কারণটা কী? মনিকার স্বামী এদুয়ার্দো বাইরে যাওয়ার সময় কিছুতেই মাস্ক পরতে রাজি নন!
মনিকা- এদুয়ার্দো যে দেশের নাগরিক, তার নাম ব্রাজিল। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃত্যু- দুদিক দিয়েই ব্রাজিলের অবস্থান এখন বিশ্বে দ্বিতীয়। ব্রাজিলের দ্বিতীয় জনবহুল শহর রিওর কাছেই নিতেরই শহরের এক অ্যাপার্টমেন্টে তাদের তিনজনের সংসার।
বিবিসিকে তিনি বলেন, “আমার অ্যাজমার সমস্যা আছে। ফলে করোনাভাইরাসের এই মহামারীর সময় আমার ঝুঁকি অনেক বেশি। অথচ আমার স্বামী ভাবছেন, আমি অযথাই আতঙ্কিত হচ্ছি।”
এদুয়ার্দো কেন মাস্ক পরেন না? তার যুক্তি হল, বাসা থেকে বের হলে তিনি কখনোই কোনো অবদ্ধ জায়গায় যান না। সুতরাং মাস্কের প্রয়োজন কী!
কিন্তু তার ওই যুক্তি মনিকার উদ্বেগ কমাতে পারেনি। তিনি বলছেন, “সে এটা ভেবে দেখছে না যে, মাস্ক না পরে সে আমাকে আর আমাদের ছেলেকে আরও বড় ঝুঁকির মুখে ফেলে দিচ্ছে।”
মনিকা ও এদুয়ার্দোর এই কাহিনী বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। মহামারীর এই সময়ে মাস্ক নিয়ে নারী ও পুরুষের এই মতপার্থক্য অনেক দেশেই বেশ স্পষ্ট দেখা গেছে।
কেন এই পার্থক্য? বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে এর কারণ বোঝার চেষ্টা করেছে বিবিসি।
করোনাভাইরাস বিশ্বের প্রায় দেড় কোটি মানুষকে আক্রান্ত করেছে, কেড়ে নিয়েছে ৬ লাখের বেশি মানুষের প্রাণ। আর পুরুষের ক্ষেত্রে এ ভাইরাসে মৃত্যুর হার নারীদের তুলনায় অনেক বেশি।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এখন মাস্ক ব্যবহারের ওপর আগের চেয়ে অনেক বেশি জোর দিচ্ছেন, কারণ করোনাভাইরাস যে বাতাসের মাধ্যমেও ছড়াতে পারে, সে বিষয়ে জোরালো প্রমাণ আসতে শুরু করেছে সাম্প্রতিক সময়ে।
অনেক বিশেষজ্ঞ এখন বলছেন, হাঁচিকাশির মাধ্যমে বড় আকারের ড্রপলেটের মাধ্যমে যেমন করোনাভাইরাস ছড়াতে পারে, তেমনি বাতাসে ভেসে ঘরের ভেতরে বেশ কিছুদূর ছড়িয়ে পড়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাইরাল কণা থেকেও সংক্রমণ ঘটতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা শুরুর দিকে মাস্ক ব্যবহারে ততটা জোর দেয়নি। কিন্তু এখন জাতিসংঘের এ সংস্থাও বলছে, বদ্ধ জায়গায় যেখানে বেশি মানুষের সমাগম হয়, অথবা যেখানে দূরত্বের নিয়ম মেনে চলা সম্ভব না, সেখানে মাস্ক পরা দরকার।
অনেক দেশেই এখন দোকানে ও গণপরিবহনে মাস্ক পরে থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
মাস্ক পরার অভ্যাসে যদি করোনাভাইরাস ঠেকানো যায়, তাহলে পুরুষদের এত অনীহা কেন?
