অনলাইনে কোরবানির পশু

করোনাভাইরাসের প্রকোপে সচেতন ক্রেতারা বেছে নিচ্ছেন অনলাইন হাট।

মামুনুর রশীদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 July 2020, 06:05 PM
Updated : 26 July 2020, 01:29 PM

অনলাইনে কোরবানির পশু কেনা নতুন কোনো ঘটনা নয়। বিগত কয়েক বছর ধরেই রাজধানীবাসী কোরবানির পশু কেনার ঝক্কি কমাতে অনেক প্রতিষ্ঠান এই সুযোগ দিচ্ছে, ক্রেতাদের সাড়া ছিল স্বভাবতই কম।

ঘটা করে হাটে গিয়ে হইহুল্লোড় করে কোরবানি পশু কেনা, বাহারি রংয়ের মালা পরিয়ে হাঁটিয়ে বাসায় আনা, ফেরার পথে শ’খানেক মানুষের ‘কত পড়লো ভাই?’, এমন প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ইত্যাদি ঘটনা ঈদের আমেজেরই অংশ।

কত মানুষ তো কয়েক দফায় হাটে যান, বিভিন্ন এলাকায় বনেদি ঘরগুলোর মাঝে চলে বড় পশু কেনার প্রতিযোগিতা, পাড়ার লোক তা দেখতে ভীড় জমায়। আবার ঘরে ফেরার পথে অনেক পশু ছুটে গিয়ে হুলুস্থুল কাণ্ড বাঁধায়। এলাকায় হারানো পশুর বর্ণনা দিয়ে মাইকিং হয়।

তবে করোনাভাইরাসের তাণ্ডবে এবারের কোরবানির ঈদের এমন অনেক খুশির আমেজ চোখে পড়বেনা গত কোনো ঈদের মতো। তাই বলে কোরবানি যে বন্ধ থাকবে সেটাও মেনে নেওয়া কষ্টের, সেটা ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে হোক অথবা ব্যক্তিগত মর্যাদা। আর তারই প্রেক্ষিতে এবারের ঈদুল আজহায় জমে উঠেছে অনলাইনে কোরবানি পশু কেনাবেচার সুযোগ।

অনলাইনে কোরবানির গরু কিনেছেন ধানমন্ডির বাসিন্দা সাফিউল আলম। বেসরকারি এক ব্যাংকের এই কর্মী ভাড়া বাড়িতে থাকেন চার সদস্যের পরিবার নিয়ে। বছরের যে কোনো এক ঈদে পুরো পরিবার নিয়ে গ্রামের বাড়িতে যান বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা হয় কোরবানির ঈদে। তবে এবার তা হচ্ছে না, চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আসা তার বাবা-মাকেও আর ফিরতে দেননি গ্রামে।

কোরবানি গরু কেনার স্মৃতি আওড়ে বলেন, “গ্রামে গিয়ে বাবা আর বড় ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে হাটে গিয়ে গরু ও খাসি কিনতাম প্রায় সববছরই। ছোট ছেলেও আবদার করত, মাঝে মাঝে তাকেও সঙ্গে নিতাম। গরু নিয়ে ফেরার পথে দুই ছেলের আনন্দ দেখার মতো। বড় ছেলেটাকে খাসির দড়ি ধরতে না দিলে প্রচণ্ড অভিমান করে। বাসায় আনার পর বাবা তার দুই নাতিকে নিয়ে গরু ও ছাগল গোসল করান, মালা পরান। আসলে এসব গল্পের কোনো শেষ নেই। তবে এবার লকডাউনের প্রভাবে এমনিতেই ছেলে দুটো মনমরা হয়ে গেছে অনেকটাই। সৃষ্টিকর্তার কৃপায় বড় কোনো অসুখ আমাদের পরিবারে হানা দেয়নি।”

