করোনাভাইরাসের আমলে ভদ্রতাজ্ঞান

মাস্ক পরাটাই এখন ভদ্রতা। প্রীতিসম্ভাষণের জন্য ‘হ্যান্ড শেইক’ নয়। বেছে নিন অন্য কোনো পন্থা।

লাইফস্টাইল ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Sept 2020, 11:05 AM
Updated : 17 Sept 2020, 11:05 AM

স্বাভাবিক জীবনযাপনের রীতি-নীতিগুলো মাত্র কয়েক মাসেই তছনছ করে দিয়েছে নতুন করোনাভাইরাস। মানুষ সামাজিক জীব। জীবনের প্রতিস্তরে এই বাক্যটাকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করা মানুষ আজ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বাধ্য প্রাণ ভয়ে।

নতুন এই পরিবর্তনগুলোর সঙ্গে মানিয়ে নিতে আজও কষ্ট হয়। আর যারা মানিয়ে নিয়েছেন তারাও প্রতিদিন করোনাভাইরাস মহামারী শেষ হয়েছে এই খবর শোনার জন্য মরিয়া।

তবে তা এখনও হয়ত অনেক দূরে। তাই নতুন নিয়মগুলোকেই মানতে হবে।

আর এসব নিয়মে সীমাবদ্ধ থেকেই সবার সুবিধা অসুবিধা বিবেচনা করতে হবে, বজায় রাখতে হবে সদাচরণ, ভদ্রতা ও সহমর্মীতা।

‘নিউ নরমাল’ জীবনের আচরণবিধি কেমন হওয়া উচিত সে সম্পর্কে জানান হল আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদন অবলম্বনে।

ঘরের বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রে

মাস্ক থাকতে হবে এবং তা পকেটে নয়, মুখে থাকতে হবে। আজকাল ঘরের বাইরে বের হলে পুরো সময়টা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব হয় না। তাই মাস্কই আপনার প্রধান সুরক্ষা।

ভদ্রতার দৃষ্টিকোন থেকে দেখলে মাস্ক পরা মানেই হল আপনি নিজের এবং আশপাশের মানুষের সুরক্ষার ব্যবস্থা করেছেন অন্তত নিজের দিক থেকে।

মাস্ক না পরার আইনগত জটিলতা দেশের সব জায়গায় কিংবা সবসময় এক রকম নয়। আর সেটা জরুরি বিষয়ও নয়। কারণ আপনার মাস্ক পরার কারণ ভাইরাস থেকে সুরক্ষিত থাকা, আইন মানা নয়।

সাক্ষাতে সংবর্ধনা

কারও সঙ্গে দেখা হলে কিংবা বিদায় নেওয়া সময় করমর্দনের উদ্দেশ্যে হাত বাড়িয়ে দেওয়া অভ্যাস থেকে অনেকেই বেরিয়ে এসেছেন এতদিনে। মনে হয়ত প্রশ্ন আসতে পারে, করোনাভাইরাসের কারণ কি হাত মেলানোর রীতি হারিয়ে যাবে?

হাত মেলাতে না পারলেও তার অনেক বিকল্পই মানুষ আবিষ্কার করেছে। কনুই মেলানো, পায়ে পা মেলানো, চোখের ভাষায় সম্ভাষণ, হালকা মাথা নুইয়ে ‘নড’ ইত্যাদিসহ আরও অনেক কিছুই মানুষ অনুশীলন করছে।

আর হাত মেলানো হারিয়ে যাওয়ার ভয় নেই। কারণ সবার মনেই স্বাভাবিক জীবনে আক্ষেপগুলো আজও সক্রিয়। মহামারী গেলে শুধু হাত মেলানো নয়, হয়ত আলিঙ্গনই প্রথম পছন্দ হয়ে দাঁড়াবে।

অন্যের পোষা প্রাণীকে আদর

অন্যের পোষ্যকে আদর করতে শক্ত বারণ হয়ত নেই। যেহেতু পশু পাখির কোভিড-১৯’য়ে আক্রান্ত হওয়া ঘটনা নেই। তাই করোনাভাইরাসবাহী পোষ্যকে স্পর্শকে করতেই পারেন।

তবে সেই পোষা প্রাণীর শরীর থেকে ভাইরাস ছড়ানো মোটেই অসম্ভব নয়। তাই নিরাপত্তার স্বার্থে নিজের কিংবা অপরের পোষা প্রাণী ধরলে পরক্ষণেই হাত পরিষ্কার করে নিতে হবে।

লিফ্ট ব্যবহার কতটা ঝুঁকিপূর্ণ?

