গলা আর বুকের সংযোগস্থলে ‘বিউটি বোন’ বা ‘কলার বোন’য়ের ঠিক ওপরেই থাকে থাইরয়েড গ্রন্থি। এর আকৃতি অনেকটা প্রজাপতির মতো, রংটা বাদামি লাল। ওজন প্রায় ২০ গ্রাম আর রক্তনালীতে পরিপূর্ণ।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের সূত্রানুসারে, থাইরয়েড গ্রন্থিতে তৈরি হয় দুটি গুরুত্বপূর্ণ হরমোন, ‘টি ফোর’ বা ‘থাইরক্সিন’ এবং ‘টি থ্রি’। এই হরমোনগুলোকে শরীরের প্রতিটি কোষে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বে থাকে রক্তনালী।
এভাবেই এই ছোট গ্রন্থি পুরো শরীরের ওপর বড় ধরনের প্রভাব রেখে যায়। নিয়ন্ত্রণ করে হৃদস্পন্দন, শ্বাস-প্রশ্বাস, হজম, শরীরের তাপমাত্রা ইত্যাদি।
আবার শৈশবে এই হরমোন দুটি মস্তিষ্ক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
তাই এই গ্রন্থি সঠিকভাবে কার্যসম্পাদন না করলে শরীরের ভয়াবহ ক্ষতি হতে পারে। এমন এক পরিস্থিতি হল ‘হাইপোথাইরয়েডিজম’ যেখানে থাইরয়েড গ্রন্থির সক্রিয়তা কমে যায়।
স্বাস্থ্যবিষয়ক একটি ওয়েবসাইটে এই বিষয়ের ওপর প্রকাশিত প্রতিবেদন অবলম্বনে জানানো হল বিস্তারিত।
হাইপোথাইরয়েডিজম
এই রোগে থাইরয়েড গ্রন্থি পর্যাপ্ত হরমোন তৈরি করতে পারে না। ফলে শরীরের বিভিন্ন কাজের গতি মন্থর হয়ে যায়। দেখা দেয় অবিরাম ক্লান্তি, ওজন বৃদ্ধি, ঘাম কমে যাওয়া, শীত অনুভূত হয় বেশি, চুল পড়ে যাওয়া, অত্যধিক শুষ্কতা, মাসিক অনিয়মিত হয়, রক্তপাত বেড়ে যায়, খিটখিটে মেজাজ, হতাশা ইত্যাদি।
‘হাইপোথাইরয়েডিজম’ রোগটির তীব্রতা বাড়ে খুব ধীর গতিতে। ফলে রোগী কয়েক মাস কিংবা বছরেও কোনো উপসর্গ অনুভব করেন না।
আর এজন্যই সব বয়সেই নির্দিষ্ট সময় পর পর থাইরয়েড পরীক্ষা করানো উচিত।
‘হাইথাইরয়েডিজম’য়ের চিকিৎসা না করলে ক্ষতিকর কোলেস্টেরল এলডিএল’য়ের মাত্রা বেড়ে যায়, ডেকে আনে হৃদরোগ। যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদের এই রোগ হওয়ার আশঙ্কা বেশি। এমনকি এই রোগের কারণে একজন নারী হারাতে পারেন মা হওয়ার ক্ষমতা।
থাইরয়েড পরীক্ষা
বয়স ৩৫ পেরোলে চিকিৎসকের পরামর্শ মাফিক প্রতি পাঁচ বছর পর পর থাইরয়েড পরীক্ষা করানো জরুরি।
এপর্যায়ে চিকিৎসকরা প্রথমেই ‘কমপ্লিট ফিজিকাল চেক-আপ’ করবেন। বিগত জীবনের বিভিন্ন রোগ সম্পর্কে প্রশ্ন করবেন এবং রক্ত পরীক্ষা করবেন থাইরয়েডজনীত কোনো সমস্যা আছে কি-না তা জানার জন্য।
‘ফিজিকাল চেক-আপ’য়ে চিকিৎসকরা পরীক্ষা করবেন থাইরয়েডের অস্বাভাবিক স্ফিতি কিংবা আচরণ, হাত-পায়ের কোথাও ফোলা আছে কি-না। কোনো স্থানের ত্বক অন্যান্য স্থানের তুলনায় ফ্যাকাশে, শুষ্ক কিংবা শীতল কি-না।
রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যাবে রক্তে থাইরয়েড উত্তেজক হরমোন ‘টিএসএইচ’ ও থাইরয়েড নিঃসৃত হরমোন ‘টি ফোর’য়ের মাত্রা।
‘টিএসএইচ’ তৈরি হয় মস্তিষ্কের পিটুইটারি গ্রন্থিতে, যা থাইরয়েড গ্রন্থিকে হরমোন প্রস্তুত করার এবং রক্তে নিঃসরণের ইঙ্গিত দেয়।
যাদের ‘হাইপোথাইরয়েডিজম’ আছে, তাদের ‘টিএসএইচ’য়ের মাত্রা বেশি আর ‘টি ফোর’য়ের মাত্রা কম থাকে। কারণ তাদের থাইরয়েড যেহেতু পর্যাপ্ত ‘টি ফোর’ তৈরি করছে না, তাই পিটুইটারি গ্রন্থি আরও বেশি ‘টিএসএইচ’ তৈরি করে থাইরয়েড গ্রন্থিতে সক্রিয় করার চেষ্টা করতে থাকে।
চিকিৎসা ও নিয়ন্ত্রণ
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবনের মাধ্যমে সহজেই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় ‘হাইপোথাইরয়েডিজম’। এই ওষুধ হয়ত সারাজীবন চালিয়ে যেতে হতে পারে এবং তা বেশিরভাগ সময় খালি পেটে খাওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা।
প্রচুর ‘আয়রন’ ও ‘ক্যালসিয়াম’ আছে এমন খাবারে বিধিনিষেধ আসবে। কারণ এগুলো ওষুধের কার্যকারিতার পথে বাধা হতে পারে।
তবে চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি তাই ‘ফলো-আপ’ বাদ দেওয়া চলবে না। ওষুধ সেবনের সময় মানতে হবে কঠোরভাবে, আর ভালো লাগলেই ওষুধ বাদ দেওয়া যাবে না।
শরীরচর্চা, খাদ্যাভ্যাস, দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় স্বাস্থ্যকর অভ্যাসগুলো মেনে চলার গুরুত্ব আরও বাড়বে।
আরও পড়ুন