয়ে এসে ভ্যাকসিন দেওয়ার কথা বলে আমাদের কুকুরগুলো তুলে নিয়ে গেছে।”

অবলা পশুদের এমন নির্মম হত্যাকাণ্ডে সাধারণ মানুষ স্বভাবতই অসন্তুষ্ট।

মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা ফওজিয়া নূর, কুকুর ভালোবাসেন তিনি। নিজ এলাকায় ও ধানমণ্ডিতে কিছু কুকুরকে ছোট থেকেই খাওয়ান। কুকুর নিধন অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে পর থেকে বেশ শঙ্কিত তিনি।

কুকুরগুলোকে যেন মারা না হয় তাই নিজ দায়িত্ব নিয়ে এলাকার কুকুরগুলোকে গলায় বেল্ট পরিয়েছেন এবং নিয়মিত এদের খাওয়ানোর দায়িত্ব নিয়েছেন।

পরিবারে সমস্যা থাকার কারণে বাসায় কুকুর রাখা সম্ভব না হওয়ায় বাসার নিচে ও ধানমণ্ডির রাস্তায় তিনি কুকুরদের খাবার দিয়ে থাকেন।

কুকুর অপসারণের বিষয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি বলেন, “কুকুরগুলোকে মেরে ফেলা বা স্থানান্তরিত করা কোনো সমাধান না। প্রাপ্তবয়স্ক কুকুর যেগুলো আছে তাদের বন্ধ্যাকরণ করে ও প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন দিয়ে এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। এতে ভবিষ্যতে দ্রুত কুকুরের সংখ্যা বাড়বে না আবার কুকুর শহর থেকে বিলুপ্তও হয়ে যাবে না।”

পুরান ঢাকার অধিবাসী কাউসার আহমেদ বলেন, “কুকুর পরিবেশেরই একটা অংশ। শহর থেকে হুট করে কুকুর নাই হয়ে গেলে শহরে ছুঁচো ও ইদুঁরের সংখ্যা বেড়ে যাবে। তাই এমন অবিবেচকের মতো কাজ করা মোটেও ঠিক হবে না।”

“রাস্তায় হাঁটার সময় মাঝে মধ্যেই কিছু কুকুর পেছন পেছন হাঁটা শুরু করে এবং তাদের আচরণ অনেকটাই আদরণীয়। এরা মূলত খাবারের জন্যই পেছন পেছন হাঁটে। আমি নিজেও এমন ক্ষেত্রে তাদেরকে রুটি, বিস্কুট ইত্যাদি খাওয়াই। রাস্তায় আমি এখন পর্যন্ত তেমন আক্রমণাত্মক কুকুর দেখিনি। কেউ আঘাত না করলে কুকুরগুলো সাধারণত কোনো ঝামেলা করে না।”

“আমার মতে কুকুরগুলোকে সরিয়ে না দিয়ে তাদের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া অধবা ভ্যাক্সিনের ব্যবস্থা করাই বেশি কার্যকর হবে।”

কুকুর ও অন্যান্য প্রাণী পরিচর্যায় করণীয়

দোকান থেকে রুটি বিস্কুট কিনে খাওয়ালে বেওয়ারিশ কুকুরকে সাময়িক স্নেহ হয়ত দেখানো যায়। তবে তাদের দায়িত্ব নেওয়া হয় না।

নিয়মিত খাবার দেওয়ার পাশাপাশি তাদের পরিচর্যার আরেকটি অংশ হল চিকিৎসা।

কেবল বানর নয়, পুরান ঢাকা থেকে উত্তরা পর্যন্ত এলাকায় প্রতিদিন তিন থেকে চারশ কুকুরের জন্যও তারা খাবারের ব্যবস্থা করছেন।

তবে সমস্যা হলো বেওয়ারিশ এই প্রাণীদের প্রতি সহমর্মীতার কমতি না থাকলেও অনেকেই হয়ত জানেন না কোথায় এদের চিকিৎসা হয়।

রাজধানীর কেন্দ্রীয় পশু হাসপাতালের ঠিকানা- ৪৮, কাজী আলাউদ্দিন রোড। ফুলবাড়িয়া ফায়ার সার্ভিসের পশ্চিমে এবং বঙ্গবাজারের বিপরীত পাশে একটু পশ্চিমে)।

এখানে আছে আউটডোর, ক্লিনিকাল প্যাথলজি, রেডিওলজি ও অ্যানেসথেসিয়া বিভাগ।

সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত চিকিৎসক থাকেন বহিঃবিভাগে।

এছাড়াও লেপারোটমি, হিস্টারেকটমি, সিজারিয়ান অপারেশন, ডকিং, লাইগেশন, ভেসেকটমি, এমপুটেশন, কসমেটিক সার্জারি, পিনিং, প্লেটিং ইত্যাদি সুবিধাসম্পন্ন তিনটি অপরাশন থিয়েটার আছে হাসপাতালে।

এই হাসপাতালে কোনো সার্বক্ষণিক বিভাগ নেই। এমনকি আহত পশুকে ভর্তি করানোর সুযোগও নেই। যিনি পশুকে নিয়ে আসবেন তার দায়িত্বেই পশু নিয়ে যেতে হবে।

কুকুরদের তারা দিচ্ছেন রান্না করা খাবার আর বানরুটি।

ওষুধ বিনামুল্যে দেওয়া হয় ঠিক, তবে তা নির্ভর করে হাসপাতালে সেই ওষুধ মজুদ আছে কি-না তার ওপর।

