করোনাভাইরাস: বর্তমান প্রেক্ষাপটে সামাজিকতা

মানুষ সামাজিক জীব। তবে করোনাভাইরাসের ছোঁবলে থমকে গেছে যেন সেই সামাজিকতা।

লাইফস্টাইল ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 June 2020, 07:08 AM
Updated : 3 June 2020, 07:08 AM

বন্ধুর সঙ্গে কাঁধে হাত রেখে হাঁটা, আড্ডার মাঝে অট্টহাসি, বহুদিন পরে প্রিয় কোনো মানুষের সঙ্গে দেখা হলে তাকে বুকে টেনে নেওয়া, সহকর্মীর সঙ্গে হাত মেলানো এসবই যেন এখন আতঙ্ক।

বন্ধু তো বন্ধুই, লাখো মানুষ আজ নিজের পরিবার থেকেও বিচ্ছিন্ন।

মূদ্রার এপিঠ-ওপিঠের মতো সামাজিক দূরত্বের ক্ষেত্রেও মানুষের মাঝে ভিন্নতা আছে। কিছু মানুষ সুযোগ থাকার পরও নিরাপদ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার সর্বাত্বক চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

আবার তার আশপাশেই কিছু মানুষ ঝুঁকি নিয়েই আড্ডায় মেতে উঠছেন ঘরে কিংবা বাইরে।

তবে এভাবে আর কতদিন? এই মহামারী শেষ হওয়ার ক্ষীণ আশাও যখন নেই, তখন তাকে সঙ্গী করেই সামাজিক জীবনকে নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে হচ্ছে।

এজন্য জানতে হবে নিরাপদ দূরত্বে থেকেও কীভাবে সামাজিকতা রক্ষা করা যায়, পারস্পারিক সৌহার্দ বজার রাখা যায়।

যুক্তরাজ্যে এমন কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ইংল্যান্ডে সর্বোচ্চ ছয়জন মানুষের দল একত্রিত হতে পারবেন পরস্পর থেকে ছয় ফিট বা দুই মিটার দূরত্ব বজায় রেখে। একই নিয়ম উত্তর আয়ারল্যান্ডের জন্য প্রযোজ্য। স্কটল্যান্ডে দুই পরিবারের সর্বোচ্চ আটজন মানুষ ঘরের বাইরে একত্রিত হতে পারবেন একই পরিমাণ দূরত্ব বজায় রেখে। ওয়েলস’য়েও একই নিয়ম।

কীভাবে নিরাপদে একাধিক মানুষ একত্রিত হতে পারেন- এবিষয়ে জানার জন্য আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা বিবিসি ব্রিটিশ চিকিৎসক এবং টেলিভিশন উপস্থাপক ডা. জ্যান্ড ভ্যান টুলিকেনের শরণাপন্ন হয়।

সেই প্রতিবেদন অবলম্বনে জানানো হল বিস্তারিত।

কাকে দাওয়াত দেবেন?

করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি মানুষ ভেদে ভিন্ন। তাই সামাজিক সাক্ষাতের জন্য কাকে ডাকবেন এবং তাতে তার ঝুঁকি কতটা প্রভাবিত হয় সেটা আগেই ভেবে নিতে হবে। একজন বয়স্ক এবং স্থূলকায় ব্যক্তিকে গল্প করার জন্য ঘরে ডেকে আনা উভয়কেই যতটা ঝুঁকিতে ফেলছে তার তুলনায় এক তরুণ দম্পতিকে দাওয়াত করার ঝুঁকি অনেকাংশেই ভিন্ন। আবার একবার ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে এমন ব্যক্তির মুখোমুখি হওয়ার ঝুঁকি পুরোপুরি ভিন্ন।

বয়স্ক এবং স্থূলকায় ব্যক্তিকে দাওয়াত করার আগে তাকে এই ভাইরাস নিয়ে সতর্ক করতে হবে আপনাকেই। তার সুরক্ষার কথা ভেবে হলেও আদৌ দাওয়াত দেবেন কি-না সেটা ভাবতে হবে। আর আপনিই যদি সেই দাওয়াতপ্রাপ্ত ব্যক্তি হন এবং নিজে সুরক্ষিত থাকতে চান হবে দাওয়াত ভদ্রভাবে ফিরিয়ে দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

অতিথিকে কোথায় বসাবেন?

