মাংসের পুষ্টিগুণ ও খাওয়ায় সতর্কতা

উৎসবে অনেকেই খাওয়ার লাগাম ছেড়ে দেন। তবে যাই খান না কেনো পরিমাণের দিকে খেয়াল রাখতে হবে।

মামুনুর রশীদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 August 2020, 09:27 AM
Updated : 2 August 2020, 09:27 AM

বিশেষত, তেল-চর্বিযুক্ত খাবারের ব্যাপারে। আর যে কোনো উৎসবে সেই খাবারগুলোই সবচাইতে বেশি খাওয়া হয়। পাশাপাশি মাথায় রাখতে হবে, তেল-মসলাযুক্ত খাবার খাওয়া পরপরই যেন দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, মিষ্টি না খেয়ে ফেলি।

গরু আর খাসির মাংস এই ঈদের কয়েকদিনের জন্য ‘জাতীয়’ খাবারে পরিণত হবে। সকালে রুটি দিয়ে মাংস, দুপুরে ভাতের সঙ্গে মাংস, সন্ধ্যার নাস্তায় মাংস, রাতে আবার হয়ত খিচুড়ি দিয়ে মাংস। মাংসের নানাপদে ঘর থাকবে সয়লাব। অথচ এই মাংসকে সাধারণ দৃষ্টিতে ক্ষতিকর হিসেবেই দেখা হয়।

তবে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি (বাডাস)’য়ের পুষ্টিবিদ ও স্বাস্থ্য শিক্ষা অফিসার এবং বাংলাদেশ অ্যাকাডেমি অব ডায়াটিকস অ্যান্ড নিউট্রিশন (বিএডিএন)’য়ের নির্বাহী পরিচালক ডা. সাজেদা কাশেম জ্যোতী বলছেন, “গরু ও খাসির মাংসের অনেক উপকারী দিকও আছে। পরিমিত পরিমাণে সঠিকভাবে খেলে এ থেকে যে পরিমাণ পুষ্টি পাওয়া যায় তা সমপরিমাণ অন্য কিছু থেকে পাওয়া কঠিন।”

মাংসের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছেন এই পুষ্টিবিদ।

গরুর মাংসের পুষ্টিগুণ

শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ৯টি পুষ্টি উপাদান আছে গরুর মাংসে। এগুলো হল প্রোটিন, জিঙ্ক, ভিটামিন বি টুয়েলভ, সেলেনিয়াম, ফসফরাস, নায়াসিন, ভিটামিন বি৬, আয়রন এবং রিবোফ্লাভিন।

প্রোটিন শরীরের পেশি গঠনে ভূমিকা রাখে। জিঙ্ক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। ফসফরাস দাঁত ও হাড়ের শক্তি বাড়ায়। আয়রন শরীরের পেশিতে অক্সিজেন প্রবাহে সহায়তা করে। ‘ভিটামিন বি টুয়েলভ’ খাদ্য থেকে শক্তি যোগান দেয়।

৩ আউন্স গরুর মাংস থেকে যে পরিমাণ জিংক আসে সেই পরিমাণ জিংক পেতে আপনাকে খেতে হবে ৩ আউন্স ওজনের ১১ টুকরা টুনা মাছ। এই পরিমাণ আয়রনের জন্য খেতে হবে ৩ আউন্স ওজনের ৭ টুকরা মুরগির বুকের মাংস। এই পরিমাণ আয়রনের জন্য খেতে হবে ৩ কাপ পালংশাক। এই পরিমাণ ‘রিবোফ্লাভিন’য়ের জন্য খেতে হবে ৩ আউন্স ওজনের আড়াই টুকরা মুরগির বুকের মাংস। এবং এই পরিমাণ ‘থায়ামিন’ এর জন্য খেতে হবে ৩ আউন্স ওজনের ২ টুকরা মুরগির বুকের মাংস।

বাড়ন্ত শিশুদের জন্য গরুর মাংসের উপকারিতা

বাড়ন্ত বা ‘টিনএইজার’দের সমর্থ ও শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে গরুর মাংসের তুলনা নেই। শুধু শারীরিক বর্ধন নয়, বুদ্ধি-বৃত্তিক গঠন এবং রক্ত বর্ধনেও এটি ভূমিকা রাখে। ৩ আউন্স গরুর মাংসে আছে ৯-১৩ বছর বয়সি শিশুর দৈনিক চাহিদার ১২৫% ভিটামিন বি১২, ৯০% প্রোটিন, ৭৪% জিংক, ৪২% সেলেনিয়াম, ৩২% ভিটামিন বি৬, ৩২% আয়রন, ২৯% নায়াসিন, ২৩% রিবোফ্লাভিন এবং ১৬% ফসফরাস।

