নজর রাখুন হৃদস্পন্দনে

হৃদরোগজনিত সমস্যা রয়েছে এমন মানুষের জন্য সার্স-সিওভি-২ ভাইরাসটি বেশ মারাত্মক।

লাইফস্টাইল ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Sept 2020, 11:39 AM
Updated : 29 Sept 2020, 11:39 AM

কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারীর কারণে পুরো বিশ্ব থমকে দাঁড়িয়েছে। নবজাতক থেকে শুরু করে প্রবীণ সদস্যরাও এ ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন।

গবেষকরা এখনও অতিমাত্রায় সংক্রামক এই রোগের সুনির্দিষ্ট কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে পারেননি। এ পরিস্থিতিতে, প্রতিনিয়ত মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলছে।

হৃদরোগজনিত সমস্যা রয়েছে এমন মানুষের জন্য সার্স-সিওভি-২ ভাইরাসটি বেশ মারাত্মক। কারণ, এই ভাইরাস মানুষের শ্বসনতন্ত্রে প্রবেশ করে ফুসফুসকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এ কারণে, মানুষের শ্বাসজনিত সমস্যা ও অক্সিজেন গ্রহণ বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে, মানুষের হৃদপিণ্ডের ওপর চাপ বৃদ্ধি পায় এবং মৃত্যু ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়।

হার্ট বা হৃদপিণ্ড একটি পাম্পের মতো, যা ইলেকট্রিক্যাল স্পন্দনের মাধ্যমে পুরো শরীরে অক্সিজেন যুক্ত রক্ত সরবরাহ করে।

মানুষের শরীরের শিরাগুলোর মাধ্যমে কার্বন-ডাই-অক্সাইড যুক্ত ডিঅক্সিজেনেটেড (অক্সিজেনবিহীন) রক্ত শরীরের বিভিন্ন কোণ দিয়ে হার্টে প্রবেশ করে এবং অক্সিজেনেটেড রক্ত ধমনীর মাধ্যমে সারা শরীরে প্রবেশ করে।

সাধারণত, নিয়মিত বা স্বাভাবিক হৃৎস্পন্দন খুব কমই অনুভূত হয়। তবে, যখনই রক্ত চলাচল বাধাপ্রাপ্ত হয় তখনই বিভিন্ন সমস্যা অনুভূত হয়।

অনিয়মিত হৃৎস্পন্দন কিংবা ‘অ্যারিথমিয়াস’, বুক ধড়ফড় ও শ্বাসজনিত সমস্যার সৃষ্টি করে।

স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে, একজন সুস্থ মানুষের প্রতি মিনিটে ৬০ থেকে ১০০ বার হৃৎস্পন্দন হয়। অ্যারিথমিয়ার সময় দুই ধরনের হৃৎস্পন্দন লক্ষ্য করা যায়।

যথা- স্বাভাবিকের চেয়ে ধীর স্পন্দন, যাকে বলে ‘ব্র্যাডিকার্ডিয়া’ এবং সাইনাস স্পন্দনের চেয়ে দ্রুত হৃৎস্পন্দন, যাকে বলা হয় ‘টাকাইকার্ডিয়া’

অধিকাংশ সময় এই অ্যারিথমিয়াস হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায় না। তবে উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছে ধড়ফড়ানি, মাথা ঝিমানি ও বুকে ব্যথা।

কিছু অ্যারিথমিয়াস রক্ত চলাচলে বড় ধরনের বাধার কারণ হয়ে দাঁড়ায়; সঠিক সময়ে চিকিৎসা না নিলে যা স্ট্রোক, সিনকোপ এবং মানুষের মৃত্যুও ঘটাতে পারে।

মানুষের শ্বসনতন্ত্রে যেহেতু সার্স-সিওভি-২ তীব্র প্রভাব ফেলে তাই কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারী চলাচলে মানুষকে সচেতন থাকতে হবে।

সব থেকে সাধারণ অ্যারিথমিয়াকে বলা হয় ‘আট্রিয়াল ফাইব্রিলেশন’, যা প্রবীণ মানুষের মাঝে বেশি দেখা যায়। এ ধরনের অ্যারিথমিয়া সাধারণত কম সময়ের জন্য থাকে।

