অনেক গবেষণা করে সিদ্ধান্ত হলো, নিকলি যাব। সেখানে সারাদিন কাটিয়ে রাতে কিশোরগঞ্জ থাকব। পরদিন কিশোরগঞ্জের আশপাশে বেড়িয়ে ঢাকায় ফিরব। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, শুরু হলো ভ্রমণের আয়োজন।
কিশোরগঞ্জে থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য ধরলাম সুবাসকে। সুবাস মাস কয়েক প্রমোশন পেয়ে ঢাকায় এসেছে। এর আগে সে ছিল ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক।
সুবাস পরদিন জানাল, কিশোরগঞ্জে জেলা পরিষদের ডাকবাংলোতে তিনটি এসি রুম পাওয়া যাবে। আমি তাকে অনুরোধ করলাম ওই রুম তিনটি আমাদের নামে ফাইনাল বুকিং দিয়ে দিতে।
আমার অতিউৎসাহী সহকর্মী নীনা, বৃষ্টি, নিম্মি, আফরীন, আমি আর ববি মিলে আমরা মোট ছয় জনের টিম। নিকলি ভ্রমণের জন্য তৈরি হলাম। একটি মাইক্রোবাসও ভাড়া করা হলো।
নিকলিতে কোন পথে যাব, কোথায় কোথায় ঘুরব, সেটা জানার জন্য কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামের কৃতিসন্তান, ইতিহাসবিদ ও গবেষক বন্ধু তরুণ সরকারকে ফোন দিলাম। তরুণ কিছু পরামর্শ দিল। তবে সে আরও বিস্তারিত তথ্য জানতে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের আরেক বন্ধু, জগন্নাথ হলের রুমমেট, রাজনৈতিক সহকর্মী ভবেশদাকে ফোন দিতে বলল।
সব ব্যবস্থা পাকা করে আমরা শুক্রবার সকাল ৭টায় রওনা হলাম নিকলি অভিমুখে।
সেদিন আকাশ ছিল মেঘে ঢাকা। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিও পড়ছিল। ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে ভ্রমণসঙ্গীদের তুলতে গিয়ে প্রায় আটটা বেজে গেল। এরপর তিনশ ফিট হয়ে নরসিংদী, শিবপুর হয়ে আমরা চলতে শুরু করলাম। নরসিংদীর একটি হোটেলে চা-নাস্তা করলাম। চা-নাস্তার পর আবার যাত্রা শুরু হল। জানালার কাচ দিয়ে বাইরে সবুজ ধানক্ষেত, কাশফুল, আর মেঘের আনাগোনা দেখতে দেখতে গল্প-আডায় মশগুল হয়ে আমরা পথ চলছিলাম।
এর কিছুক্ষণ পর শুরু হলো প্রচণ্ড বৃষ্টি। আমাদের গাড়িচালক অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। এদিকে নিকলি থেকে ফারুক বার বার ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করছিল আমরা কতদূর এলাম। ভবেশদাও ফোন করে জানাল সে নিকলিতে আমাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন।
দুপুর সোয়া বারোটায় আমরা নিকলি পৌঁছি। সেখানে প্রথমেই আমরা চমৎকার ফল-ফুলের বাগানঘেরা আবহাওয়া অফিসে যাই। স্থানীয় আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তা ফারুক আমাদের অভ্যর্থনা জানায়। সেখানে ফ্রেশ হয়ে আমরা গাছপাকা পেপে, চানাচুর-বিস্কুট দিয়ে জলযোগ করি। এর মধ্যেই ভবেশদা এসে উপস্থিত হয়।
ভবেশদা কিশোরগঞ্জ থেকে নিকলি এসেই নৌকা ভাড়া করতে গিয়েছিল। শুক্রবার পর্যটকদের চাপ বেশি থাকে। নৌকার চাহিদাও বেশি হয়। আমাদের যেন নৌকা নিয়ে কোনো ঝামেলায় পড়তে না হয়, তাই তার এ তৎপরতা।
আমরা ফারুকের ডেরা থেকে দ্রুত বিদায় নিয়ে ভবেশদাসহ মাইক্রোতে করে তুলনামূলক একটা নির্জন ঘাটে চলে যাই। সেখানে একটা সুন্দর নৌকা দেখেই আমাদের মন আনন্দে নেচে উঠে। বেশ বড় একটা নৌকা। শক্ত টিনের ছাদ। তার ওপর সামিয়ানা টাঙানো। নৌকার ছাদে বসার জন্য প্লাস্টিকের চেয়ারও আছে। আছে দুই ধারে লোহার বেঞ্চ।
নৌকায় আমরা সাত জোড়া কৌতূহলি চোখ উঠে বসি। করোনায়ভীতি, মাস্ক, ইট, কাঠ, কংক্রিট, ময়লার স্তূপ আর যানজট দেখতে দেখতে ক্লান্ত চোখগুলো ঢাকার জঞ্জাল থেকে সে মুহূর্তে ১৪০ কিলোমিটার দূরে।
পথের পাশে সবুজ ধানক্ষেত, কাশবন, সারি সারি কলাগাছ, হাঁসমুরগির খামার, হাওর শাসন করা বেড়িবাঁধে নক্ষত্রের মতো হাঁস দেখে দেখে এরই মধ্যে আমরা সবাই নির্বাক কবি হয়ে গেছি!