ঘরে অতিথি আসার কারণে দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে তাদেরকে বসতে দেওয়া নিয়ে। বাইরে থেকে আসা অতিথিকে কী আপনার সোফায় বসতে দেবেন? ব্যবহার করতে দেবেন টেলিভিশনের ‘রিমোট’? এতে ঘরেই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া তো যায়না।

যারা গ্রামে থাকেন তাদের জন্য ব্যাপারটা সহজ করে দিতে পারে উঠান। শহরের যাদের এমন বাড়ি সামনে খোলা জায়গা আছে তারাও একই সুবিধা ভোগ করতে পারবেন।

তবে ফ্ল্যাট বাসায় সেই সুযোগ নেই, অতিথিকে বসার ঘরে, এমনকি শোবার ঘরেও বসতে দিতে হতে পারে। তাদের আপ্যায়ন হয়ত আপনার ‘ডাইনিং টেবিল’য়েই হবে, যা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বাড়াবে কয়েকগুন। বাসায় ছাদে যাওয়ার সুযোগ থাকলে কিছুটা ঝুঁকি কমবে, তবে সেটাও সবক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

বাইরের অতিথিকে ঘরে আনতেই যদি হয় তবে তাদেরকে পুরোটা সময় মাস্ক পরিধান করতেই হবে। ঘরের প্রবেশের পর প্রথম কাজ হবে হাত ধোয়া। তবে এই পরিস্থিতিতে আমন্ত্রণকারীর চাইতে অতিথিরই বেশি আন্তরিক হওয়া জরুরি। সম্ভব হলে সঙ্গে করে পরিষ্কার পোশাক নিয়ে যান এবং আমন্ত্রণকারীর সুরক্ষার স্বার্থে সেখানেই গিয়েই গোসল করে কিংবা অন্তত হাত ধুয়ে বাইরে পরা পোশাক পাল্টে পরিষ্কার কাপড় পরে নিন। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া ওই বাসার জিনিসপত্র স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকুন।

সামাজিক দূরত্ব

পরস্পর থেকে দুই মিটার বা ছয় ফিট দূরত্ব রাখাই হল সামাজিক দূরত্বের নুন্যতম চাহিদা। ঘরের বাইরের কারও সঙ্গে আলাপ, রাস্তায় হাঁটাচলা, কর্মক্ষেত্র সবক্ষেত্রেই তা বজায় রাখার জন্য প্রতিটি মানুষের এই দূরত্বের আন্দাজ থাকা উচিত। পাশাপাশি গল্পের মাঝে দূরত্বের কথা ভুলে গেলেও চলবে না।

আড্ডার হাসির তালে হোক কিংবা কোনো কারণে সান্তনা দিতে গিয়ে মানুষ পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে, পিঠ চাপড়ে দেয়, মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় ইত্যাদি অনেককিছুই প্রচলিত অঙ্গভঙ্গি আছে যার সবকিছু থেকেই পরস্পরকে বিরত থাকতে হবে।

খাবার ও বাসনপত্র

দাওয়াত খাওয়ার জন্য নিজস্ব বাসনপত্র নিয়ে যাওয়ার ভাবনাটা অনেকের ক্ষেত্রেই হয়ত বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে। তবে তা করতে পারলে অবশ্যই ভালো। তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল আপনি কতটুকু ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত এবং তার কারণে অন্যের উপর কী প্রভাব পড়তে পারে?

আপনি হয়ত ভাবছেন, “আমি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, বয়স কম, শ্বাসতন্ত্র দুর্বল করে এমন কোনো বদভ্যাস আমার নেই, লকডাউনের অধিকাংশ সময় ঘরেই কাটিয়েছি এবং এতদিনেও যেহেতু করোনাভাইরাস হয়নি তাহলে আমার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও শক্তিশালী। তাহলে আমার এত সাবধান হওয়া দরকার নেই।”

প্রথমত, আপনি যে নিরাপদ, এতদিন হয়নি বলে যে এখন হবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। যদি ধরে নেওয়া হয় যে আপনার আসলেই কিছু হবে না, তারপরও কথা থেকে যায়। আর তা আপনার বাহক হওয়ার সম্ভাবনা।

ভাইরাস হয়ত আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দমাতে পারেনি তবে তা যদি আপনার শরীরে থেকে থাকে তবে আপনার মাধ্যমে অন্যকে আক্রান্ত করার ক্ষমতা রাখে যার অসংখ্য উদাহরণ আমরা দেখেছি।

‘অ্যাসিম্টোম্যাটিক’ অর্থাৎ যাদের ‘কোভিড-১৯’য়ের কোনো উপসর্গ তো নেই, তবে তার শরীরে ভাইরাস আছে এবং তা অন্যদের মাঝে ছড়াচ্ছে।

তাই সাবধানতা অবলম্বনের কোনো বিকল্প নেই।

হাত ধোয়া

ঘরের বাইরে যখন সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার সুযোগ নেই তখন ‘হ্যান্ড স্যানিটাইজার’ ব্যবহারের অভ্যাসটা বেশ ভালোই রপ্ত করতে পেরেছি আমরা। যারা পারেন-নি নিঃসন্দেহে তাদের অভ্যাসটা গড়া উচিত। তবে ঘরে থাকাবস্থায় কিছুক্ষণ পরপর সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাসটা আমাদের তেমন শক্তিশালী হয়ত হয়নি। হয়ত ভাবছেন ঘরেই তো আছি, এতো হাত ধোয়ার কি দরকার।