হাসপাতালের বাইরে বেশ কয়েকটি ওষুধের দোকান আছে, যেখানে সবধরনের ওষুধই পাওয়া যায়।

সাপ্তাহিক বন্ধ শুক্রবার, আর শনিবার অর্ধদিবস খোলা থাকে।

ফোন: ০২-৭৩১৯৯৭১ মোবাইল: ০১৭১৫০১৬২১৮

পশু পালন ও পরিচর্যা বিষয়ে যেকোনো আলোচনা ও পরামর্শের জন্য ফেইসবুকে অসংখ্য গ্রুপ আছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল

পেট অ্যানিমেল ভেটেরিনারি কনসালটেন্ট- www.facebook.com/groups/491020284407728/

অ্যানিমেল কেয়ার সোসাইটি অব বাংলাদেশ- www.facebook.com/groups/1473353682969120/

পিপল ফর অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার- www.facebook.com/groups/fundrainginjured/

কেয়ার ফর পজ- www.facebook.com/groups/careforpaws/

অ্যানিমেল লাভার অব বাংলাদেশ- www.facebook.com/groups/alobrd/

অ্যানিমেল বক্স- www.facebook.com/animalbox.org/?fref=ts

এছাড়াও www.pet.com.bd/vet-finder/ এই ওয়েবসাইটে পশু চিকিৎসদের ঠিকানা ও ফোন নম্বর জানা যাবে।

ফেইসবুকে একাধিক পশু চিকিৎসকের পেইজ আছে। যার মাধ্যমে সরাসরি তাদের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা পেতে পারেন। তারা পেইজগুলোতে পশুপালনের বিভিন্ন করণীয়-বর্জণীয় বিষয় জানান লিখিত পোস্ট কিংবা ভিডিওয়ের মাধ্যমে।

সেখান থেকেও অনেক কিছু শিখতে পারবেন। এদের মধ্যে অনেকেই বাসায় গিয়ে চিকিৎসা দেন।

পোষা প্রাণীর চিকিৎসা সম্পর্কে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়, ডা. সগির’স পেট ক্লিনিক অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার’য়ের প্রধান ডা. সগির’য়ের সঙ্গে।

তিনি বলেন, “প্রতিটি জীবনই মূল্যবান এবং পরিবেশে তার অবদান আছে। একই সঙ্গে জন্মনিয়ন্ত্রণও জরুরি একটি বিষয়। অন্যথায় পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকবে না।”

“কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য বন্ধ্যাত্বকরণই মানবিক উপায়, যা পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতেও চালু আছে।”

তার চিকিৎসালয়ের সুযোগ সুবিধা সম্পর্কে জানান, “ব্যক্তিগত চিকিৎসালয় হওয়ায় মানুষের পোষা প্রাণীর চিকিৎসাই আমরা বেশি করে থাকি। বেওয়ারিশ কুকুরগুলোর চিকিৎসা ও পরিচর্যা নিয়ে মুলত অলাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলোই বেশি কাজ করে থাকেন। তবে কেউ যদি আহত কোনো পশুকে নিয়ে আমাদের শরনাপন্ন হন, আমরা সর্বাত্বক চেষ্টা করি বিনা খরচেই তার চিকিৎসা করার।”

রাজধানীর লালমাটিয়ার এই চিকিৎসালয়ের সাধারণ ভিজিট নতুন রোগীর জন্য এক হাজার টাকা, আর পুরানো রোগীর জন্য ৮শ’ টাকা।

‘ইয়ারলি ভ্যাকসিনেশন’য়ের জন্য এখানে গুনতে হবে দেড় হাজার টাকা।

তবে পণ্যের সরবরাহের অভাব থাকলে খরচ বেড়ে আড়াই হাজার বা তারও বেশি হওয়ার নজির আছে। আর বর্তমান মহামারীর কারণে এমন পরিস্থিতিই চলছে বলে জানান ডা. সগির।

কী ধরনের রোগী বেশি আসে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “দুর্ঘটনা কবলিত পশুই আমাদের এখানে বেশি আসে। ড্রেসিং করার খরচ পাঁচশ টাকা, আর সেলাই করতে হলে ক্ষতের ধরন, স্থান, পরিমাণ ভেদে খরচ এক হাজার থেকে পাঁচ হাজার পর্যন্ত গড়াতে পারে।”

“নিজ উদ্যোগে দেশের বাইরের থেকে ওষুধ নিয়ে আসার যথাসাধ্য চেষ্টা করি। দেশীয় ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কুকুর, বেড়াল এবং এই ধরনের পোষা প্রাণীর ওষুধ তৈরিতে আগ্রহ আশানুরুপ নয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ডোজ হিসেব করে মানুষের ওষুধ দিয়েই কুকুর, বেড়ালের চিকিৎসা করা সম্ভব।

আবার এখানে প্রচণ্ড সাবধানতা প্রয়োজন। কারণ মানুষের সব ওষুধ পোষ্যের জন্য প্রযোজ্য নয়।

উৎকৃষ্ট উদাহরণ হল ‘প্যারাসিটামল’। মানুষের জন্য অতিসাধারণ এই ওষুধটি বিড়ালের জন্য হতে পারে প্রাণঘাতি।

তাই ডা. সগির বলেন, “চিচিকৎসকের পরামর্শ ছাড়া নিজেই ডাক্তারি করলে ঝরে যেতে আপনার প্রিয় পোষ্যের জীবন।”

আরও পড়ুন