এরপর শুরু হল দেশের সবচেয়ে বড় হাওরাঞ্চল কিশোরগঞ্জের নিকলি, মিঠামাইন ও অষ্টগ্রামের হাওরে নৌবিহার। আকাশে মেঘ থাকায় কিছুক্ষণ পরই সামিয়ানা খুলে ফেলা হয়। ওপরে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। নিচে কেবল পানি আর পানি। নৌকার ছাদের পাটাতনে বসে সেই পানিতে ভাসতে ভাসতে, দুলতে দুলতে আমরা চলেছি যেন অনন্তের অভিমুখে! এ এক অনির্বচনীয় অনুভূতি। দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশির বুকে নৌকায় ঘুরে বেড়ানোর চেয়ে আনন্দের কিছু নেই, হতে পারে না।
আমরা একে একে পার হয়ে যাই গুরই, জারইতলা, কারপাশা, দামপাড়া, সিংপুরসহ নানা এলাকা। ভাবেশদা আমাদের দূরের গ্রামগুলোর নাম বলতে থাকেন।
আমাদের ভ্রমণসঙ্গীদের কেউ কেউ নৌকার ছাদে চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশ দেখা শুরু করল। আর ফটোগ্রাফি তো চলছিলই। যত ঢংয়ে যত স্টাইলে ছবি তোলা যায়, তার প্রতিযোগিতা চলছিল যেন। নৌকার মাঝিসহ অন্যরা উপভোগ করছিল কয়েকজন শহুরে মানুষের স্থূল রং-ঢং!
এর মধ্যে কিশোরগঞ্জ জেলা পরিষদের প্রধান কর্মকর্তা মাহবুব ফোন দিয়ে আমাদের খোঁজখবর নিলেন। জেলা পরিষদ ডাকবাংলোর কেয়ারটেকার এজাজুল কিছুক্ষণ পর পর ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করতে থাকল, আমরা কখন আসব। বুঝলাম, ‘সুবাস স্যারের গেস্ট’ বলেই আমাদের এত খাতির!
ওদিকে তরুণ ফোন দিয়ে আমাদের খোঁজখবর নিল। সুবাসও মাঝে ফোন দিয়ে আমরা পৌঁছতে পেরেছি কিনা, খোঁজ নিল।
আমরা এক চমৎকার আবহাওয়া পেয়েছি। আশ্বিনের ভরদুপুরে রোদের চোখ রাঙানিটা যেমন হওয়ার কথা ছিল, ঠিক তেমনটি নয়। জ্বলন্ত সূর্যটাকে কালো পর্দায় ঢেকে দিয়েছে মেঘবালিকারা। বাতাস আমাদের চুল আর জামাকাপড়কে উড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল। সঙ্গে ছিল বিশাল জলরাশিতে ঢেউয়ের নাচন!
নিকলি হাওরের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদী। স্থানীয়রা নদীটির নাম ঘোড়াউত্রা। এটা ধনু নদীর শাখা। কী কারণে নদীটির নাম ‘ঘোড়াউত্রা’ হল, তার প্রকৃত ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না। কোনো ঘোড়া এই নদী পার হওয়ার সময় কোনো মতে উৎরে গিয়েছিল বলেই কী নদীটির নাম ‘ঘোড়াউত্রা’ রাখা হয়েছে?
