“সেদিন সুদূর নয়- যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়” জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই কথা সত্যি সত্যি প্রমাণিত হল এই করোনাভাইরাসের সময়ে। যখন সারা বিশ্বজুড়ে হাহাকার চলছে এই মহামারীর তখন ঘরের নারীরা মেধা মননে এবং ধৈর্যে ঠিকই ঘর-সংসার এবং উপার্জনে খুঁজে নিয়েছে নতুন পথ।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের লাইফস্টাইল খুঁজে নিয়েছে এমনই কয়েকজন উদ্যোক্তাকে যারা এই লকডাউনে নিজেকে মেলে ধরেছেন প্রজাপতির মতন।
যেই রান্নাঘর নিয়ে নানা ধরনের মতবাদ চারপাশে সেই রান্না কে করবে না করবে সেই আলোচনা থেকে বাইরে যেয়ে করেছেন রান্না দিয়ে উপার্জনের ব্যবস্থা।
শুধু তাই নয়- এই রান্নার টাটকা স্বাদ ক্রেতাদের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিতেও ব্যবস্থা করেছেন হোম ডেলিভারির।
কেউ যখন বাসায় রান্না করে হাঁপিয়ে উঠছেন তখন এই উদ্যোক্তারাই নিজের শখকে পেশা করে অন্যকে দিয়েছেন স্বস্তি আবার তৈরি করেছেন স্বাবলম্বি হওয়ার সিঁড়ি।
বিশেষ এই প্রতিবেদনে এমনই তিনটি উদ্যোগের উদ্যোক্তার গল্প আজ পাঠকের জন্য তুলে ধরা হল।
মন ভরে যায় অন্তির রান্নায়
দীর্ঘ দশ বছর কস্টিউম ডিজাইনিংইয়ের পেশার ইতি টেনে নিজের পছন্দের কাজকে ব্যবসা হিসেবে নিয়েছেন। তার সঙ্গে আছেন তার বন্ধু পরিচালক-অভিনেতা কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়।
‘মন ভরে খান’ পেইজের অনলাইনের যাবতীয় দিকটা দেখছেন কৃষ্ণেন্দু আর উনুন সামলাচ্ছেন অন্তি।
তার রান্নার প্রশংসা বন্ধুমহলে আগে থেকেই বেশ চর্চার বিষয় ছিল। সেখান থেকে কি করে এই যাত্রা শুরু তা বললেন নিজেই।
“বরাবরই রান্নার শখ ছিল। রান্না ভালোও হত, সবাই পছন্দ করতো। গত এক বছর ধরেই চিন্তা ছিল রান্না নিয়ে কাজ করার। কিন্তু শুরুটা হয়ে উঠছিল না। এই মহামারীর সময়ে এই উদ্যোগটা জোড়সোরভাবেই নেওয়া হয় এবং সর্বাধিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয় মাথায় রেখেই কাজ করার চেষ্টা করছি।”
“পরিচ্ছন্নতার নিশ্চিত করতে নিজের হাতেই সব কাজ যেমন-বাজার, কাটা বাছা, রান্না এমনকি প্যাকেজিংয়ের কাজও করছি। যেন কোনো অভিযোগ না আসে।”
“পেইজের এক মাস বয়স না হতেই অনেক সাড়া পেয়েছি। খাবারের মান ঠিক রাখার পাশাপাশি ডেলিভারিও যেন নিরাপদ হয়, তাই নিজেদের লোক দিয়েই আমরা ডেলিভারি করছি।” বললেন তিনি।
ভবিষ্যতে কাজ চালিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “বছরের শুরুতেই কস্টিউম ডিজাইনিংয়ের পেশা ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা করেছিলাম, আর এখন যেহেতু পেইজ়টা ভালো ভাবেই যাত্রা শুরু করেছে তাই এটা নিয়মিত করার চেষ্টা করবো।”
পেশার পাশাপাশি শখের ইশারায় কায়েনাত ও ইশরাত
লক ডাউনে ঘরে বসে বেইকিং নিয়ে কাজ করেছেন এই উদ্যোক্তা।
যাত্রা শুরু সম্পর্কে তিনি বলেন, “আম্মুর রান্না দেখে এ কাজের প্রতি উৎসাহ পাই। আমার মা রান্নার নির্দেশক ছিলেন। সুস্থ থাকার সময়ে তিনি অনেকজনকেই রান্না শিখিয়েছিলেন। তখন থেকেই আমার রান্না শেখা। মা অসুস্থ থাকায় তার ‘বেইক আর্টিস্ট’ পেইজটা এতদিন বন্ধ ছিল। এই লকডাউনের সময়ে নিজেরই মনে হল যে আবার পেজটা শুরু করি আর মায়ের রেসিপিগুলোও কাজের লাগাই।”
বাসায় বসে আপাতত শিক্ষকতার কাজটা করছেন। লকডাউনে বাসায় থেকে ক্লাস নিচ্ছেন তিনি। বাকিটা সময় চাইলেই কাজে লাগানোর জন্যই এই শখটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। আপাতত সাহায্য করার মতো কেউ নেই।