তবে, সবচেয়ে বিপজ্জনক অ্যারিথমিয়া হল ‘ভেন্ট্রিকুলার ফাইব্রিলেশন’। এর কারণে, হৃদপিণ্ডের ‘ভেন্ট্রিকল’গুলো সঠিকভাবে সংকুচিত হতে পারে না। ফলে, হৃদপিণ্ড থেকে মস্তিষ্কে রক্তচলাচল ব্যাহত হয়, যা মৃত্যু ঘটাতে পারে।

‘ব্র্যাডিকার্ডিয়া’র সময় পেসমেকার হৃদযন্ত্রের স্বাভাবিক স্পন্দনে সহায়তা করে এবং বিভিন্ন উপসর্গ ও সমস্যা থেকে রক্ষা করে।

একটি পেসমেকারের দু’টি অংশ রয়েছে। একটি অংশ হল ধাতব বস্তুর ইলেকট্রনিক সার্কিট, যা স্পন্দন তৈরি করে এবং অন্য অংশটি হল দীর্ঘসময় ব্যবহারযোগ্য ব্যাটারি ও একটি বা দু'টি অপরিবাহী তার যাকে লিড বলে।

স্পন্দন সৃষ্টিকারী অংশটি মাইক্রোকম্পিউটার হিসেবে কাজ করে এবং স্পন্দন সৃষ্টি ও এর সময়কে নিয়ন্ত্রণ করে। পালস জেনারেটর দ্বারা উৎপাদিত ইলেকট্রিক্যাল স্পন্দন সীসার তার দিয়ে হার্টে প্রবেশ করে।

২৫ গ্রাম ওজনের স্মার্ট ডিভাইসটি হৃদযন্ত্রের ইলেকট্রিক্যাল কার্যক্রম নজরে রাখে ও কোনো কারণে হৃৎস্পন্দন কমে গেলে স্পন্দন সরবরাহের মাধ্যমে হৃদযন্ত্রকে সচল রাখে। 

যেহেতু, হৃদঘটিত সমস্যার ধরনে ভিন্নতা রয়েছে, তাই সমস্যানুযায়ী রোগীদের চিকিৎসা ও থেরাপি নিতে হয়।

এ ভিন্নতার কারণে পেসমেকারের ধরনেও পার্থক্য রয়েছে। যেমন- সিঙ্গেল চেম্বার, ডুয়াল চেম্বার, রেট-রেসপন্সিভ, এমআর সেফ পেসমেকার।

এখনকার পেসমেকারগুলো বেশ উন্নত এবং এগুলোতে বেশ কিছু ফিচার রয়েছে যা সবসময় রোগীর সুরক্ষা নিশ্চিৎ করে।

প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে ‘কার্ডিওভাসকুলার’ রোগজনিত সমস্যায় অনেক মানুষ মৃত্যুবরণ করে।

হৃদরোগজনিত বিভিন্ন রোগ নিয়ে মানুষকে সচেতন করতে এবং এ রোগ থেকে রক্ষায় করণীয় সম্পর্কে জানাতে ১৯৯৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও বিশ্ব হার্ট ফাউন্ডেশন (ডব্লিউএইচএফ) ‘বিশ্ব হার্ট দিবস’ পালন করে।

প্রতিবছর ২৯ সেপ্টেম্বর বিশ্ব হার্ট দিবস পালন করা হয়। রোগটি সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে শিক্ষামূলক কর্মশালা, উন্মুক্ত আলোচনা, বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরীক্ষা প্রভৃতি।

করোনাভাইরাস মহামারীর প্রাদুর্ভাবের কারণে যাদের হৃদরোগজনিত বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে তাদের সচেতন থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়। কারণ, তাদেরই এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি বেশি।

এ পরিস্থিতিতে, তাদের ওষুধ সেবন, শারীরিক কসরত ও চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিৎ। পাশাপাশি, একটি সুন্দর জীবনযাপনের জন্য তাদের জন্য রয়েছে সঠিক চিকিৎসা ও বিভিন্ন ধরনের থেরাপির ব্যবস্থা।

হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. এপিএম (আ প ম) সোহরাবুজ্জামান।

লেখক: ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতালের হৃদরোগ-বিশেষজ্ঞ ও জেষ্ঠ্য পরামর্শক, বাংলাদেশ হার্ট রিদম সোসাইটি’র সভাপতি এবং বাংলাদেশ সোসাইটি অব কার্ডিওভাসকুলার ইন্টারভেনশন’য়ের উপ-সভাপতি ডা. এপিএম (আ প ম) সোহরাবুজ্জামান।