গরুর মাংসে কোলেস্টেরল এর মাত্রা

৩ আউন্স ‘সিরলোইন’ ভাগের মাংসে কোলেস্টেরলের মাত্রা ৪৭ মিলিগ্রাম এবং ৩ আউন্স ‘রাউন্ড’ অঞ্চলের মাংসে কোলেস্টেরল এর মাত্রা ৫৩ মিলিগ্রাম।

একজন সুস্থ মানুষের কোলেস্টেরল এর দৈনিক নিরাপদ মাত্রা হল ৩০০ মিলিগ্রাম। হৃদরোগীর জন্য ২০০ মিলিগ্রাম। সুতরাং ৩ আউন্স গরুর মাংসে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিরাপদ সীমার অনেক নিচে। একটি ডিমের কুসুমে আছে ২১২ মিলিগ্রাম কোলেস্টেরল। তাই সব দোষ গরুর মাংসের একার না।

যে বিষয়গুলোতে নজর রাখতে হবে

ঈদের সময় খাদ্য তালিকায় ভারি খাবারের পাশাপাশি কিছু সহজপাচ্য স্বাস্থ্যসম্মত খাবারও থাকা চাই। যেমন, বিভিন্ন ফলের সালাদ, কাস্টার্ড, হাড়বিহীন মুরগির মাংস ও নানারকম সবজির পদ। এতে যেমন রুচি বদলানো যায়, অন্যদিকে পরিবারের কেউ অসুস্থ থাকলে সেও স্বচ্ছন্দ্যে খেয়ে সুস্থ থাকতে পারবে।

লাল মাংস, যেমন: গরু, খাসির মাংসে ‘স্যাচুরেইটেড ফ্যাট’ বা সম্পৃক্ত চর্বি থাকে। এটি অতিরিক্ত গ্রহণ করলে ওজন বাড়ার পাশাপাশি রক্তনালিতে চর্বি জমবে, রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়বে।

এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারও হতে পারে এই লাল মাংসের কারণে। আর সাধারণ সমস্যার মধ্যে কোষ্ঠকাঠিন্য, বদহজম, ডায়রিয়া, ‘গ্যাস্টিক আলসার’য়ের সমস্যা ইত্যাদিও তো আছেই।

দৈনিক ৩ আউন্স বা ৮৫ গ্রামের বেশি মাংস খাবেন না। খাওয়ার জন্য বেছে নিন ‘রাউন্ড’ এবং ‘লোইন’ বা ‘সিরলোইন’ অঞ্চলের মাংস। এখানে চর্বির পরিমাণ চামড়া ছাড়ানো মুরগির রানের মাংসের চেয়েও কম।

মাংস কাটার সময় দৃশ্যমান চর্বি ফেলে দিন। বেশি তেলে ভুনা করার চাইতে বার-বি-কিউ, গ্রিল, কাবাব বা অল্প তেলে ঝোল করে ঝোল এড়িয়ে মাংস খাওয়া ভালো।

যারা স্থূলতা, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরল, কিডনির সমস্যা, গেঁটেবাত, হৃদরোগ ইত্যাদিতে ভুগছেন তারা অবশ্যই পুষ্টিবিদের পরামর্শ মতো ও পরিমিত পরিমাণে খাবেন।

খাওয়ার মাঝে পানি পান করবেন না। এতে হজম রসগুলো পাতলা হয়ে যায়। ফলে হজমে অসুবিধা হয়। খাওয়া শেষে অন্তত আধা ঘণ্টা পর পানি পান করবেন। টক দই, বোরহানি, লেবুর শরবত (চিনি ছাড়া) ইত্যাদি খাবার হজমে সহায়ক। এগুলো খাবার পরে খেতে পারেন।

যারা ওজনাধিক্য, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ, হার্টের সমস্যা, কোলেস্টেরল বেশি কিংবা অন্যান্য জটিল রোগে ভুগছেন তারা অবশ্যই ঈদের আগে একজন পুষ্টিবিদের কাছ থেকে শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী ডায়েট ঠিক করে নেবেন। কেননা পুষ্টি চাহিদা বয়স, ওজন, উচ্চতা, লিঙ্গ এবং রোগভেদে পরিবর্তন হয়।

বেশি ক্ষুধা লাগিয়ে না খেয়ে অল্প ক্ষুধা লাগলে খান। এতে কম খাওয়া হবে। ভারি খাবার খাওয়ার আগে সালাদ, ফল ইত্যাদি কম ক্যালরির সহজ পাচ্য খাবার ও পানি খেয়ে নিন। তাহলেও কম খাওয়া হবে।

ভোজ্য আঁশ রাখতে হবে প্রতি বেলার খাবারের তালিকায়। কারণ এই আঁশ খাবার হজমে ও হজম শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। কোষ্ঠকাঠিন্য কমায়। চর্বিও জমতে বাধা দেয়।

এই আঁশ আমরা পেতে পারি রান্না বা কাঁচা শাক-সবজি, ফলমূল, সালাদ, লাল আটা, বাদাম ইত্যাদি থেকে।