বিভিন্ন নৌকায় জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য চোখে পড়ল। চারদিকে জলবেষ্টিত হয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে যুদ্ধ করে যে মানুষগুলো বেঁচে থাকে সেই সব সংগ্রামী মানুষের জন্য মনের গভীর থেকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিবেদন করলাম।
প্রায় দুই ঘণ্টা চলার পর আমরা মিঠামইনে পৌঁছাই।
কিশোরগঞ্জ জেলার হাওরবেষ্টিত তিন উপজেলা মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও ইটনার সংযোগ ঘটিয়েছে ৪৭ কিলোমিটারের এই অল ওয়েদার রোড। দুপাশে অথৈ জলের মাঝে দিগন্তজোড়া সড়কটি দেখতে এককথায় অপরূপ। মনে হয় কোনো ভিন্ন দেশে এসে উপস্থিত হয়েছি। এই সড়কের মাঝামাঝি পৌঁছে আমরা সিএনজি থেকে নেমে পড়ি। সড়কে হাঁটতে হাঁটতে উপভোগ করি মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য।
দুই পাশে সাগরের জলের মতো ঢেউ। মাতাল হাওয়ার ঝাঁপটা। যত দূর চোখ যায় জলরাশির অবারিত ঢল। এমন বিস্তীর্ণ হাওরের বুক চিড়ে গড়ে তোলা পিচঢালা সড়কপথটিকে মনে হয় যেন কোনো শিল্পীর তুলিতে আঁকা নিপুণ চিত্রকর্ম।
একরাশ মুগ্ধতাকে সঙ্গী করে এরপর আমরা আবার সিএনজিতে করে মিঠামইন খেয়াঘাটে ফিরে আসি।
সময়ের অভাবে আমরা রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের বাড়ি যেতে পারলাম না। তাঁর বাড়ি মিঠামইনের কামালপুর গ্রামে। এই নিয়ে আমাদের নৌকার মাঝির আফসোসের শেষ নেই! তিনি রাষ্ট্রপতিকে খুবই ভালোবাসেন। হাওরের মানুষের কাছে আমাদের রাষ্ট্রপতি খুবই জনপ্রিয়।
আমাদের নৌকা আবার চলতে শুরু করে। হঠাৎ আকাশ অন্ধকার করে আসে। মনে হয় যেন আকাশ আমাদের ওপর ভেঙে পড়বে। কিন্তু না। আকাশটা গোমরামুখোই থেকে যায়। এই পরিবেশে আমরা প্রত্যেকে আনমনে হাওরের রূপ দেখতে থাকি।
নৌকা থেকে নেমে পা বাড়াই নিকলির আরেকটি বিখ্যাত ঐতিহাসিক স্থান চন্দ্রনাথ আখড়ার দিকে।
কিশোরগঞ্জ জেলার সবচেয়ে প্রাচীন এ স্থাপত্যটি সনাতন ধর্মের নাথযোগীদের প্রধান তীর্থ ছিল মধ্যযুগে। তৎকালে সাধক চন্দ্রনাথ গোস্বামী নাথ সম্প্রদায়ের প্রধান ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি নিকলির গোবিন্দপুরে সোয়াইজনি নদীর তীরে সপ্তদশ শতাব্দীর শেষদিকে এ আখড়াটি নির্মাণ করেন।
একসময় এ আখড়া-ই ছিল এদেশের যোগী সম্প্রদায়ের বিখ্যাত কেন্দ্র। এখানে নাথযোগীদের দুস্প্রাপ্য ধর্মীয় হাড়মালার হস্ত লিখিত পান্ডুলিপি পাওয়া গিয়েছিল। যা বর্তমানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে। শৈব, বৌদ্ধ, তান্ত্রিক, সহজিয়া ও যোগী এ কয়টি ধর্মমতের সমন্বয়ে উদ্ভূত ধর্মই নাথধর্ম। এ ধর্মের মূল হল মানবদেহ। দেহেই বিশ্বব্রহ্মান্ডের ন্যায় নিয়ত সৃষ্টিকর্ম চলছে অর্থাৎ মানব দেহই বিশ্বব্রহ্মান্ডের ক্ষুদ্ররূপ বা অংশ।
