মহামারীর পর অন্যরকম বিশ্বের পূর্বাভাস টেলিনরের

কোভিড-১৯ মহামারী ঠেকানোর চেষ্টায় নানা বিধিনিষেধে বদলে গিয়েছিল বিশ্ব, এখন সেসব তুলে স্বাভাবিক জনজীবনে ফেরার চেষ্টা চললেও টেলিনর বলছে, আগের অবস্থায় আর ফিরে যাওয়া হবে না।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 July 2020, 03:07 PM
Updated : 1 July 2020, 03:07 PM

গ্রামীণফোনের মূল কোম্পানি টেলিনরের এক গবেষণায় তা উঠে এসেছে বলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।

যেভাবে শহর, প্রতিষ্ঠান ও সমাজ পরিচালনা করা হয়, তাতে ব্যাপক পরিবর্তনের পূর্বাভাস দিয়ে টেলিনর বলেছে, ‘পেন্ডুলামের কাঁটা এখন পরিবর্তনের দিকে’।

টেলিনর রিসার্চের ভাইস প্রসিডেন্ট গর্ম আন্দ্রিয়াস গিরননেভেত বলেন, “এই মহামারি আমাদের দেখিয়েছে, প্রয়োজনই সকল উদ্ভাবনের উৎস।

“এটা স্পষ্ট যে, আমরা যেভাবে আমাদের শহর, প্রতিষ্ঠান ও সমাজ পরিচালনা করি সেখানে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। পেন্ডুলামের কাঁটা এখন পরিবর্তনের দিকে।”

গত ডিসেম্বরে চীনের উহানের প্রাদুর্ভাব ঘটার মাসখানেকের মধ্যে নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ে নতুন করোনাভাইরাস। মহামারী রূপ নিয়ে বিশ্বের কোটি মানুষকে আক্রান্ত করার পাশাপাশি ৫ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যুর কারণও হয়েছে এই ভাইরাস।

কোভিড-১৯ রোগটি ছোঁয়াচে হওয়ায় সংক্রমণ এড়াতে গত মার্চে বিভিন্ন দেশ লকডাউনে যাওয়ায় ঘরবন্দি হয়ে পড়ে বিশ্বের প্রায় অর্ধেক মানুষ।

মহামারী চলার মধ্যেও অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে লকডাউন তুললেও নানা বিধিনিষেধের মধ্যেই চলতে হচ্ছে মানুষকে।

মহামারী পরবর্তী বিশ্ব কেমন হতে পারে, তা নিয়ে টেলিনরের গবেষক দল তিনটি পূর্বাভাস দিয়েছে, যা নতুন আকার দেবে বিশ্বকে। 

পূর্বাভাস ১: নতুন অবকাঠামো নতুনভাবে কাজ

যারা এতদিন অফিসে বসে কাজ করতেন, এই বৈশ্বিক মহামারীর কারণে তারা বাসা থেকেই কাজ করছেন। এই বিষয়টি মানুষের ভাবনায় এটাই আনছে যে প্রথাগত অফিস অতোটা প্রয়োজনীয়তা নয়।

অনেকেই দূরবর্তী স্থান থেকে কাজ করতে নিজেদের মানিয়ে নিতে শুরু করেছেন। হয় বাড়ি থেকে কিংবা কাজের পরিবেশ বজায় রেখে বাড়ির নিকটবর্তী দূরত্ব থেকে কাজ করছেন। এ পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করছে বৈশ্বিক মহামারী।

বাড়ি কিংবা নিরপেক্ষ কর্মপরিবেশ থেকে কাজ করার ক্ষেত্রে কর্মীদের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সরকারও আরও বেশি ডিজিটাল এবং তথ্য যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নয়নের মাধ্যমে শহরগুলোকে কীভাবে সংগঠিত করা যায়, তা নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু করবে।

এক্ষেত্রে নতুন কাজের ক্ষেত্র কর্মীদের শহরের নানা প্রান্তে এবং আবাসিক এলাকার কাছাকাছি থাকতে সহায়তা করবে, যা যাতায়াতের সময় বাঁচাবে। যাতায়াতের পরিমাণ কমলে সময় বাঁচবে এবং এর ফলে রাস্তায় গাড়িও কমে যাবে, যা দূষণের পরিমাণ কমাতে, বায়ু ও জনস্বাস্থ্যের মান উন্নয়নে এবং উৎপাদনশীলতা ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে।

সর্বোপরি, বৈশ্বিক মহামারী পরবর্তী সময়ে শহরগুলোতে প্রথাগত অফিস উপস্থিতি কম দেখা যাবে এর বিপরীতে নতুন কাজের ক্ষেত্র বৃদ্ধি পাবে। ফলে, শহর হবে পরিবেশবান্ধব এবং পথচারীদের চলাচলে সহায়ক।

পূর্বাভাস ২: নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা

লকডাউনের প্রভাব গিয়ে পড়েছে অর্থনীতির ওপর। ইতোমধ্যেই কোভিডের কারণে চাকরির বাজার সঙ্কুচিত হলেও উদ্ভূত চাহিদা এবং অভিবাসন সম্পর্কিত নতুন সীমাবদ্ধতার কারণে নতুন ধরনের চাকরির সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে।