বহুতল ভবনে ওঠানামা করার এই যন্ত্র মানুষ অনেকবার ব্যবহার করে। তবে তার ভেতরে থাকার সময়টা বেশ সামান্য। সেখানে সবাই মাস্ক পরিহিত থাকলে, হাঁচি কাশি না দিলে এবং সম্ভব হলে পরস্পর থেকে মুখ ঘুরিয়ে রাখলে সংক্রমণের আশঙ্কা খুবই কম, দাবি বিশেষজ্ঞদের।

নগদ লেনেদেনে ঝুঁকি

নগদ অর্থ থেকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি কম বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তবে করোনাভাইরাসের আগে থেকেই দেশে ‘ডিজিটাল’ লেনদেন জনপ্রিয় ছিল। সেই জনপ্রিয়তার পালে ঝড় হাওয়া দিয়েছে করোনাভাইরাস। আর ঝুঁকি যত সামান্যই হোক, তা এড়ানো সুযোগ থাকলে কেনো নয়?

হাঁচি আসলে কি করণীয়?

বোস্টন ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ হেলথ’য়ের ‘এপিডেমিওলজি’ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এলেনর মুরে বলেন, “হাঁচির সময় মুখ থেকে বেরিয়ে আসা লালাকণাকে অন্য মানুষের সংর্স্পে পৌঁছাতে না দেওয়াই হবে আপনার লক্ষ্য। সেটা দূরত্ব বজায় রেখেও করতে পারেন। আর মাস্ক কিংবা অন্য কিছু দিয়ে বাধা সৃষ্টি করতে পারেন।”

তাই হাঁচি কাশি সবকিছুই হবে মাস্কের মধ্যে। হাঁচি থেকে মাস্ক না বাঁচিয়ে বরং তা পরিধান করে নিজেকে এবং আশপাশের মানুষকে বাঁচান। মাস্ক নতুন পাওয়া যাবে, জীবন নয়।

কেউ মাস্ক পরেনি, নোংরা মাস্ক পরেছে কিংবা ভুলভাবে পরেছে

মুখে মাস্ক নেই বা থাকলেও তা নোংরা, ছেঁড়া, ঢিলা হয়ে গেছে এমন কারও সামনে পড়লে সবচাইতে ভদ্র আচরণ হতে পারে তাকে নতুন একটি মাস্ক উপহার দেওয়া। আজকাল সার্জিকাল মাস্কের দাম খুব বেশি না। অন্যের না হোক, নিজের নিরাপত্তা স্বার্থে এতটুকু দান করতেই পারেন।

তবে সমস্যা হল কেউ ভুলভাবে মাস্ক পরলে তা ভুল ধরানো।

পরিচিত কেউ এমনটা করলে বলতে পারেন, “আপনার মাস্কটা সরে গেছে, আমারও প্রায়ই হয়।” জ্ঞানীর জন্য এতটুকু ইশারাই যথেষ্ট।

তবে একেবারে অপরিচিত কাউকে শোধরাতে যাওয়া হয়রানি ডেকে আনতেই পারে। সেক্ষেত্রে পরিস্থিতি বুঝে নিজেই দূরত্ব মেনে চলাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।

অনলাইনে আলাপ

ঘরে বসে অফিস করার সুবাদে সারাদিন কেটে যাচ্ছে ঘরের পোশাকে। সেই পোশাকেই অফিসের মিটিংটাও হয়ে যাচ্ছে। তবে মনে রাখা উচিত ঘরে আছেন বলেই যে সহকর্মীদের সামনে নিজের ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দেবেন তা জরুরি নয়।

আবার ঘরে পরা সব টি শার্ট অফিসের মিটিংয়ে বসার যোগ্যও হয় না।

তাই ঘরোয়া হলেও মার্জিত পোশাক পরতে হবে। কি পরবেন বুঝতে না পারলে নিজেদের কর্মকর্তাদের অনুসরণ করতে পারেন।

অনলাইনে কথা বলায় ভদ্রতা

এতদিনে নিশ্চয়ই জেনেছেন অনলাইনে কথা বলার ক্ষেত্রে আপনি কিছু বলার সঙ্গে সঙ্গেই তা সবার কাছে পৌঁছায় না। ইন্টারনেট সংযোগের মানভেদে কমবেশি শব্দ যাওয়া আসায় ঘাটতি থাকেই।

তাই একজনের কথার মধ্যে আরেকজন কথা বলে ফেলার ঘটনা সব মিটিংয়েই ঘটে যায়।

এ সমস্যা সমাধানে একজনকে আয়োজক বা ‘হোস্ট’ বানিয়ে বাকি সবাই ‘মিউট’ করে রাখুন। যখন কথা বলার প্রয়োজন হবে তখন ‘আনমিউট’ করে নেবেন।