যোগসাধনপন্থী উক্ত সম্প্রদায়েরর গুরু ছিলেন মীননাথ। গুরুদের নামের শেষে ‘নাথ’ থাকায় ‘নাথযোগী’ সম্প্রদায় নামে পরিচিত। এই সম্প্রদায়ের মানুষেরা বিশেষ ধরনের পরিচ্ছদ, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা ও কানে কুন্ডল পড়ে লোকালয়ে ঘুরে বেড়াতো এবং গোরক্ষনাথ, গোপীচন্দ্রের সন্ন্যাস, নাথগীতিকা, দোহা ইত্যাদি নাথ ধর্মের মাহাত্মামূলক গান পরিবেশন করে ভিক্ষালব্ধ অন্নে জীবিকা নির্বাহ করতো।
আখড়াটি বিরাট। মন্দিরের সুউচ্চ চূড়া বহুদূর থেকে দেখা যায়। এর স্থাপত্য রূপ দেখলেই বোঝা যায় আখড়ার ঐতিহ্য ও প্রভাব। সুউচ্চ প্রাচীর ঘেরা, দু'টি প্রবেশ পথ, শান বাঁধানো ঘাট। কাঠের কারুকার্যে ফুটে উঠে তাদের ধর্মীয় স্মৃতিগুলো। এক সময় ভক্ত, পূজারী ও পুণ্যার্থীদের আনাগোনায় আখড়া বাড়িটি জমজমাট ছিল। গান বাজনায় জমে উঠতো প্রাঙ্গণ। এখন তা কেবলই স্মৃতি।
আমরা রাতের ম্লান আলোয় সেই কালের সাক্ষীকে এক নজর দেখে কিশোরগঞ্জে ফেরার আয়োজন করি। চন্দ্রনাথ আখড়া থেকে আমরা যাই ব্র্যাকের স্থানীয় কার্যালয়ে।
সেখানে ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবার খেতে গেলাম সেতু হোটেলে। চিংড়ি, বাইম, আইড়, হাঁসের মাংস দিয়ে ভাত খেয়ে মাইক্রোতে চেপে বসলাম। গন্তব্য কিশোরগঞ্জ। আবছা চাঁদের আলোয় হাওরের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে কিশোরগঞ্জে জেলা পরিষদ রেস্টহাউজে পৌঁছতে আমাদের রাত সাড়ে নয়টা বেজে যায়।
পরদিন সকালে গেস্ট হাউজে বসেই ডাল-ভাজি, পরোটা, ডিমভাজি চা দিয়ে নাস্তা করে সকাল ১০টায় আমরা বের হই। আজকের প্রথম গন্তব্য চন্দ্রাবতীর মন্দির।
চন্দ্রাবতী মন্দির বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তর কর্তৃক তালিকাভুক্ত একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা। প্রকৃতপক্ষে মন্দিরটি একটি শিব মন্দির। কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলাধীন মাইজখাপন ইউনিয়নের কাচারীপাড়া গ্রামে ফুলেশ্বরী নদীর তীরে শিবমন্দিরটির অবস্থান।
ষোড়শ শতকের মনসা মঙ্গলের বিখ্যাত কবি দ্বিজ বংশীদাসের কন্যা ও বঙ্গের আদি নারী হলেন চন্দ্রাবতী। চন্দ্রাবতী শিবমন্দিরটি বস্তত তাঁর বহু কাহিনি ও ঘটনাকে ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে।
ষোড়শ শতকের দ্বিতীয় ভাগে কবি চন্দ্রাবতীর জন্য নির্মিত হয় এই মন্দিরটি। কবি চন্দ্রাবতী ছিলেন অত্যন্ত প্রতিভাধর এক সাহিত্যিক। তিনি সীতার দুঃখ-দুর্দশাকে উপজীব্য করে রামায়ণ রচনা করেন।