“ফেইসবুকেই জানতে পারি অনলাইনে গরু কেনার ব্যবস্থা সম্পর্কে। কয়েকটি পেইজ ঘুরে প্রায় ২০ থেকে ২৫টা গরুর ছবি-ভিডিও দেখি, বাবাকেও দেখাই। তাদের মাধ্যমে দুটি খামারে যাই গরু দেখার উদ্দেশ্যে। দ্বিতীয়বারে মোট চারটি গরু থেকে একটি পছন্দ করি, দাম পড়ে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। বাবার জোরালো দাবি, দাম কমপক্ষে ১৫ হাজার বেশি পড়েছে।”

“খাবার টেবিলে বসে প্রায়শই বলেন, কি যে খাওয়ায় এরা? কি পরিবেশে যে রাখে? মাংস কতটুকু হয়? খোদাই জানে ঠকালো কি-না? সন্দেহ যে আমারও একেবারে নেই তা নয়, দামটা একটু বেশি পড়েছে সেটাও স্বীকার করি। তবে ঢাকায় গরু রাখার ঝামেলা থেকে মুক্তি পাচ্ছি, তারাই ঈদের একদিন আগে বাসায় পৌঁছে দেবেন। আমরা গরুর ওজন করেছি খামারেই, ছবি-ভিডিও তো আছেই, সঙ্গে বিক্রিয় রশিদ ও অন্যান্য কাগজপত্র তো আছেই। সবমিলিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনার আমি সন্তুষ্ট।”

তবে সবাই সন্তুষ্ট নন। ওই ফেইসবুকেই অনলাইনে গরু কেনা নিয়ে নেতিবাচক অভিজ্ঞতার কমতি নেই। তবে ভালোমন্দ তো সবখানেই থাকে। 

কোথায় কিনবেন

অনলাইন কাউ হাট টোয়েন্টিফোর সেভেন

এ বছরের ২৪ জুন থেকে কাজ শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

মালিক পক্ষের হয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের সঙ্গে কথা বলেন তাদেরই একজন উচ্ছ্বাস বসুনিয়া।

তিনি বলেন, “করোনাভাইরাসের সঙ্কটের মাঝে হাটে গিয়ে গরু কেনার স্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়ানোর ‍সুযোগ করে দেওয়াই ছিল আমাদের মূল অনুপ্রেরণা। এছাড়াও দেশের গবাদিপশু খামারিদের কথাও আমাদের ভাবনায় ছিল। কারণ অনলাইনে গবাদিপশু বিক্রি করার পদ্ধতিতে তাদের অনেকেরই ধারণার অভাব আছে। সবমিলিয়ে সরাসরি খামারির কাছ থেকে ক্রেতার কাছে কোরবানির পশু পৌঁছে দিতে এই উদ্যোগ।”

“আমাদের সঙ্গে এমন অনেকেই বিপণনের কাজ করছেন যারা মহামারীর সঙ্কটের কারণে চাকরি হারিয়েছেন। এই উদ্যোগের মাধ্যমে আমাদের সবারই সামান্য উপার্জনের সুযোগ হচ্ছে।”

তিনি আরও বলেন, “দেশি গরুর পাশাপাশি ফ্রিজিয়ান, নেপালি, শাহিওয়াল, ব্রাম্মী, শংকর ইত্যাদি বিভিন্ন জাতের গরু আছে আমাদের আওতায়। চাহিদার দিক থেকে দেশি গরুর চাহিদা বরাবরই বেশি। এরপরেই আমাদের হিসেবে স্থান পেয়েছে শাহীওয়াল ও ব্রাম্মী গরু।”

২০০ কেজি থেকে ৯০০ কেজি ওজনের গরু পাওয়া যাবে এখানে যা থেকে খামারিদের হিসেবে ১০০ থেকে ৬০০ কেজি মাংস পাওয়ার দাবি করেন তারা।

ছোট গরুর দাম ৬০ হাজার থেকে এক লাখ টাকার মধ্যে। মাঝারি গরু কিনতে গুনতে হবে এক লাখ থেকে দুই লাখ টাকা। বড় গরুর জন্য খরচ হবে দুই লাখের বেশি। সংগ্রহের সবচাইতে বড় ও দামি গরুটির ওজন ৯৮৫ কেজি, যার দাম পাঁচ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। তবে ছোট গরুর চাহিদা খুব বেশি। এমনকি বড় গরু কেনার মতো সামর্থবান ক্রেতারাও চাচ্ছেন দুটি ছোট গরু কিনতে।