মিডলসেক্স ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির শিক্ষক ভ্যালেরিও ক্যাপরারো এবং ম্যাথমেটিকাল সায়েন্স রিসার্চ ইনসটিটিউটের কানাডীয় গণিতবিদ হেলেন বারসেলো সম্প্রতি এক গবেষণায় পুরুষের ওই মনস্তত্ত্ব বোঝার চেষ্টা করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের আড়াই হাজার মানুষের উপর জরিপ চালিয়ে তারা দেখেছেন, পুরুষরা যে শুধু মাস্ক পরতেই অনাগ্রহী তা নয়; তারা মনে করেন, মুখে মাস্ক পরে থাকাটা ‘লজ্জার’ এবং তা ‘দুর্বলতার চিহ্ন’।
ডা. ক্যাপরারো বলেন, যেসব দেশে মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক নয়, সেখানেই পুরুষের মধ্যে এমন ধারণা দেখা যাচ্ছে বেশি।
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের বলা হয়েছিল, সামাজিক কর্মকাণ্ডে অথবা আরেক বাড়ির মানুষের সাথে সাক্ষাতের সময় তারা মাস্ক পরতে চান কি না।
উত্তরে যারা বাড়ির বাইরে মাস্ক পরবেন বলেছেন, তাদের মধ্যে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা দ্বিগুণ।
ক্যাপরারো বলেন, “যেসব কারণে পুরুষরা মাস্কে মুখ ঢাকতে চায় না, তার মধ্যে একটি হল, তাদের ধারণা এই রোগে নারীদের চেয়ে পুরুষরা কম সংক্রমিত হবে।”
আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, হাত ধোয়ার নিয়মও ঠিক মত মেনে চলেন না পুরুষেরা। অথচ হাত ধোয়াকে এ ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানোর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি বিবেচনা করা হচ্ছে।
জরিপে যেখানে ৬৫ শতাংশ নারী নিয়মিত হাত ধোয়ার কথা বলেছেন, পুরুষদের মধ্যে মাত্র ৫২ শতাংশ নিয়মিত এই নিয়ম মেনে চলছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলের মতাদর্শের বিষয়টিও নারী বা পুরুষের মাস্ক পরা ও না পরার ক্ষেত্রে প্রভাব রাখছে।
দেখা গেছে, প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের রিপাবলিক পার্টির অনুসারীদের মধ্যে মাস্ক ব্যবহারের প্রবণতা ডেমোক্রেটিক পার্টির কর্মীদের চেয়ে কম।
গত ২৫ জুন পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, ডেমোক্রেট ভোটারদের ৭৬ শতাংশ দোকানে এবং ব্যবসায়িক কাজে সব সময় অথবা বেশিরভাগ সময় মাস্ক পরে থাকার কথা বলেছেন। রিপাবলিক পার্টির ভোটারদের ক্ষেত্রে এই হার ৫৩ শতাংশ।
আবার রাজনৈতিক ভেদরেখার ভেতরেও মাস্ক নিয়ে নারী ও পুরুষের সেই পুরনো মতপার্থক্য স্পষ্ট। কাইজার ফ্যামিলি ফাউন্ডেশনের এক জরিপ বলছে, রিপাবলিকান পার্টি ৬৮ শতাংশ নারী সমর্থক যেখানে ঘরের বাইরে গেলে মাস্ক পরেন, সেখানে পুরুষদের মধ্যে সেই হার ৪৯ শতাংশ।
মাস্ক পরা নিয়ে নারী ও পুরুষের মধ্যে এই বিপরীত আচরণে মোটেও অবাক নন ইউনিভার্সিটি অফ কোপেনহেগেনের অধ্যাপক ক্রিসটিনা গ্রেভার্ট।
বড় এক গবেষণা থেকে উদ্ধৃত করে বিবিসিকে তিনি বলেছেন, ঝুঁকির প্রশ্নে নারী ও পুরুষের আচরণে সব সময়ই ভিন্নতা থাকে।