চাকরি হারানো কর্মী ও নতুন মানবসম্পদের চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে  প্রথাগত পদ্ধতিতে  নিয়োগ বেশ দীর্ঘসময় নেবে এবং এক্ষেত্রে দক্ষতারও যুগোপযোগী পরিবর্তন প্রয়োজন। এক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) আরও কার্যকরী উপায়ে কর্মী নিয়োগের বিষয়ের ক্ষেত্রে রূপান্তর ঘটাবে।

নিয়োগকর্তা ও সম্ভাব্য প্রার্থীদের তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করে অ্যালগরিদম স্বয়ংক্রিয়ভাবে যাচাই-বাছাই করে অনুপযুক্ত প্রার্থীকে বাদ দেবে এবং উপযুক্ত প্রার্থীকে নিয়োগকর্তার সঙ্গে সংযুক্ত করবে। এআই’র দ্রুত ও নির্ভুল প্রক্রিয়ায় শুধু চাকরি প্রত্যাশী ও নিয়োগকর্তার অর্থ ও সময়ই বাঁচাবে না, পাশাপাশি সঠিক কর্মী ও নিয়োগকর্তার যোগাযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানে উপযুক্ত কর্মী হারানো সম্ভাবনা কমিয়ে আনবে। 

এআই কর্মীদের হালনাগাদ থাকতে সাহায্য করবে এবং ভবিষ্যৎ ও পরিবর্তনশীল চাকরির বাজারের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করতে গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতাগুলো অর্জনের জন্য প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা চিহ্নিত করবে।

ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা এবং তারা কীভাবে নিজেদের উপযুক্ত করে তুলতে পারবে এ বিষয়ের ধারণা তরুণ ও কর্মহীনদের নিয়োগকর্তাদের জন্য আকর্ষণীয় প্রার্থী হিসেবে উপস্থাপন করবে।

সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে মিরপুরে একটি বুটিকের দোকানের সামনে সাদা রং দিয়ে চিহ্ন এঁকে দেওয়া হয়েছে। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

পূর্বাভাস ৩: সহায়তা করবে মানুষের গতিবিধির তথ্য

সংক্রামক রোগ প্রসারের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষেত্রে ডাটা ক্রমান্বয়েই গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হয়ে উঠছে।

হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউয়ের প্রকাশিত নিবন্ধে দেখা গেছে, বিশ্বজুড়েই বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে নরওয়ে ও ডেনমার্কে মহামারির বিস্তার রোধে মডেল তৈরি, ভবিষ্যদ্বাণী করা এবং পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণে টেলিনর ও স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের অংশীদারিত্ব দেখায় যে, জরুরি জনস্বাস্থ্যের পরিস্থিতিতে দায়িত্বশীল উপায়ে এবং বেনামে টেলিকমের ডাটা ব্যবহার করা হতে পারে।

এর আগে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানে ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়া বিস্তারের পূর্বাভাস নিয়ে টেলিনরের গবেষণা প্রমাণ করে যে, অজ্ঞাতভাবে সংগ্রহ করা নেটওয়ার্কের তথ্য রোগ বিস্তার মডেলের নির্ভুল হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলে। পাশাপাশি, সরকার ও স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষকে প্রতিরোধ পদক্ষেপ গ্রহণে এবং ত্রাণ প্রচেষ্টা জোরদারে লক্ষ্য নির্ধারণে সহায়তা করে।

এক্ষেত্রে, যারা সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারি নিয়ে চিন্তিত তাদের নিশ্চিত করা হবে যে, অবস্থান গত তথ্য শুধু মানুষের গতিবিধি সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণা দেয় এবং দলীয়ভাবে এ তথ্য সংগ্রহ করা হয়।

গতিবিধি বিশ্লেষণ রোগ পূর্বাভাসের চেয়েও বেশি তথ্য প্রদানের সম্ভাবনা রয়েছে। এ তথ্য স্মার্ট সিটি পরিকল্পনা, পরিবেশগত বিশ্লেষণে সহায়তা সহ শিল্পখাত যেমন ভ্রমণ খাতের প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা করতে পারে। এক্ষেত্রে, সম্ভাবনা অসীম।

গর্ম আন্দ্রিয়াস গিরননেভেত বলেন, “কোভিড-১৯ এর বৈশ্বিক মহামারী আমাদের সবাইকে প্রচলিত ধারণার বাইরে ভাবতে সহায়তা করছে, পাশাপাশি আমাদের কাজ এবং আমরা গ্রাহকদের যে সেবা দিই ও সমাজে যে ভূমিকা রাখি সেক্ষেত্রে পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করছে।”

তিনি বলেন, “আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক আচরণে পরিবর্তন আসবে; তাই, সরকার ও নেতৃবৃন্দের জন্য এখনই সময় নতুন করে ভাববার।

“যেহেতু, আমরা করোনাভাইরাস পরবর্তী ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, এক্ষেত্রে মূল্যায়ন করতে হবে কী বন্ধ করা উচিৎ, কী শুরু করা উচিৎ এবং কোন বিষয়গুলোতে জোর দিতে হবে।”