গরু কেনার প্রক্রিয়া নিয়ে উচ্ছ্বাস বলেন, “ক্রেতাকে গরুর ছবি ও ভিডিও দেওয়া হয় আলোচনার প্রাথমিক পর্যায়েই। চাইলে ক্রেতা স্বপরিবারে খামারে এসে গরু দেখে যেতে পারেন। সঙ্গে জীবন্ত গরুর ওজনও নিতে পারবেন। পছন্দ হলে এখন বুকিং দিয়ে রেখে ঈদের আগের দিন ডেলিভারি নিতে পারেন, এজন্য বাড়তি কোনো খরচ করতে হবে না। বাসায় ডেলিভারির জন্য আমরা কোনো চার্জ নিচ্ছি না। আপাতত ঢাকা, নারায়নগঞ্জ ও গাজীপুরে ডেলিভারি দিচ্ছি। আর ২২ জুলাইয়ের মধ্যে যারা বুকিং দেবেন তাদের জন্য থাকছে পাঁচ হাজার টাকা মূল্যছাড়।”

পুরো প্রক্রিয়া পরিচালিত হচ্ছে  ফেইসবুক পেইজের মাধ্যমে।

সুফলা

মুরগির খামার দিয়ে যাত্রা শুরু হয় সুফলার। রাজধানির দুই কর্মজীজী, শহরের কোলাহলপূর্ণ জীবন ছেড়ে শুধুই খামার করার ভালোবাসার টানে গ্রামে থিতু হয়েছেন। তাদের একজন ইফতেখার শিশির কথা বলেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের সঙ্গে।

তিনি বলেন, “খামারের প্রতি প্রচণ্ডা ভালোবাসা আছে ঠিক। তবে বাইরে থেকে দেখে হয়ত সহজ মনে হবে। তবে একাজেও শেখার আছে অনেক কিছু। যে কারণে আমাদের কার্যক্রম কাছের মানুষগুলোর মাঝে সীমাবদ্ধ রেখেছি।”

“আমাদের খামার মুরগি কেন্দ্রিক হলেও করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণেই কোরবানির গরু নিয়ে চিন্তা শুরু হয়। গ্রামের গেরস্ত পরিবারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে আমরা কাজটি করছি।”

“করোনাভাইরাসের প্রকোপে অনেক খামারি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তাদের গবাদি পশু বিক্রির সুযোগ কমেছে। আবার ক্রেতাদেরও মনের মতো কোরবানির পশু বেছে নেওয়ারও সুযোগ কমেছে। এই দুই শ্রেণির মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি কাজটি করছি আমরা।”

গ্রামের গেরস্ত বাড়িতে পোষা গরুকে শহরের ক্রেতার কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন তারা।

শিশির বলেন, “আমাদের নিজস্ব যোগাযোগ ও ফেইসবুক পেইজের মাধ্যমে এই কাজ করছি। এবছর প্রায় ১৫টি গরু বিক্রি করেছি আমরা। দাম ছিল ৬০ হাজার টাকা থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত। মাংস কেটে ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেওয়া নিয়েও চেষ্টা চলছে, তবে এবছর বড় পরিসরে তা করা সম্ভব হচ্ছে না।”

বেঙ্গল মিট

টানা ষষ্ঠবারের মতো অনলাইন কোরবানির হাটে অংশগ্রহণ করছে প্রতিষ্ঠানটি। এই কাজের জন্য তাদের সতন্ত্র ওয়েবসাইটে সংগ্রহে থাকা সবগুলো গরুরই ছবি আছে। দাম, গরুর জাত, বয়স, লিঙ্গ, খাবারের ধরন ইত্যাদির ‘ফিল্টার’ করে গরু খোঁজা যায়।