তিনি বলেন, “নিজেই সব প্রস্তুত করে ডেলিভারি দিচ্ছি। ক্রেতারাও খুশি এতে। শুরুতে পিক আপ ডেলিভারি করতাম। কিন্তু এখন আমার নির্দিষ্ট একজন ডেলিভারি ম্যান আছে, যিনি এলাকার বাইরে ডেলিভারি করেন। স্বাস্থ্য নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করেই কোন অ্যাপের সাহায্য না নিয়ে নিজেই লোক নির্দিষ্ট করে নিয়েছি। এতে হয়ত ডেলিভারি চার্জটা একটু বেশি পড়ছে কিন্তু নিরাপত্তাটা শতভাগ নিশ্চিত হচ্ছে।”
এই উদ্যোগে কায়েনাতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন, ইশরাত সুলতানা। আগে তিনি একটা বেসরকারি ব্যাংকের ম্যানেজার ছিলেন। বর্তমানে ‘শুদ্ধ খামার’য়ের সহকারী প্রতিষ্ঠাতা।
কায়েনাত যোগ করেন, “বেইকিংয়ে আগ্রহ থাকায় আমরা দুজন মিলেই কাজ শুরু করছি। কোনো অর্ডার এলে যার বাসার কাছাকাছি হয় সে খাবার তৈরি করে ডেলিভারি দেই। এলাকার বাইরে থেকে অর্ডার আসলে এভাবেই আমরা তা কাভার করতে পারি।”
বেইকিং নিয়মিত চালিয়ে যাবেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমার স্কুল তিনটা পর্যন্ত। বিকালের সময়টা আমি বেইকিংয়ে ব্যয় করতে পারব। তাছাড়া এটা আমার ‘প্যাশন’, তাই শুরু যখন করেছি তা নিয়মিত চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা রয়েছে।”
নাস্তায় আস্থা নিয়ে তামান্না
‘তামান্না’স ফুড গ্যালারি’র কর্ণধার তাসনুভা তামান্না নাস্তা নিয়ে কাজ করছেন। মহামারীর এই সময়টাকে কাজে লাগিয়ে শুরু করেছেন অনলাইডন ফুড ডেলিভারি সার্ভিস। তার মেন্যু আছে নাস্তা ও ফ্রোজেন খাবার।
অনলাইনের এই যাত্রা সম্পর্কে তিনি বলেন, “চাকুরি করার ইচ্ছা ছিল সবসময়ই। কিন্তু ছোট বাচ্চা থাকায় নিয়মিত আর অফিস করতে পারিনি। আবার বাসায় বসে থাকাও ভালো লাগে না। তাই নিজে কিছু একটা করার চেষ্টা করি।“
“বাচ্চাদের জন্য নাস্তা বানাই ওরা খুব পছন্দ করে। আবার আমার স্বামীও আমাকে উৎসাহ দেয়, সেখান থেকেই মূলত এই খাবার ডেলিভারি ব্যবসার যাত্রা শুরু।“
“আমি মূলত কাজ করছি ফ্রোজেন আইটেম- সমুচা, আলু পুরি, ডাল পুরি, ডোনাট, আর গজা নিয়ে।”
সংসার ও ছোট বাচ্চা সামলে অর্ডারের চাপ সামলাতে মাঝে মধ্যেই রাত জেগে কাজ করতে হয় তাকে। তবে স্বামী সহযোগিতা করায় কাজের চাপ সামলাতে অসুবিধা হচ্ছে না বলে জানান তিনি।
কাজ নিয়মিত করে যাবেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “নিজেরই একটা রেস্তোরাঁ দেওয়ার ইচ্ছা ছিল। আর স্বামীর উৎসাহে আরও এগিয়ে যাওয়ার সাহস পেয়েছি। তাই এতে নিয়মিত লেগে থাকার ইচ্ছা আছে।”
আপাতত বন্ধু মহলেই তার উদ্যোগ বিপুল পরিমাণে সাড়া ফেলেছে। বাসায় স্বাস্থ্যসম্মত ভাবে বানানোর গ্যারান্টি থাকায় অনেকেই বাসায় অর্ডার করে উপভোগ করছেন তামান্নার বানানো নাস্তা।
এই শেষ নয়
“লক” মানেই বন্ধ নয় এই মতবাদে বিশ্বাসী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর লাইফস্টাইল খুঁজে বেড়াচ্ছে এমনই আশার আলো। যে আলো একদিন ঘরে ঘরে তৈরি করবে উপার্জনের পথ। যেখানে নারী এবং পুরুষের হাতে সমানভাবে থাকবে স্বাবলম্বী হওয়ার মশাল। আর সন্তানরা আশাহীন হবে না করোনাভাইরাসের মতন অযাচিত কোনো পরিস্থিতে।
পাঠকের জানা কোনো এমন আশার গল্প পাঠাতে পারেন আমাদের ঠিকানায়। বা যোগাযোগ করুন ফেইসবুক পেইজে।
কারণ কবি বলেছেন, “বিশ্বে যা-কিছু মহান্ সৃষ্টি চির-কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”