এ ছাড়া বেশ কিছু পালাগানও লিখেছেন। নয়ন ঘোষ প্রণীত পালাগান ‘চন্দ্রাবতী’ থেকে জানা যায় যে, কৈশোরে চন্দ্রাবতী ও স্থানীয় এক ব্রাহ্মণযুবক জয়ানন্দের মধ্যে মনের আদান-প্রদান হয়। তাদের এ ভালোবাসর সম্পর্ক চন্দ্রাবতীর পিতা বংশীদাস মেনে নেন। কথা অনুযায়ী তাদের মধ্যে তিনি বিয়ের ব্যবস্থাও করেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে জয়ানন্দ কথা অনুযায়ী বিয়ে না করে অপর এক মুসলিম নারী কমলাকে বিয়ে করেন। এই বিয়ের জন্য জয়ানন্দ ধর্মান্তরিত হন। এই ঘটনায় চন্দ্রাবতী ভীষণভাবে ভেঙে পড়েন। তিনি পিতার কাছে এসময় তাঁর উপাসনার জন্য একটি মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য অনুরোধ করেন।
এছাড়া চন্দ্রাবতী সিদ্ধান্ত নেন তিনি চিরকুমারী থাকবেন। তাঁর পিতা কন্যার আবদার অনুযায়ী ফুলেশ্বরী নদী তীরে একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।
স্থানীয় লোককথা অনুযায়ী, একদিন সন্ধ্যায় মন্দিরের দ্বার বন্ধ করে চন্দ্রাবতী সন্ধ্যারতি এবং শিবের পূজায় মগ্ন। রুদ্ধদ্বারের বাইরে দাঁড়িয়ে অনুতপ্ত জয়ানন্দ বারবার চন্দ্রাবতীকে নাম ধরে ডেকেও কোনো সাড়া পাননি। এই নীরবতাকে চন্দ্রাবতীর প্রত্যাখ্যানের ভাষা মনে করে ব্যর্থমনোরথ জয়ানন্দ লাল রঙের সন্ধ্যামালতী ফুল দিয়ে মন্দিরের দরজায় চার ছত্রের একটি পদ লিখে সে স্থান ত্যাগ করেন।
পূজা শেষে মন্দিরের দরজা খুলে চন্দ্রাবতী লেখাটি দেখতে পান। মন্দির অপবিত্র হয়েছে ভেবে মন্দির গাত্রে উৎকীর্ণ সে লেখা মুছে ফেলার জন্য তিনি নদীর ঘাটে জল আনতে গিয়ে দেখেন নদীর জলে ভাসছে জয়ানন্দের মৃতদেহ।
আবেগ সংবরণ করতে না পেরে প্রমত্ত ফুলেশ্বরীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে জয়ানন্দের সঙ্গী হন চন্দ্রাবতীও।
সে অবধি এটি চন্দ্রাবতী মন্দির নামে দাঁড়িয়ে আছে ফুলেশ্বরী নদীতীরে।
যদিও এখন সেখানে ফুলেশ্বরী নদী বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। বন্ধ মন্দির দুটির অবয়ব ছাড়া আর কিছুই নেই।
চন্দ্রাবতী মন্দিরটি অষ্টভুজাকৃতির। মন্দিরের উচ্চতা প্রায় ৩২ ফুট। এর আয়ত বাহুর প্রতিটির দৈর্ঘ্য ৮ ফুট। মন্দিরের নিচতলায় আছে একটি কক্ষ ও তাতে প্রবেশের পথ। কক্ষের ভেতরে রয়েছে ৭টি কুলুঙ্গি। মন্দিরের দ্বিতীয় তলাতে আছে একটি প্রশস্ত কুলুঙ্গি এবং পোড়ামাটির সুদৃশ্য কাজ। দ্বিতীয় তলা থেকেই মন্দিরটি ক্রমশ সরু হয়ে ৩২ ফুট পর্যন্ত উচ্চতায় গিয়ে শেষ হয়েছে। ১৯৯০ এর দশকে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ মন্দিরটির কিছু অংশ সংস্কার করে।
চন্দ্রাবতীর মন্দিরের সামনে ছবি তুলে আমরা রওনা হই করিমগঞ্জের বালিখোলা খেয়াঘাটে। রোদ ও গরমের কারণে আমরা মাইক্রেবাসে বসেই হাওড়, খেয়াঘাট আর হাওড়ের বুক চিড়ে গড়ে তোলা সড়কের সৌন্দর্য উপভোগ করে ফিরে আসি শহরের তাজ হোটেলে।
সেখানে বিভিন্ন ধরনের ভর্তা, ভাজি, হাওরের টাটকা মাছ দিয়ে ভাত খেয়ে ফিরে আসি গেস্টহাউজে। গেস্টহাউজে সব গোছগাছ করতে করতে ৪টা বেজে যায়। আমরা কেয়ারটেকার এজাজুলকে বিদায় জানিয়ে মাইক্রোবাসে চেপে বসি। ঢাকার পথে আমাদের যাত্রা শুরু হয়।