এছাড়া নির্দিষ্ট একটি গরুর পাতায় গিয়ে তার রং, জাত, বয়স, ওজন, কতদিন ধরে খাওয়ানো হচ্ছে ও কী খাচ্ছে, উচ্চতা ইত্যাদি বিভিন্ন তথ্য জানতে পারবেন। বর্তমানে ৬৮ হাজার টাকা থেকে দুই লাখ ৬০ হাজার টাকা দামের গরু আছে তাদের ওয়েবসাইটে।

অনলাইন পেমেন্ট সুবিধা থাকছে ফলে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকেই অর্ডার করা যায়। ক্রেতারা চাইলে শুধু আস্ত গরু না নিয়ে একেবারে মাংস করে নিতে পারবেন, পৌঁছে যাবে ক্রেতার ঘরে। তবে শুধু ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে এই সুবিধা নেওয়া যাবে। ঢাকার কেউ এই সুবিধা নিয়ে ঈদের দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ দিন ডেলিভারি পাবেন, মাংস পৌঁছানো হবে ‘চিলড’ অবস্থায়। এরপরে ডেলিভারি নিলে মাংস পৌঁছানো হবে ‘ফ্রোজেন’ অবস্থায়। চট্টগ্রাম আর সিলেটের ক্রেতারা ডেলিভারি পাবেন ঈদের ষষ্ঠ দিন ‘ফ্রোজেন’ অবস্থায়। ডেলিভারির খরচ ১৬ হাজার টাকা থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত।

সরকারি উদ্যোগ

করোনাভাইরাস মহামারী কথা মাথায় রেখে খামারি ও ক্রেতাদের মধ্যে কোরবানির পশু কেনাবেচার জন্য ডিজিটাল হাট নিয়ে এসেছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ।

বিভাগের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, এই ডিজিটাল হাটের জন্য সারাদেশ থেকে গরু-ছাগলের চাষী, খামারি ও পশু ব্যবসায়ীদের নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

https://foodfornation.gov.bd/qurbani2020/ ওয়েবসাইটে গিয়ে বিনামূল্যে নিবন্ধন করার সুযোগ পাবেন ব্যবসায়ীরা।

নিবন্ধনের পর নিজস্ব প্যানেল থেকে পশুর ছবি, ভিডিও ও অন্যান্য তথ্য আপলোড করতে হবে। এসব ছবি ও তথ্য ওয়েবসাইট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকার প্রচার করবে। এর ফলে ক্রেতারা সহজেই কোরবানির জন্য প্রয়োজনীয় পশু পছন্দের সুযোগ পাবেন এবং বিক্রেতার সঙ্গে যোগাযোগ করে ডেলিভারি নিতে পারবেন। গরু চাষী, খামারী বা ব্যাপারীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করার সুযোগও থাকবে। এরপর নির্দিষ্ট স্থান থেকে অথবা হোম ডেলিভারির ভিত্তিতে টাকার বিনিময়ে পশু সংগ্রহ করতে পারবেন ক্রেতারা।

এগুলো ছাড়াও সাদেক এগ্রো, সামুরাই ক্যাটেল ফার্ম, মেঘডুবি এগ্রো, গ্রাস ক্যাটেল ইত্যাদিসহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর মাধ্যমে অনলাইনে কোরবানির পশু বিক্রির দিকে ঝুঁকছেন।

দেশের পরিচিত ই-কমার্স সাইটগুলোও থেমে নেই। প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছেন তাদের মতো করে।

অনলাইনে কোরবানির পশু কেনার ক্ষেত্রে পশু যাচাই-বাছাই, দামের হেরফের ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিতর্ক থাকবেই। অনেকেই এতকিছুর ঝক্কিতে না গিয়ে প্রতিবছরের মতো হাটে যাওয়াকেই হয়ত বেছে নেবেন। যে পথেই যান না কেনো করোনাভাইরাসের কথা ভুলে যাওয়া চলবে না। তাই সবরকম সুরক্ষা নিয়ে হাটে যাওয়া নিশ্চিত করতে হবে।