অনলাইন মিটিংয়ের ক্ষেত্রে প্রায় সবখানেই ব্যবহার হচ্ছে ‘জুম’। সেখানে থাকা ‘রেইজ হ্যান্ড’ ফিচারটি এক্ষেত্রে কার্যকর।

মিটিং ‘গ্যালারি ভিউ’তে দেখা ভালো। সকল অংশগ্রহণকারীর নড়াচড়া দেখতে পেলে কথার ওপর কথা বলে ফেলার সম্ভাবনা কমে।

ভিডিও কল দেওয়ার ক্ষেত্রে

হুট করে মানুষকে ভিডিও কল করাও উচিত নয়। তাতে অপর ব্যক্তি বিব্রত কিংবা বিরক্ত হতে পারে।

আপনার ঘনিষ্ঠ মানুষগুলোই শুধু এর ব্যক্তিক্রম। তাই প্রথমে অডিও কল দিয়ে, পরে তার সঙ্গে আলাপ করে জেনে নিন ভিডিও কলে তিনি আসতে পারবেন কি-না।

ফোন করার আগে টেক্সট করে নিলে আরও ভালো।

ভার্চুয়াল মিটিংয়ে নিজের ক্যামেরা বন্ধ রাখা

ভিডিও কলে নিজের ক্যামেরা বন্ধ রাখাটা অনেকটা যুক্তিহীন। তারপরও ক্যামেরা বন্ধ রাখলেও কালো পর্দা না রেথে অন্তত নিজের একটা ছবি দিয়ে রাখা উচিত। আবার ভিডিও কল চলাকালীন ক্যামেরার সামনে না থাকলে অবশ্যই ভিডিও ও অডিও বন্ধ করে যাওয়া উচিত, যাতে নিজে কোনো বিব্রতকর পরিস্থিতি না পড়েন। আর আপনার আশপাশের কোনো শব্দ মিটিংয়ের সমস্যার কারণ না হয়।

ব্যক্তিগত আর কর্মজীবনকে আলাদা রাখা

অনলাইন মিটিং যিনি শুরু করবেন, তা শেষ করার দায়িত্বও তার ঘাড়েই বর্তায়। শুধু অফিস মিটিং নয়, দলবদ্ধ আড্ডাতেও অনলাইন মিটিংয়ের সময়সীমায় সীমাবদ্ধতা থাকা উচিত। আর যিনি মিটিং আয়োজন করছেন তারই মিটিং শেষ করার উদ্যোগ নেওয়া উচিত।

কারণ হতে পারে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে কারও গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ আছে, পারিবারিক দায়-দায়িত্ব আছে। কিন্তু অফিস মিটিং শেষ না হওয়া পর্যন্ত যেতে পারছেন না।

সহকর্মীকে ফোন বা মেইল করার ক্ষেত্রে

সহকর্মীরা এখন যেহেতু বাসায় থাকছেন, তাই কোনো প্রয়োজনে ফোন করে যদি আশপাশে বাচ্চার কান্না, কোলাহল কিংবা পারিবারিক কোলাহল বেশি শুনতে পান তবে সহকর্মীকে কিছুক্ষণ সময় দেওয়া উচিত।

ভদ্রভাবে বলতে পারেন, ‘আপনি নিরিবিলি স্থানে গিয়ে আমাকে ফোন করুন।’

আবার এখন সময় উল্টোপাল্টা হয়ে যাওয়ার কারণে কাজের মেইল ছুটির দিনে পাঠানো ঠিক হবে কি-না সেটাও আপনার মাঝে দ্বিধা তৈরি করতে পারে।

আবার যাকে মেইল করছেন তিনি যদি ভিন্ন ‘টাইম জোন’য়ের হয় সেক্ষেত্রেও সমস্যা দেখা দিতে পারে।

এই সমস্যা মেটাতে মেইল তৈরি করে নিয়ে ‘ড্রাফ্ট’য়ে সেইভ করে রেখে পরে সময় মতো পাঠাতে পারেন।

আবার ব্যবহার করতে পারেন ‘গুগল বুমেরাং’ যেখানে মেইল পাঠানোর নির্দিষ্ট দিনক্ষণ ঠিক করে দিতে পারবেন এবং সয়ংক্রিয়ভাবে আপনার ঠিক করা সময়ে মেইল ‘সেন্ড’ হবে।

আরও পড়ুন