২০০৯ সালে মেক্সিকো শহরে সোয়াইন ফ্লুর প্রাদুর্ভাব কেড়ে নিয়েছিল ৪০০ মানুষের প্রাণ । সে সময় গণপরিবহনে চলাচলের ক্ষেত্রে মানুষের আচরণ নিয়ে একটি গবেষণা হয়। সেখানেও দেখা যায়, মেট্রো রেলে যাতায়াতের সময় পুরুষদের চেয়ে নারীরা মুখে মাস্ক পড়ছেন বেশি।
এমনকি ২০০২ ও ২০০৩ সালে সার্স মহামারীর সময় হংকংয়েও নারীদের মধ্যে হাত ধোয়া ও মাস্ক পরার মত সুরক্ষা বিধি মেনে চলার প্রবণতা বেশি দেখা গিয়েছিল।
বিবিসির প্রতিবেদন বলছে, অ্যাকাডেমিক গবেষণার সংখ্যার বাইরে বাস্তব জীবনের ঘটনাগুলোতেও নারীদের তুলনায় পুরুষদের ‘কম সাবধানী’ ভূমিকায় দেখা যায়।
গাড়ির বীমা যেসব প্রতিষ্ঠান করে, নারীদের ক্ষেত্রে তারা সবসময়ই কম প্রিমিয়াম ধরে, কারণ বিশ্বে যত সড়ক দুর্ঘটনা হয়, তার বেশির ভাগই ঘটান পুরুষরা।
অবশ্য অনেকেই যুক্তি দেন, বিশ্বে পুরুষ চালকের সংখ্যা নারীদের চেয়ে বেশি, তাই দুর্ঘটনার পরিসংখ্যানে তারা বেশি আসবে, সেটাই স্বাভাবিক।
লন্ডনের গবেষক ভ্যালেরিও ক্যাপরারো নিজেও স্বীকার করেছেন, মাস্ক পরার ক্ষেত্রে তিনি কিছুটা উদাসীন।
“আমি মাস্ক পরা শুরু করেছি মাসখানেক আগে, যখন ইতালিতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। ওখানে মাস্ক পরাটা বাধ্যতামূলক।”
তবে যখন মাস্ক পরতেন না, তখনও যথেষ্ট সতর্ক থাকতেন এবং সামাজিক দূরত্বে নিয়ম মেনে চলতেন জানিয়ে ক্যাপরারো বলেন, “আমি যে মাস্ক পরি না, সেটা নিজের কাছে জায়েজ করা সহজ হত ওই সতর্কতা মেনে চলতাম বলে।”
এই গবেষকের এখন ধারণা, সরকারিভাবে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করে দিলে আরো বেশি সংখ্যক পুরুষ বিষয়টি মেনে চলতে উৎসাহী হবে।
“গবেষণায় দেখা গেছে, যেখানে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক, সেখানে নারী ও পুরুষের এই বিভেদ অনেকটাই ঘুচে যায়।”
তবে পুরুষদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে তাদের জন্য আরো বেশি প্রচার চালানো হলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে মনে করছেন ক্রিসটিন গ্রেভার্ট।
“অতি আত্মবিশ্বাসই যদি এক্ষেত্রে সমস্যার মূল কারণ হয়ে থাকে, তাহলে তাদের সচেতন করতে পরিসংখ্যান দেখাতে হবে। তাদের জানাতে হবে যে নারীদের তুলনায় পুরুষরাই বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে।”
তবে জায়গামত চাপ দিলে যে কাজ হতে পারে, তারও প্রমাণ আছে। মনিকা ও এদুয়ার্দোর ক্ষেত্রেই তেমনটি ঘটেছে।
বাড়ি ছাড়ার ঘোষণা দেওয়ার পর স্বামীর আচরণে বিশাল পরিবর্তন দেখতে পান মনিকা। তার জন্য আনন্দের বিষয় হল, আজকাল মাস্ক পরছেন এদুয়ার্দো।
অবশ্য এদুয়ার্দোর আচরণ বদলালেও মন বদলেছে বলে বিশ্বাস করতে পারছেন মনিকা।
তার ভাষায়, “আমার এখনও মনে হয়, আমার স্বামীর ধারণা, তার মত সুস্থ একজন পুরুষ ভাইরাসে কাবু হবে না।
“তবে এখন সে যথেষ্ট সচেতন যে তার সঠিক পদক্ষেপ পুরো পরিবারকেই সুরক্ষা দিতে পারে।”