আপনার ঘরে বসে একই কথা ভাবতে পারেন আপনার অতিথিও। আবার আপনি হয়ত বাইরে যাচ্ছেন না, তবে ঘরে বাজার ও অন্যান্য সদাই আসছে, অফিস করা কিংবা বাইরে থেকে একটু হেঁটে ইত্যাদি কারণেও দিনে একবারের জন্য হলেও কেউ না কেউ তো বাইরে যাচ্ছে। তাদের মাধ্যমে কিংবা বাজারের ব্যাগের সঙ্গেও আপনার ঘরে ভাইরাস আসতে পারে। তাই ঘরে থাকলেও হাত ধোয়ার প্রয়োজনীয় ফুরিয়ে যায় না।

তাই নিজে যেমন হাত ধুতে হবে তেমনি ঘরে আসা অতিথিকেও হাত ধোয়ার ব্যাপারে উৎসাহীত করতে হবে।

শৌচাগার ব্যবহার

ঘরের সদস্য কিংবা অতিথি, একজন শৌচাগার ব্যবহারের পর তা আরেকজন ব্যবহারের মাঝে দুই মিনিটের ব্যবধান থাকা উচিত। ‘ফ্লাস করার আগে ‘কমোড’য়ের ঢাকনা নামানোর অভ্যাস করতে হবে। ‘টয়লেট টিস্যু’ সবার জন্য আলাদা করা কঠিন, তাই চেষ্টা করতে পারেন নিজের ব্যবহারের টিস্যু নিজের সংগ্রহে রাখা যাতে শৌচাগারের টিস্যু আপনাকে স্পর্শ করতে না হয়।

শৌচকাজ শেষে হাতে সাবান দেওয়ার অভ্যাস সবারই নিশ্চয়ই আছে, তবে হাত মোছার তোয়ালের কী হবে? এখানেও কাজে আসতে পারে আপনার পকেটে থাকা টিস্যু। অথবা কাপড়ের তোয়ালের বদলে ‘পেপার টাওয়াল’ ব্যবহার করা বেশি কার্যকর হবে। বিশেষ করে অতিথি আসলে। এই সকল টিস্যু ফেলার যে ঝুড়ি তা অবশ্যই ঢাকনাওয়ালা হতে হবে।

অতিথি চলে গেলে পুরো শৌচাগার জীবাণুমুক্ত করতে হবে। প্রয়োজনে বদলে ফেলতে হবে ‘টয়লেট টিস্যু রোল’।

শিশু ও আলিঙ্গন

একে অপরের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের ক্ষেত্রে আলিঙ্গনের ভূমিকা বলে শেষ করা সম্ভব নয়। বর্তমান পরিস্থিতির কারণে আমরা পরিণত বয়স্কদের সঙ্গে কোলাকুলি ব্যতিত ঈদ হয়ত পার করতে পেরেছি, তবে পরিবারের ছোট বাচ্চাদের কোলে নেওয়া, আলিঙ্গন করা থেকে বিরত থাকা আসলেই কঠিন, অনেকটা নির্মম এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা এড়ানো যায় না। এসব ক্ষেত্রে নিষ্ঠুর মনে হলেও আলিঙ্গনের সময় চেষ্টা করতে হবে অপর ব্যক্তি পুরোপুরি জড়িয়ে না ধরার এবং পরস্পরের মুখ বিপরীত দিকে ঘুরিয়ে রাখার। মুখোমুখি আলিঙ্গনে ঝুঁকি সবচাইতে বেশি, তবে ছোট বাচ্চা আপনার পা জড়িয়ে ধরলে সেখানে ঝুঁকি কিছুটা কম। তবে আলিঙ্গন না করারই সর্বাত্বক চেষ্টা করতে হবে।

অতিথি আপ্যায়ন শেষে পরিষ্কার অভিযান

করোনাভাইরাস কীভাবে ছড়ায় তা আমরা সবাই কমবেশি জানি। তাই ঘরে অতিথি আপ্যায়ন শেষে পুরো পরিবারের উচিত পুরো ঘর পরিষ্কারের অভিযানে নেমে পড়া। প্রতিটি আসবাব, মেঝে, শৌচাগার, সকল সমতল জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। মনে রাখতে হবে, করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে আপনার সবচাইতে নিরাপদ আশ্রয় আপনার নিজ ঘর, তাই একে ভাইরাসমুক্ত রাখা আপনার সবচাইতে বড় দায়িত্ব ও কর্তব্য।